“মন্বন্তরে মরি নি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি…”
বাঙালীর সাথে মারী-মড়কের সম্পর্ক বহু পুরানো।বঙ্গ তথা ভারতের বুকে নানা সময়ে মারী-মড়ক-মন্বন্তর আঘাত করেছে।লক্ষ লক্ষ মানুষ তাতে প্রাণ হারিয়েছেন।জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে বারংবার।মারীর সাথে সংগ্রামে মানুষই জয়ী হয়েছে।
গত কয়েক শতাব্দী ধরে দেখা যাচ্ছে যে,প্রতি শত বছর পর পর পৃথিবীতে মহামারীর প্রাদুর্ভাব আছড়ে পড়ছে।কখনো প্লেগ,কালাজ্বর তো কখনো সোয়াইন ফ্লু,ইবোলা বা ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া।তারসাথে রয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক মন্বন্তর,ভূমিকম্প,খরা-বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগ।যাতে প্রতি বছরই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানি ঘটে।শত শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়।
এত প্রাণহানির পরও মানুষ আশাহত হয় না।দুর্যোগ-দুর্বিপাক কেটে গেলেই মানুষ ধীরে ধীরে তার নিজস্ব জীবনছন্দে ফিরে যায়।প্রিয়জনের বিয়োগব্যথার উপর সময়ের পলি সিঞ্চিত হতে হতে সেই দুঃসহ শোক-সন্তাপও মানুষ ভুলে যায়।যাঁকে বা যাঁদের ছাড়া জীবন এক মুহূর্তও ভাবা যেত না,তাঁদের কথা-স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে মানুষ পুনরায় স্বাভাবিক ছন্দে চলতে শুরু করে! “চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি সুখানি চ”, দুঃসহ ব্যথা-যন্ত্রণা,মারী,দুর্যোগ-দুর্বিপাক,দুঃখ-সুখ–কোনো কিছুই জীবনে চিরস্থায়ী নয়।সবকিছুই ঘুরন্ত চাকার প্রতিটি বিন্দুর মতো,প্রতিক্ষণেই তার অবস্থান উপর-নিচেয় পাল্টে পাল্টে যায়।
প্রায় দেড় বছর হতে চলল বিশ্ব এক অতিমারীর মধ্য দিয়ে চলেছে।প্রতিটি দেশই কম-বেশি নিজ নিজ প্রিয় নাগরিকদের হারিয়ে চলেছে এই অতিমারীতে।ভারতেও একই পরিস্থিতি।সুখের বিষয় এই যে,বিশ্বের নানা দেশ এই অতিমারীর টিকা আবিষ্কার করেছে।সেগুলি উন্নততর করার গবেষণাও চলেছে একই সাথে।ভারতে ইতিমধ্যেই একুশ কোটি নাগরিককে এই টিকা দেওয়া হয়েছে।সরকার লক্ষ্য স্থির করেছে যে,চলতি বছরের মধ্যেই প্রত্যেক ভারতীয়কে টিকা দেওয়া হবে।
বলা হয় যে, “শরীরম্ ব্যাধী মন্দিরম্”– দেহ ব্যাধীরই বাসগৃহ।যতদিন দেহ নীরোগ থাকে,ততদিনই সৌভাগ্যের মানতে হবে।জন্মানোর সাথে সাথেই প্রতিটির প্রাণী এমনকি উদ্ভিদেরও তিনটি বিষয় নিশ্চিত হয়ে যায়।সেগুলি হল,জরা-ব্যাধী এবং মৃত্যু।এই তিনটিকে কেউ-ই এড়িয়ে যেতে পারে না।কিছু আগে বা কিছু পরে– এই যা পার্থক্য।
বর্তমান অতিমারী প্রতিরোধ করার জন্য বিগত কয়েক মাস ধরেই নানা বিধিনিষেধ সরকার আরোপ করে চলেছে।কিছু সতর্কতাও অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।যাতে করে সকলে সুস্থ থাকতে পারেন।নিজ পরিবার ও অন্যদের সুরক্ষিত রাখতে পারেন।বিধি ও সতর্কতাগুলি মেনে চলা দেশের নাগরিক তথা মানুষ হিসেবে অবশ্যই কর্তব্য।অতিমারী দিন কয়েক পূর্বেই ভয়াবহ আকার নিয়েছিল।যা বর্তমানে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে।
