মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর গুরু স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ব্রহ্মচার্যের জীবনকে অবলম্বন করেছিলেন এবং জনগণের সেবা করবার ব্রত গ্রহণ করে জীবন কাটিয়েছিলেন। জন্ম ১৫ ই ডিসেম্বর ১৯০০ সাল, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের গোপালপুরে। প্রয়াণ ৪ ঠা জুন ১৯৮৩ সাল, মহিষাদল, পূর্ব মেদিনীপুরে। বীর বিপ্লবী মেদিনীপুর তথা ভারত বর্ষের বীর বিপ্লবী সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্তের ১২২ তম জন্মজয়ন্তী।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ‘ এ উত্তপ্ত গোটা ভারত । ব্রিটিশদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা । এমনই এক কঠিন সময় । যে সময়ের প্রাক্কালেও দাঁড়িয়ে তাম্রলিপ্ত বা বর্তমান তমলুক- এর মাটিতে দেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গড়ে তুললেন বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত । ১৯৪২ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর গঠিত হয় এই সরকার । ‘ তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ‘ নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল তাঁর গঠিত নিজস্ব সরকার । গোটা ভারতবর্ষের কেউ যেখানে কোনো অস্থায়ী সরকার গড়তে পারেন নি সেখানে তিনি অখণ্ড মেদিনীপুর জেলা থেকেই গঠন করেছিলেন একটি অস্থায়ী সরকার । এই সরকারের অস্তিত্ব ছিল ১৯৪৪ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
এই সরকারের বিভিন্ন বাহিনী গঠিত হয় । এই জাতীয় সরকার সে সময় পৃথক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল । আইন – শৃঙ্খলা , স্বাস্থ্য , শিক্ষা , বিচার , কৃষি , প্রচার , সমর ইত্যাদি বিভাগে পৃথক পৃথক সচিব নিয়োগ করা হয়েছিল । সবার উপরে ছিলেন সর্বাধিনায়ক বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত । অর্থসচিব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখোপাধ্যায় , মুখ্যমন্ত্ৰী অজয়কুমার স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন সুশীলকুমার ধাঁড়া , বিচার বিভাগীয় প্রধান প্রফুল্ল কুমার বসু , খাদ্য দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন সতীশচন্দ্র সাহু , প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন প্রহ্লান্দ কুমার প্রামাণিক । ‘ তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ‘ এর মুখপত্র ছিল ‘ বিপ্লবী ‘ পত্রিকা । দেশ রক্ষার জন্য তৈরি করা হয় বিদ্যুৎ বাহিনী ও ভগিনী সেনা । সতীশচন্দ্র সামন্ত প্রতিটি থানায় একজন করে থানা অধিনায়ক নিযুক্ত করেন । তমলুক থানার দায়িত্ব দেওয়া হয় বিখ্যাত বিজ্ঞানী মণি ভৌমিকের পিতা গুণধর ভৌমিককে । সুতাহাটা থানার দায়িত্ব দেওয়া হয় জনার্দন হাজরাকে , মহিষাদলের দায়িত্ব দেওয়া হয় নীলমণি হাজরাকে ও নন্দীগ্রাম থানার দায়িত্ব দেওয়া হয় কুঞ্জবিহারী ভক্ত দাসকে । ব্রিটিশদের নাকের ডোগার আড়ালে গোপনে চলতো এই সরকার ৷ সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে নারকেলদহ গ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এক গোপন বৈঠক করেন । সেই বৈঠকের মাধ্যমেই ব্রিটিশ শাসন অস্বীকার করে এই স্বাধীন সরকারটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ।
১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সফলভাবে কাজ করেছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার । ঘূর্ণিঝড় – বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণকার্য , বিদ্যালয় অনুদান প্রদান ও বিদ্যুৎ বাহিনী নামে একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন ছিল এই সরকারের প্রধান উল্লেখযোগ্য কীর্তি ।
মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ৪২-এর বিপ্লব চলছে দেশে। ১৯৪২-এর ৮ সেপ্টেম্বর জনৈক মিল মালিক খাদ্যশস্য পাচার করার চেষ্টা করলে গ্রামের মানুষের সঙ্গে শুরু হয় সংঘর্ষ। এরপর তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, ভগবানপুর অঞ্চলের সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেন বিপ্লবীরা। ‘৪২-এর ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সামন্ত ও সুশীল ধাড়া— এই তিন বিপ্লবীর নেতৃত্বে মেদিনীপুরের চারটি থানা দখলের অভিযান শুরু হলো। বিনা রক্তপাতে সুতাহাটা থানার পুলিশ আত্মসমর্পণ করলে এই থানাটি বিপ্লবীদের দখলে এলো। রক্ত ঝরিয়ে তমলুক, মহিষাদল, ও নন্দীগ্রাম— অন্য তিনটি থানাও কব্জায় চলে এলো। কিন্তু পুলিশের গুলিতে জাতীয় পতাকা বুকে নিয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হলেন বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা। কিন্তু ব্রিটিশের দখলমুক্ত তমলুক এলাকা থেকে নেমে গেল ব্রিটিশের ইউনিয়ন জ্যাক। এর প্রতিক্রিয়া ঘটলো ১৯৪২-এর ১৬ অক্টোবর। দিনটা ছিল দুর্গাপুজোর সপ্তমী। ওই দিন তমলুক মহকুমা জুড়ে শুরু হলো তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। শুরু হলো বন্যা। বন্যায় সাধারণ মানুষের প্রায় যথাসর্বস্ব ভেসে গেল। পুজোর আনন্দ পরিণত হলো নিদারুণ বিভীষিকায়।
কিন্তু দেশের ব্রিটিশ সরকারের তরফে বন্যাদুর্গতদের কাছে পৌঁছলো না কোনো সাহায্য। বরং তার বদলে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ বাহিনী গ্রামের মানুষের ওপর চরম নির্যাতন চালালো। মেয়েদের শ্লীলতাহানিও ঘটলো।
আসলে চারটি থানা দখল অভিযানের প্রতিশোধ নিতেই ব্রিটিশ সরকার এই অত্যাচার চালিয়েছিল।
এই দু: খের দিনে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর বিপ্লবীরা তমলুকের নারকেল গ্রামে গড়ে তুলনেন “তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার।” উদ্দেশ্য: বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষদের পুনর্বাসন, ব্রিটিশের অত্যাচারের অবসান এবং তমলুক মহকুমায় শান্তি প্রতিষ্ঠা।
গঠিত হলো জাতীয় সরকারের একটি মন্ত্রীসভা:
১) সতীশচন্দ্র সামন্ত: সর্বাধিনায়ক, পররাষ্ট্র ও সামরিক দপ্তর
২) অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়: অর্থ দপ্তর
৩) সুশীল কুমার ধাড়া: দেশ রক্ষা ও স্বরাষ্ট্র দপ্তর
৪) প্রফুল্ল কুমার বসু: বিচার বিভাগ
৫) সতীশচন্দ্র সাহু: খাদ্য দপ্তর
৬) প্রহ্লাদ কুমার প্রামাণিক: প্রচার
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মুখপত্র হলো “বিপ্লবী” পত্রিকা। দেশ রক্ষার জন্য তৈরি হলো বিদ্যুৎ বাহিনী এবং ভগিনী সেনা।
প্রতিটি থানায় একজন করে থানা অধিনায়ক নিযুক্ত করলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত:
১) তমলুক: গুণধর ভৌমিক ( বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মণি ভৌমিকের পিতা )
২) সুতাহাটা: জনার্দন হাজরা
৩) মহিষাদল: নীলমণি হাজরা
৪) নন্দীগ্রাম: কুঞ্জবিহারী ভক্ত দাস
