সরস্বতী পূজা , ভারতবর্ষের সুস্পষ্ট জাতীয়তা ও প্রাচীনতম সভ্যতার উদযাপন

p

মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে অর্থাৎ বসন্ত পঞ্চমীতে জ্ঞানের দেবীরূপে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে। অনেক জায়গায় নবরাত্রি উৎসবের নবম দিনে ‘মা’ সরস্বতীর আরাধনা হয়।বাঙ্গালীদের সরস্বতী পূজার সঙ্গে ‘হাতে খড়ি’ অর্থাৎ শিশুদের বিদ্যাচর্চা আরম্ভের অনুষ্ঠান এবং দক্ষিণ ভারতে একই অনুষ্ঠানে ‘বিদ্যারম্ভ’ নামে পালন করা হয়।
ভারতীয় মননে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু নদী হিসেবে ‘সরস্বতী’র গুরুত্ব বিস্মৃতপ্রায়।গঙ্গা যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গম হিসেবে বর্তমান প্রয়াগরাজের ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নান করা পুণ্য বলে বিবেচিত হয়।ত্রিবেণীসঙ্গমে গঙ্গা যমুনার অস্তিত্ব দৃষ্টিগোচর হলেও সরস্বতীর অস্তিত্ব আজ শুধু ধর্মীয় আস্থার মধ্যেই সংকুচিত।


পৃথিবীর যে কোন প্রাচীন সভ্যতা নদীনির্ভর ছিল এবং নদীর উপর নির্ভরশীলতা থেকেই যে নদীগুলি ভারতবর্ষে কালক্রমে ‘মা’ এর মর্যাদা পেয়েছে তা সহজবোধ্য। বর্তমান ভারতবর্ষের নদী হিসেবে গঙ্গার গুরুত্ব বলাই বাহুল্য এবং বর্তমান সময়ে গঙ্গা ‘মা’ হিসেবে পূজিত হন।
বর্তমানে অদৃশ্য হলেও একটি নদীর মাতৃরূপ এতো গুরুত্ব সহকারে সারাদেশব্যাপী পূজিত হয় কিন্তু সেই নদীর উপর নির্ভরশীল সভ্যতা , এমনকি সেই নদীর ইতিহাস নিয়ে ইতিহাস বইগুলির নীরবতা অবাক করে।

ঋকবেদ সন্দেহাতীতভাবে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম গ্রন্থ। ঋকবেদের বিভিন্ন সুক্তে ৭০ বারের বেশি সরস্বতী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায় সেই তুলনায় গঙ্গা নদীর উল্লেখ আছে মাত্র একবার।এ থেকেই খকবেদীয় যুগে সরস্বতী নদীর গুরুত্ব বোঝা যায়।

ঋকবেদের দ্বিতীয় মন্ডলের ৪১ তম সুক্তের ১৬ তম ঋকে বলা হয়েছে—
অম্বিতমে নদিতমে দেবিতমে সরস্বতি।
অপ্রশস্তা ইব স্মসি প্রশস্তিমম্ব নসকৃধি ।।
অর্থাৎ -মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে সরস্বতি! আমরা সমৃদ্ধহীনের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধশালী করো।
নদী কে অন্নদাত্রী , বারিদাত্রী , সমৃদ্ধিদাত্রী হিসেবে বিভিন্ন ঋকে স্তুতি করেছেন ঋষি-কবিগণ। রোজকার জীবনের চাওয়া-পাওয়া জানিয়েছেন নদীরূপী ‘মা’ কে।

শুধু স্তুতি নয় বেদ,মনুস্মৃতি , মহাভারত সহ বিভিন্ন গ্ৰন্থে সরস্বতী নদীর অবস্থান ও গতিপথ বলা হয়েছে।
মনুস্মৃতি তে বলা হয়েছে,
সরস্বতীদৃষদ্বত্যোর্দে বনদ্যোৰ্যদন্তরম্‌।
তং দেবনিৰ্ম্মিতং দেশং ব্রহ্মাবৰ্ত্তং প্রচক্ষতে।।
অর্থাৎ ,সরস্বতী ও দৃষদ্বতী এই দুই প্রশস্ত দেবনদীর মধ্যস্থলে যে সকল দেবনির্মিত দেশ অর্থাৎ প্রশস্ত দেশ আছে, তাহাদিগকে ব্ৰহ্মাবৰ্ত্ত বলে।
বেদ রচিত হয়েছে ব্রক্ষ্মাবর্তে অর্থাৎ ব্রক্ষার ভূমি । কুরুক্ষেত্র থেকে ব্রক্ষ্মাবর্তের শুরু।
কুরুক্ষেত্রের উত্তরের সীমান্ত সরস্বতী নদী এবং দক্ষিণের সীমান্ত দৃষদ্বতী নদী।

শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা অনুযায়ী ,
পঞ্চ নদ্যঃ সরস্বতীমপি যন্তি সস্রোতসঃ। সরস্বতী তু পঞ্চধা সো দেশেহভবৎ সরিৎ ॥৩৪:১১
অর্থাৎ ,আপন সহায়িকা নদীসমূহের সাথে এই পঞ্চ নদী সরস্বতী নদীতে সঙ্গমিতা হয়েছে। পাঁচটি নদী আপন নাম ত্যাগ করে সরস্বতীর নাম ধারণ করে নিয়েছে।

ঋকবেদের দশম মন্ডলের ৭৫ তম সূক্তে বলা হয়েছে…

ইমং মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতি শুতুদ্রি স্তোমং সচতা পরুষ্ণ্যা।
অসিক্নয়া মরুদ্বৃধে বিতস্তয়ার্জীকীয়ে শৃণুহ্যা সুষোময়া॥
সূক্তের এই ঋকে পূর্ব থেকে পশ্চিম যথাক্রমে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী,শুতুদ্রী(শতদ্রু/শুতলেজ), পরুষ্ণী(রাবি,ইরাবতী),অসিক্নিয়(চেনাব,চন্দ্রভাগা), বিতস্তা(ঝিলম) , আর্জিকিয়(হারো) নদীগুলির নাম উল্লেখ করা হয়েছে যা এই সময়েও দৃশ্যমান একমাত্র সরস্বতী নদী ছাড়া। সরস্বতী নদী এই সূক্তে সুতলেজ(শতদ্রু) ও যমুনার মাঝে তৃতীয় নদী হিসেবে উল্লিখিত কিন্তু সেই সরস্বতী আজ নেই কেনো ?
হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার এর আগে সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব নিয়ে ইউরোপিয়ান ভূগোলবিদ ও ঐতিহাসিকদের মনে কোনো সংশয় ছিল না , সংশয়ের সৃষ্টি করা হলো পরিকল্পিতভাবে একটি মিথ্যাচার কে প্রশ্রয় দিতে।
১৭৮৮ সালে অবিভক্ত বাংলার Surveyor General , James Rennel তাঁর ‘Map of Hindoostan’ এ সরস্বতী নদীর গতিপথ দেখান।১৮১২ সালে Colonel James Tod রাজপুতানার(বর্তমান রাজস্থান) লোকগীতি তে মরুভূমিতে জনসংখ্যা কমার কারণ হিসেবে ঘাগ্গর(Ghaggar) নদীর শুকিয়ে যাওয়ার গাঁথার উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেন। ফ্রান্সের ভূগোলবিদ Louis Vivien de Saint-Martin ১৮৬০ এ প্রকাশিত ‘A Study on the geography and the primitive people of India’s North-West , According to Vedic hymns’ এ ইংরেজদের করা সার্ভে এবং বৈদিক সূক্তের সাহায্যে ঘাগ্গর নদী কে বেদে উল্লিখিত সরস্বতী বলে প্রকাশ করেন। এরপর আমাদের স্বাক্ষী Major F Mackenson , যিনি ডাক ব্যবস্থা ও সৈন্য চলাচলের জন্য হরিয়ানার সিরসা থেকে বর্তমান পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর পর্যন্ত একটি নতুন রাস্তার খোঁজ করছিলেন।Major খুঁজে পেলেন একটি শুকিয়ে যাওয়া নদীর গতিপথ । এরপর ১৮৯৩ সালে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর Surgeon-Major C.F Oldham তাঁর গবেষণাপত্র “The Saraswati and the lost river of Indian Desert” এ বলেন “Although the confluence (with the Ghaggar) is marked in our maps as Ghaggar , it was formerly the Saraswati , that name is still known amongst the people”.