ইতিমধ্যেই অনেকে তাঁদের প্রিয়জন,নিকট প্রতিবেশীদের হারিয়েছেন।গৃহবন্দী অবস্থায় মৃত্যু সংবাদ পেতে পেতে অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত ও ভীত হয়ে পড়েছেন।যাঁর সাথে নিত্য দেখা হয়,আলাপ হয়,হঠাৎই যদি শোনা যায়,তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন,তাহলে সত্যিই হৃদয় কেঁদে ওঠে।একটা শিরশিরানি-চিনচিনে যন্ত্রণায় হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে।মৃত্যুভীত ব্যক্তি কেবলই ভাবতে থাকেন–এবার বুঝি আমার পালা!দিন দিন চেনা জানা,স্বপ্ল পরিচিত জনের মৃত্যু খবর মানুষকে দিশাহারা করে দেয়।সামগ্রিক ভাবেই সকলে এক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি।
এই কালবেলা-দুঃসহনীয় বিয়োগ ব্যথার মধ্যেও অনেক অনেক ভালো ঘটনাও ঘটে চলেছে।যেগুলি হয়ত আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে।এগুলি নজরে পড়লে আশাহত জনেরা আশার আলো দেখতে পেতেন।
এই দুঃসময়ে,গৃহবন্দী দশায়,দেখুন কত কত অচেনা-অজানা সংগঠন,যুবক-যুবতীরা নিজেদের বিপদ তুচ্ছ করে পীড়িত জনদের নিঃস্বার্থভাবে সেবা করে চলেছেন।তাঁদের ওষুধপথ্য-খাদ্য-পানীয়-অক্সিজেন যুগিয়ে,নিত্য তাঁদের খোঁজখবর নিয়ে,মনকে খুশি রাখতে…কত কত ভাবে এই অজানা-অচেনারা কাজ করে চলেছেন।আপনার নিকটতম প্রতিবেশীর ছেলেটি বা মেয়েটি,যাঁকে আপনি নিজের হীরের টুকরো সন্তানের তুলনায় নেহাতই রাংতা ভাবতেন,যাঁকে কুনোব্যাঙ-অলস বলে বন্ধুদের কাছে প্রশংসা করতেন,এই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সেই কুনোব্যাঙটাই মানুষের সেবায় নেমে পড়েছে।পিতা-মাতার নিষেধ সে মানে নি।নিজের মৃত্যুকে সে ভয় পায় নি।আর আপনার হীরের টুকরোকে আপনি কিন্তু ঘরের কোণে সোনাব্যাঙ করে বন্দী রেখেছেন।মানুষের সেবায় আপনার সংকীর্ণ মন তাঁকে পাঠাতে দেয় নি।আপনি নিজেও যান নি। পাড়ায় পাড়ায় আড্ডামারা,রকবাজি করা ছেলেমেয়েরাই আজ সবার আগে আর্তদের সেবায় এগিয়ে এসেছে।
এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও অনেকেই আগাম মরণোত্তর দেহ দান করে যাচ্ছেন।অন্তত পরিবারকে জানিয়ে রাখছেন নিজের ইচ্ছার কথা।যাতে হঠাৎই মন্দ কিছু হলে ডাক্তারি পড়ুয়াদের কাজে লাগে দেহটি।অনেকে আবার প্রতিটি অঙ্গ আলাদা ভাবে এবং বাকি দেহাংশ আলাদা করে দান করছেন।আপনি কি কখনো এমন ভেবেছেন যে,এভাবে মৃত্যুর পরেও মানব সেবা করা যায়!চাকরিরত কোনো কোনো চিকিৎসক-সেবিকারা হয়ত চাকরির শর্ত হিসেবে ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে বাধ্য হচ্ছেন ঠিকই।কিন্তু সবাই তো তেমন নন।তাঁরা মানব দরদী।তাঁরা মহান কর্তব্য হিসেবেই আমাকে আপনাকে চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলছেন।
তাই মহামারীতে আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না।এই মহামারীতে আজ পর্যন্ত যত মানুষ ভারতে মারা গিয়েছেন,তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দৈনিক নানা কারণে আমাদের দেশে মারা যান।
