প্রিয় অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়,
শ্রদ্ধা নেবেন । আপনি অনেক বড় মাপের মানুষ । নোবেল প্রাপ্ত বাঙালি । জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত ।
কলকাতায় এসে নবান্নে বসে জাতীয় নেত্রী হতে উদ্যত এক মহিলার সামনে বাংলার বেকারত্ব নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে যে কথা বললেন তার নির্যাস – আমাদের রাজ্যের অনেকটা আয় আসে পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে । সুতরাং একা এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় । দেশের অর্থনীতি যত সচল হবে, তত গতি বাড়বে আমাদের রাজ্যের অর্থনীতির । অনেকে বাইরে গিয়ে কাজ করেন । সেই আয়ের সূত্র যতদিন না-ফেরে, তত দিন অর্থ নীতি চাঙ্গা হওয়া শক্ত ।
একজন শ্রোতা হিসেবে আমার দুটি প্রশ্ন আপনার কাছে – ১. পরিযায়ী শ্রমিকরা আয় করে রাজ্যে পাঠাবেন তবে রাজ্যের অর্থনীতি শক্ত হবে ? ২. একটা রাজ্যে ৪২ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কেন হয়েছে ভেবে দেখেছেন কখনো ?
টাটাকে মেরে তাড়ানোর পর কোন ভারী শিল্প, নামী শিল্প প্রতিষ্ঠান আর বাংলাকে বিশ্বাস করে না কেন, কি কারণে এটা কি জানেন না আপনি ?
একটা খবর দিই ।
মাত্র ১৫ দিন আগে জিন্দাল গোষ্ঠী অন্ধ্রপ্রদেশের নেলোরে ২.২৫ মিলিয়ন টন ক্যাপাসিটির ইন্টিগ্রেটেড স্টিল প্ল্যান্টের জন্য সাড়ে সাত হাজার কোটির বিনিয়োগ চূড়ান্ত করল । সরকারি প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ৮৬০ একর জমিতে নির্মীয়মান এই বিনিয়োগে প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ পাবেন আড়াই হাজার জন । অপ্রত্যক্ষ ভাবে আরো কয়েক হাজার । ওয়াই এস জগমোহন রেড্ডিকে যাঁরা বিশ্বাস করতে পারল এ রাজ্যের মমতাকে তাঁরা বিশ্বাস করতে পারল না । জিন্দালদের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিরাট জমি ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিলেন । সেখানে ছোট একটি সিমেন্ট কারখানা খুলে রেখে জিন্দালরা পাড়ি দিলেন অন্ধ্রে । কেন ??
জানেন না আপনি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ? এই খুব ছোট্ট ইতিহাসটা ? কেন জিন্দালরা চলে গেলেন, পেছনের ইতিহাসটা মনে পড়ে আপনার ?
আপনি জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় । আপনি নোবেল লরিয়েট, হোয়াট দা ইকোনমি নিডস নাও এর লেখক আপনি । আপনি প্রণম্য । আপনাকে আরো একটি তথ্য দিই । শুনবেন ?
উঠতে বসতে যে বাঙালি যোগী আদিত্য নাথের ভূত দেখে তার রাজ্য উত্তর প্রদেশে গত সাড়ে তিন বছরে ১ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে । সাম্প্রতিক কালে ১৫৬ টা ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৮ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা । ইলেকট্রনিক ম্যানুফ্যাকচারিং-এই ৩০ টি কোম্পানির সর্বমোট বিনিয়োগ ৩২ হাজার কোটি টাকা । চীনে পাততাড়ি গুটিয়ে স্যামসাং এর মত প্রতিষ্ঠান উত্তরপ্রদেশে গড়ে তুলছে তার নির্মাণ কেন্দ্র ।
শুধু গত এক বছরে এক লক্ষ ৩৫ হাজার স্কুল শিক্ষককে নিয়োগ পত্র দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী । সেখানে পশ্চিম বঙ্গে এস এস সি পরীক্ষা হয়েছে গত দশ বছরে দু বার, যার নিয়োগ এখনো শেষ হয়নি ।
জানেন এসব মামুলি তথ্য, আপনি মাননীয় অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ? কেন বিনিয়োগকারীরা উত্তর প্রদেশকে বেছে নেন, বাংলাকে বিশ্বাস করে না কেন কি কারণে জানেন আপনি সেই কারণ ?
উত্তরটা শুনুন প্রিয় নোবেল লরিয়েট । কান পেতে শুনুন ” পুওর ইকোনমিকসের” লেখক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ।
প্রায় প্রতি বছর বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে আসা মুকেশ আম্বানির কথা । চারবারের মধ্যে তিন বার এসেছিলেন মমতার ডাকে । সাড়ে তিন হাজার দেশি বিদেশি অতিথির সামনে বাংলায় আসা নয়, বাংলা নিয়ে আশার অনেক কথা শুনিয়ে গেছেন । সেই মুকেশ আম্বানি নিজের বোর্ড সদস্যের কাছে ফিরে গিয়ে বলেছেন বাংলায় বিনিয়োগ করা আর রেল লাইনে গলা দেওয়া আমার কাছে সমার্থক ।
শুনেছি এই কাহিনী, ভারত বিখ্যাত এক সাংবাদিকের মুখে ।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আপনি জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত । আপনি আমারও শ্রদ্ধেয় । কিন্তু এক উদ্ধত মহিলাকে খুশী করতে আসল সত্যকে এত সহজে আড়াল করলেন তাও অসাধারণ একটা আর্ট । আপনি সত্যি জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত । আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বাড়লো ।
পরিযায়ীরা টাকা পাঠাবে তবে একটা রাজ্যের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে আপনার এই তত্ত্বের জন্য আপনার আরো একবার নোবেল পাওয়া উচিত এই বোধ আরো আমার মধ্যে প্রগাঢ় হল ।
একটা রাজ্য শুধু অবিশ্বাসের বাতাবরণে বেঁচে থেকে বিনিয়োগ হারাবে, সাড়ে পাঁচ লক্ষ সরকারি কর্মসংস্থান বন্ধ করে খেলা, মেলা, উৎসবে, ভাতায় সরকার ইনভেস্ট করবে সে রাজ্যের হতভাগ্য বেকাররা পরিযায়ী হবে শাসকের নির্বুদ্ধিতায় ও ঔদ্ধত্যে এটাই ভবিতব্য ।
সেই তাদের কপালে কর্মসংস্থান নয়, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই “পরিযায়ী তত্ব”ই বাড়তি পাওনা । সেই পাওয়া কি কিছু কম পাওয়া ? কি বলেন শ্রদ্ধেয় ?
সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ( ৯৮৩০৪২৬০৭৮)।