যে ঘাগ্গর কে এখানে খকবেদীয় সরস্বতীর মূল নদীখাত বলে উল্লেখ করা হচ্ছে সেটি এখন একটি মরশুমি নদী।শিবালিক পর্বতমালা থেকে বেরিয়ে আসা মারকান্দ , সরসুতী ও চৌটাঙ(দৃষদ্বতী নদীর বর্তমান অবস্থা) ঘাগ্গর এর উপনদী গুলির মধ্যে অন‌্যতম।ঘাগ্গর হরিয়ানা থেকে রাজস্থানে প্রবেশ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।ঘাগ্গর এর নদীখাত পাকিস্তানে হাকরা নামের একটি মরশুমি নদীর(Seasonal River) সঙ্গে যুক্ত ,এই বিচ্ছিন্ন নদীখাত পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে যা নারা নামের একটি মরশুমি নদী তে পরিণত হয়ে থর মরুভূমি তে অদৃশ্য হয়ে যায়।
এই বিচ্ছিন্ন ঘাগ্গর-হাকরা-নারা নদীখাতকেই বৈদিক সরস্বতীর গতিপথ হিসেবে ইংরেজ শাসনামলে নিঃসংশয়ে বিভিন্ন মানচিত্র ও গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

এরপর হলো সেই বিখ্যাত খননকার্য যার ভুল ব্যাখ্যা ভারতবর্ষের সঠিক ইতিহাসকে এখনো পাঠ্যপুস্তক পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয়নি।

১৯২৪ সালে জন মার্শাল Illustrated London News এ ‘First Light on a Long-forgotten Civilization: New discoveries of an unknown Prehistoric past in India’ নামক গবেষণাপত্রে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর খননকার্য সংক্রান্ত তথ্য বিশ্বের সামনে আনেন।এর আগেই অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপীয় ও ভারতীয় ভাষার মধ্যে মিল ভাষাবিদদের নজরে আসে এবং এর উপর ভিত্তি করে ১৮৫০ সালে ম্যাক্স মূলার আর্য জাতির ধারণা কল্পনা করেন।হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর খননকার্য সম্পর্কে জানার পর বলা হলো আর্যরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর সভ্যতা ধ্বংস করে এবং বৈদিক সভ্যতার সূচনা করে যা আর্য-আক্রমণ তত্ত্ব নামে পরিচিত।
সিন্ধু নদীর পারে আবিষ্কৃত হওয়ায় হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো কে পরে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নাম দেওয়া হলো। কিন্তু এতদিনেও ‘বৈদিক সভ্যতা’র এমন কোনো ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় নি যা বৈদিক ও সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য কে স্পষ্ট রূপে তুলে ধরতে পারে।
সেসময় তথাকথিত ‘সিন্ধু সভ্যতা’র সময়কাল ৩০০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দ বলে বিবেচিত হয়েছিল অর্থাৎ যীশুর জন্মের প্রায় ৩০০০ বছর আগে।ম্যাক্স মূলার সহ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ নিজেদের উপাসনা-পদ্ধতি সংক্রান্ত বিশ্বাসে এতটাই আস্থাবান ছিলেন যে যীশুর জন্মের থেকে ৪০০০ বছর আগেও যে পৃথিবীতে কোনো সভ্যতা’র অস্তিত্ব থাকতে পারে তা তাদের কল্পনার অতীত ছিল। তাই বৈদিক সভ্যতা কে সিন্ধু সভ্যতার পরেই দেখাতে হতো।আর ভারতীয় ভাষার সঙ্গে ইউরোপীয় ভাষার মিল থাকায় যদি এটা মেনে নেওয়া যেতো যে ভারতীয় ভাষা থেকেই ইউরোপীয় ভাষাগুলি সৃষ্ট এবং ঋকবেদের সৃষ্টিকারী সভ্যতা সবথেকে প্রাচীন ও ভারতবর্ষেই এর সৃষ্টি তাহলে তা ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণের জাত্যাভিমানে এক বড় আঘাত হতো।
আর আর্যদের বহিরাগত দেখাতে পারলে মূলরূপে ভারতবর্ষের কোনো জাতির অস্তিত্ব থাকে না এবং বেদ সৃষ্টিকারী আর্য থেকে শুরু করে ভারত আক্রমণকারী গ্ৰীক , হুণ ,মোঘল ,ইংরেজ , পর্তুগিজ সবাই কে এক গোষ্ঠীভুক্ত করে দেওয়া যায় এবং ভারতবর্ষ কে প্রতিনিয়ত সাংস্কৃতিক দিক থেকে এক সদা পরিবর্তনশীল ভূখণ্ড হিসেবে তুলে ধরা যায়– যেনো এদেশের সৃষ্ট নিজস্ব কোনো সংস্কৃতিই নেই।এই ধরনের মিথ্যাচার ভারতীয়দের আপন সংস্কৃতি থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে শাসকের সংস্কৃতি কে আপন করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত করবে—এই ছিল পরিকল্পনা।