মহারাজা অশোকের কলিঙ্গযুদ্ধ,আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয় যুদ্ধ,দুটো বিশ্ব যুদ্ধ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তো নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন।১৭৭০ সালের মন্বন্তরে প্রায় ৫০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারিয়ে ছিলেন।১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের সাঁড়াশি আক্রমণে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘরে এই বঙ্গপ্রদেশেই।সেই তুলনায় বর্তমান মহামারী অনেক কম জীবন নিয়েছে।পৃথিবীতে মানুষ আসার পর থেকে,কোনো প্রলয়ই আর পৃথ্বীকে মানব শূন্য করতে পারে নি।ভারতীয় পুরাণে যাঁরা বিশ্বাস রাখেন,তাঁরাও দেখবেন,সব মহাপ্রলয়-প্লাবনের পরে মানুষ টিকে গিয়েছে।কেউ তাকে পৃথিবীর বুক থেকে উৎখাত করতে পারে নি।যাঁরা ‘শ্রীশ্রী গীতা’-কে অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করেন,তাঁরা জানেন যে,আত্মার মৃত্যু হয় না।মানুষ যেমন পুরাতন বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে,আত্মাও তেমনি পুরানো-জর্জর দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ নেন।আমাদের উপনিষদে বলা হয়েছে যে,পৃথিবীর যাবতীয় জীব-উদ্ভিদ মূল পাঁচটি উপাদানে গঠিত।সেগুলি হল মাটি,জল,তেজ বা সৌরশক্তি,মরুৎ বা বায়ু এবং আকাশ।আধুনিক বিজ্ঞানও এর সত্যতা খুঁজে পেয়েছে।তাই উপনিষদ বারবার বলেছে,”বিশ্বের যা কিছু সব মানব দেহের মধ্যে আছে।এবং মানব দেহের মধ্যেই বিশ্ব বিরাজ করছে।” এক পরমাত্মা সবখানে।জন্মেও সেই পরমাত্মা।মৃত্যুতেও তিনি।এই উপলব্দি যাঁরা করতে পেরেছেন,মৃত্যুকে তাঁরা জয় করেছেন।মৃত্যুকে তাঁরা অখিল ব্রহ্মের সাথে মিলন-সেতু মনে করেন।
তাই অকারণে আতঙ্কিত হয়ে নিজের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করবেন না।আপনাকে-আমাকে সুস্থ-প্রাণবন্ত-সতেজ রাখতে প্রকৃতিও বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে প্রতিদিন হাজির হয়।সূর্যোদয় কালে মুক্ত প্রকৃতিতে একটু হাঁটুন।পারলে সকালের শস্যক্ষেতে একটু ঘুরুন-ফিরুন।বাড়ির টবে ফোটা ফুলটার দিকে একটু তাকান।ফুলের হাসি বোঝার চেষ্টা করুন।প্রভাত-সন্ধ্যায় পাখির গান শুনুন।দেখবেন মন হাল্কা হবে।তারপরে তো রইলো-ই সংসারের চাপ,কর্মস্থলের চাপ।
ভোগবাদীরা বিশ্বাস করে যে,এই জীবনেই সকল কিছু ভোগ করে নাও।আর সুযোগ পাবে না।এই বিশ্বাসীরা মৃত্যুকে ভয় পান।ভারতবর্ষ আধ্যাত্মিক দেশ।এখানে ব্রহ্মবাদী চিন্তনের বিকাশ ঘটেছে।তাঁরা বলেন,”এখানে আরম্ভও নয়।শেষও নয়।অনন্ত জীবন সামনে পড়ে আছে।মৃত্যুকে জয় করেই মৃত্যুঞ্জয়ী হতে হয়।”
বিশ্বে যা-কিছু শাশ্বত,সনাতন তা বিজয়ী হবে।মারী-মড়ক-মন্বন্তর চিরন্তন নয়।সময়ের অবকাশে সেগুলি ঘুরে ফিরে আসবে হয়ত।আবার চলেও যাবে।তাছাড়া আমরা জীবানু-ভাইরাস-ব্যাকট্রিয়ার মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েই বেঁচে থাকি।প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তে আমাদের দেহের সংস্পর্শে কোটি কোটি জীবানু আসে।এমন-কি আমাদের দেহের মধ্যেও অসংখ্য জীবানু বসবাস করে।তবুও দিব্যি বেঁচে আছি।
শুধুমাত্র ধ্রুব বিশ্বাস রাখুন যে "সত্যমেব জয়তে"-- সত্যই জয়লাভ করে।
সুজিত চক্রবর্তী