একটি কথা মতো:-
সরস্বতীর জন্ম কীভাবে? জানা যায়, ব্রহ্মার কন্যা নাকি সরস্বতী! ব্রহ্মা ধ্যানে বসে সমস্ত গুণ একত্রীভূত করে সৃষ্টি করলেন এক কন্যার। সেই হলো সরস্বতী। বায়োলজিক্যালি মুখ দিয়ে কাউকে সৃষ্টি করা যায় না। যাই হোক, সৃষ্টির পরই মেয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন পিতা। তিনি চাইলেন সেই মেয়ের সঙ্গে যৌনক্রীড়া করতে। ব্রহ্মার দৃষ্টি থেকে বাঁচতে সরস্বতী অন্য দিকে সরে যেতে থাকেন। কিন্তু তিনি যে দিকে সরেন সে দিকেই ব্রহ্মার একটা করে মুখ তৈরি হয়। এই ভাবে ব্রহ্মার পাঁচটা মাথা গজাল। শেষে সরস্বতী রাজহংসীর রূপ ধরে বনে পালিয়ে গেলেন। তাতেও শেষরক্ষা হল না। ব্রহ্মার কাম থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না। ব্রহ্মাও রাজহাঁসের রূপ ধরে তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। তাহলে কি বাবা – মেয়ের যৌনতা উচিত? পুরাণে কিন্তু সে নিয়ে কোনও যুক্তি নেই। সরস্বতীর ওই রূপই পরবর্তীকালে তার বাহন হয়েছে।
অন্য একটি কথা মতো:—
সরস্বতী পুরাণে বলা হয়েছে, ব্রহ্মা যখন জগৎ সৃষ্টির লক্ষ্যে গভীর ধ্যানমগ্ন হন, তখন তাঁর বীর্য থেকেই সরস্বতীর জন্ম হয়। এই সরস্বতী প্রথমে শতরূপা, পরে গায়ত্রী, সাবিত্রী,ব্রহ্মাণী প্রভৃতি নামে অভিহিত হন। এখানে একটা কথা আছে যে, সরস্বতীর জন্ম মাতৃগর্ভে ছাড়াই হয়।
কথিত আছে, জন্মের পর ব্রহ্মার নজর সরস্বতীর দিকে পড়ে। সরস্বতী দেবী তা বুঝতে পেরে চারিদিকে লুকোবার ব্যবস্থা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আকাশগঙ্গায় আশ্রয় নেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা ব্হ্মা অনুসরণ করে সেখানেও উপস্থিত হয়ে সরস্বতীকে প্রণয়ে আবদ্ধ করেন। তাঁদের সন্তানের নাম সয়ম্ভূ বা মনু যিনি বেদ ও সংস্কৃতের প্রবর্তন করেন।
আরো একটি মত:-
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুজা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভুজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা। স্কন্দপুরাণে তাঁকে নিয়ে সুন্দর গল্প পাওয়া যায়। গল্পটি এ রকম — ব্রহ্মার মানসকন্যা হলেন সরস্বতী। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে এক সময় ব্রহ্মা তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হতে চান। সরস্বতী আত্মরক্ষা করতে বার বার নানা প্রাণীর রূপ ধারণ করতে থাকেন। তাঁকে অনুসরণ করে ব্রহ্মাও বার বার সেই প্রাণীর রূপ নেন এবং তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। এ ভাবেই বার বার মিলিত হওয়ার ফলে প্রাণীজগতের সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মার এই দুরাচার সহ্য করতে না পেরে দেবাদিদেব তাঁকে শরবিদ্ধ করে মেরে ফেলেন। সরস্বতী পাতালে পালিয়ে বাঁচলেন।
শরীর ত্যাগ করে ব্রহ্মা শিবের শরণাপন্ন হন এবং তাঁর তপস্যা শুরু করেন। এক সময় তিনি আবার প্রাণ ফিরে পান। অতঃপর তিনি দেখেন সব দেবতার মন্দির আছে, কিন্তু তিনি অভিশপ্ত বলে তাঁর মন্দির নেই। তিনি তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে চান। একটি সর্বরত্নময়ী শিলা তিনি পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেন। সেটি এসে পড়ল চমৎকারপুর নামক একটি জায়গায়। ব্রহ্মা সেখানেই নিজের মন্দির স্থাপন করলেন। অতঃপর তিনি সরস্বতীকে পাতাল থেকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘এখন থেকে তুমি এই পৃথিবীতে এসে আমার কাছে সব সময় থাকো। আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করব।’ সরস্বতী তাঁর কথা শুনে ভীত হয়ে বললেন, ‘আমি লোকের স্পর্শে ভয় পাই বলে পাতালে থাকি। কিন্তু আপনার আদেশও অমান্য করতে পারব না। তাই আপনি সব দিক বিচার করে একটি অন্য ব্যবস্থা করুন।’ তখন ব্রহ্মা সরস্বতীর অবস্থানের জন্য একটি হ্রদ খনন করলেন। সরস্বতী সেই হ্রদে অবস্থান করতে লাগলেন। ব্রহ্মা বিষধর সাপেদের সেই হ্রদ ও সরস্বতীর রক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করলেন। এ ভাবেই দেবী সরস্বতী পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা পান।
মার্কণ্ডেয় ও দেবীভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসুরকে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তি কল্পনা করা হয়েছিল, তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভুজা— বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘণ্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। দেবীভাগবত পুরাণ থেকে আরও জানা যায়, সরস্বতীর জন্ম বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে। তাই তিনি বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, সকল সংশয় ছেদকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী এবং বিশ্বের উপজীবিকা স্বরূপিনী। ব্রহ্মাই প্রথম তাঁকে পুজো করেন। পরে জগতে তাঁর পুজো প্রতিষ্ঠিত হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পুজো প্রবর্তন করেন মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে।
সরস্বতীর পূর্ব জন্মের নাম ছিল আসাবারী। তখন তিনি ছিলেন নারায়ণের তিন পত্নীর একজন। বাকি দু’জন হলেন গঙ্গা ও লক্ষ্মী। একবার গঙ্গা ও নারায়ণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাস্যরস করছিলেন। সতীনের প্রেম দেখে সহ্য করতে পারলেন না সরস্বতী। তিনি গঙ্গার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেন। এই ঝগড়ার পরিণামে গঙ্গা আসাবরীকে অভিশাপ দেন। এই অভিশাপে আসাবরী মর্ত্যের নদীতে পরিণত হন। পরে নারায়ণ বিধান দেন, তিনি এক অংশে নদী, এক অংশে ব্রহ্মার পত্নী ও শিবের কন্যা হবেন এবং কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে সরস্বতী-সহ তিন দেবীরই শাপমোচন হবে। এ ভাবেই গঙ্গার অভিশাপে আসাবারী মর্ত্যে নদী হলেন এবং ব্রহ্মার পত্নী হলেন ও শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্টি হয়ে তাঁর কন্যা হলেন।