কিন্তু বেদ কে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বৈদিক সভ্যতার সময়কাল যদি প্রশ্নাতীতভাবে ‘সিন্ধু সভ্যতা’র কয়েক হাজার বছর আগের প্রমাণিত হয় তাহলে আর্য-আক্রমণ তত্ত্ব মুখ থুবড়ে পড়ে, এবং বেদভূমি ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও এক প্রাচীনতম সভ্য জাতি হিসেবে ভারতীয়দের জাতীয়তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
এই কারণেই আর্য-আক্রমণ তত্ত্ব কে নস্যাৎ করতে এবং ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক পরিচয় বিশ্বের সামনে প্রতিষ্ঠিত করতে ঋকবেদে উল্লিখিত সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব ও তার সময়কাল খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বেদে উল্লিখিত হিমালয় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত সুবিশাল সরস্বতী নদীর জীবন গাঁথা বৈদিক সভ্যতা তথা ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস।
খকবেদের সপ্তম মণ্ডলের ৯৫ সংখ্যক সূক্তের দ্বিতীয় ঋকে বলা হয়েছে…
একচেতৎ সরস্বতী নদীনাং শুচির্ য়তী গিরিভ্য আ সমুদ্রাৎ।(৭.৯৫.২)
অর্থাৎ এককভাবে জাগ্রত, শুদ্ধতম নদী, সরস্বতী পাহাড় থেকে সমুদ্রে প্রবাহিত হয়।
মহাভারতের বন পর্বে বলরামের তীর্থযাত্রা বর্ণনা করার সময় বিনাশন নামক স্থানে সরস্বতী নদীর অদৃশ্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ততো বিনশনং গছেন্নিয়তো নিয়মাশনঃ।
গচ্ছত্যন্তর্হিতা যত্র মরুপৃষ্ঠে সরস্বতী॥ (৮২:১১১)
(অর্থ:তারপরে, শৌচ-সন্তোষাদির নিয়ম অনুসরণ করে এবং নিয়মিত খাবার গ্রহণ করে, বিনশানতীর্থে যান, যেখানে মরুর পিঠে থাকা সরস্বতী অদৃশ্য রূপ নিয়ে প্রবাহিত হন।)
মহাভারতের সময়ের সরস্বতীর জলপ্রবাহ ঋকবেদের সময়ের সরস্বতীর প্রচন্ড প্রবাহ থেকে ক্ষীণ হয়ে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মহাভারতের বন পর্ব ও শল্য পর্বের বিভিন্ন শ্লোকে ক্ষীণস্রোতা সরস্বতীর বিভিন্ন স্থানে অদৃশ্য(বিনাশন) হয়ে আবার দৃশ্যমান(চমশোধ) হওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়।
খকবেদের সময় সরস্বতী নদী হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট একটি নিত্যবহ নদী কিন্তু মহাভারতের সময়ে এসে তা বৃষ্টির জলে পুষ্ট একটি মরশুমি নদী তে পরিণত হয়–খকবেদ , ব্রাক্ষণ ,রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি প্রাচীন গ্ৰন্থে সরস্বতীর এই ক্রমপরিবর্তন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হলেই বৈদিক সভ্যতার ঐতিহাসিকতা প্রমাণিত হয়। সরস্বতী সংক্রান্ত গবেষণার মূলতঃ দুটি দিক— এক শুকিয়ে যাওয়া নদীখাত কে সরস্বতীর নদীখাত বলে প্রমাণ করা এবং দুই সরস্বতী নদীর বিলুপ্ত হওয়ার কারণ ও তার সময়কাল।
কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন একটি নদী একদিন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায় না, বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে নদীকে জল সরবরাহকারী উপনদী গুলির নদীখাতের পরিবর্তন,ভূমিকম্প ,জলবায়ুর পরিবর্তন অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি নদীর রূপ ধীরে ধীরে পরিবর্তন করতে থাকে। সরস্বতী নদীর ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয় নি। সরস্বতী নদীর জীবন ইতিহাসের গবেষণার এক নিজস্ব ‘ইতিহাস’ আছে ।