স্বাধীনতার পর তিন দশকেরও বেশি সময় তিনি থেকেছেন লোকসভার সদস্য। ১৯৫২ সালে প্রথম লোকসভায় তমলুক কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সতীশচন্দ্র। এরপর ১৯৫৭, ১৯৬২, ১৯৬৭ ও ১৯৭১ সালেও একই কেন্দ্র থেকে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে দিল্লিতে গণ-পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেন সতীশচন্দ্র। ১৯৪৭-১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই পরিষদের সদস্য ছিলেন। পরে ১৯৫০-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিলেন সামরিক পার্লামেন্টের সদস্য। তারপর ভারতবর্ষের প্রথম লোকসভা থেকে পঞ্চম লোকসভা (১৯৫২-১৯৭৬ খ্রি: ) ছিলেন লোকসভার সদস্য। এই সময়কালে তাঁর উত্থাপিত প্রশ্ন সংখ্যা ২৫ হাজার, প্রবর্তিত বিলের সংখ্যা তিনশো। এরপর ষাটের দশকের শেষদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীল ধাড়া কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে গঠন করেন বাংলা কংগ্রেস। তৈরি হলো যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু সতীশচন্দ্র সে সরকারে যোগ দিলেন না।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হলেন সুশীল ধাড়া। এলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাশ্বতীপ্রসাদ বাগ এবং পরবর্তীকালে ইন্দিরা কংগ্রেসের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু যুদ্ধফ্রন্ট বেশিদিন টিকলো না। পরবর্তীকালে তৈরি হলো জনতা দল। মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু জনতা সরকারও টিকলো না। ১৯৮০-তে বিপুল ভোটে জিতে ফের প্রধানমন্ত্রী হলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। সতীশচন্দ্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ইন্দিরার। সতীশচন্দ্রের অন্যতম কীর্তি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন হলদিয়া বন্দরের সূচনা। সে সময়ের কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রী রাজবাহাদুর হলদিয়া বন্দরের নাম রাখতে চেয়েছিলেন “সতীশচন্দ্র বন্দর।” কিন্তু তা হয়নি। তবে একটি জেটি ও একটি রাস্তার নাম সতীশচন্দ্রের নামে হয়েছে। এছাড়া মহিষাদলে একটি রেলস্টেশনের নাম রাখা হয়েছে “সতীশ সামন্ত হল্ট।” আর গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম পাল্টে হয়েছে “সতীশচন্দ্র সামন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত।”
সতীশচন্দ্র তাঁর রাজনৈতিক গুরু স্বামী “প্রজ্ঞানানন্দ ভবন” তৈরির জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পৈতৃক সম্পত্তির মধ্যে মোট ৪ একর ১২ ডেসিমেল জমি এবং এক লক্ষের বেশি টাকা দান করেন। এই ভবনের মধ্যেই রয়েছে পঞ্চায়েত ট্রেনিং সেন্টার, গ্রন্থাগার, সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়, শরীর চর্চা কেন্দ্র, পাঠচক্র, দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে কমিউনিটি হল্।
দিল্লির ৭ নম্বর ইলেকট্রিক লেনের ( এখন হরিশ্চন্দ্র মাথুর লেন ) বাসভবনের পিছনে নিজের হাতে বিভিন্ন ধরণের শাকসবজির চাষ করতেন চাষি পরিবারের সন্তান সতীশচন্দ্র। বন্ধু-বান্ধবদের উৎসাহিত করতে সেইসব শাকসবজি তাদের দিতেন। গ্রামে এলে এলাকায় ঘুরতেন। রাস্তায় পায়খানা পড়ে থাকলে লোকজনকে পায়খানার প্লেট কিনে দিয়ে বাড়িতে শৌচাগার তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আজকের স্বচ্ছ ভারতের শুরুটা করেছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত।
দুটি বই লিখেছেন সতীশচন্দ্র, ” টু ইয়ারস্ ন্যাশনাল গভর্ণমেন্ট ইন্ মিদনাপুর” এবং “মুক্তির গান।” ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন ব্রিটিশ ভারতে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের প্রথম সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্ত’ র প্রয়াণ ঘটে। মহাত্মা গান্ধীর আগমন উপলক্ষে মেদিনীপুরের এক্তারপুরে সতীশচন্দ্র সামন্ত, সুশীল কুমার ধাড়াদের উদ্যোগে যে “গান্ধীমেলা” শুরু হয়েছিল, মহিষাদলের মানুষের উদ্যোগে তা এখনও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।