স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল অমলেন্দু ঘোষ দেখলেন বহু সংখ্যক হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ শুকিয়ে যাওয়া ঘাগ্গর-হাকরা নদীখাতে অবস্থিত এবং তিনি বিভিন্ন স্থানে শুকিয়ে যাওয়া ঘাগ্গর(সরস্বতীর বর্তমান নদীখাত) এর ছবি তুললেন। শুরু হলো বৈজ্ঞানিকভাবে সরস্বতীর অস্তিত্ব প্রমাণের প্রয়াস।

এরপর এলো স্যাটেলাইটের যুগ। স্যাটেলাইটের সাহায্য তোলা ছবির মাধ্যমে শুকিয়ে যাওয়া নদীখাতের নীচে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি জানা গেলো এবং সেই থেকে বিভিন্ন সময়ে সরস্বতী ও তাঁর উপনদীগুলির প্রাচীন নদীখাতের(Paleo channels) বর্ণনা পাওয়া গেলো।১৯৮০ সালে নাসার(NASA) LANDSAT স্যাটেলাইট এবং পরে ভারতীয় স্যাটেলাইট IRS এর পাঠানো ছবি বিশ্লেষণ করে প্রাচীন নদীখাতগুলি আবিষ্কার করলেন পদ্মবিভূষণ প্রাপ্ত বিজ্ঞানী যশপাল ও অন্যান্যরা।
বিজ্ঞানীরা দেখলেন , সাতরানার পর থেকে ঘাগ্গর(আদি সরস্বতী) প্রায় ৮-৯ কিলোমিটার চওড়া হয়ে যায় তার কারণ যমুনা নদীর প্রাচীন নদীখাত এখানে এসে ঘাগ্গর এর সাথে যুক্ত হয়েছে। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি অনুযায়ী ,
উত্তরের দিকে বর্তমান শুতলেজ (শতদ্রু) নদীর প্রাচীন নদীখাত ঘাগ্গর এর সাথে যুক্ত ছিল। এখনো সাতলুজ(শতদ্রু)কে বর্তমান রোপাড়ের কাছে হঠাৎ করে পশ্চিম দিকে ঘুরে যেতে দেখা যায়।
অর্থাৎ প্রাচীন সরস্বতী নদীর প্রবাহ যমুনা ও শতদ্রু নদীর জলে পুষ্ট হতো।ভূতত্ত্ববিদদের মতে , উত্তর ভারতে টেকটনিক প্লেটের সরণের ফলে যে ভূমিকম্প হয় , তার ফলস্বরূপ শিবালিক পর্বতমালায় চির(Tear) ধরে এবং যমুনা নদী পূর্বদিকের খাতে সরে এসে গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হয়।

অন্যদিকে উপগ্ৰহ চিত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শতদ্রু নদীর গতিপথ পশ্চিমদিকে সরে সরস্বতী নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর একটি টেকটনিক প্লেটের সরণের ফলে শতদ্রু(শুতলেজ) , সিন্ধু নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়।
১৯৮৩-৮৫ সালে ভারত ও ফ্রান্সের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূতাত্ত্বিক দের একটি দল হরিয়ানা ও রাজস্থানের ঘাগ্গর ও চৌটাঙ(প্রাচীন দৃষদ্বতী) নদীর ধূসর পলি পরীক্ষা করে যমুনা ও শুতলেজ(শতদ্রু) এর পলির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রমাণ করেন।
সরস্বতী নদী যমুনা ও শতদ্রুর বয়ে আনা হিমালয়ের বরফগলা জল না পেয়ে বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল একটি নদীতে পরিণত হয়।বৃষ্টি কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার সরস্বতী ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে।
১৯৯৫ সালে BARC এর দুজন বিজ্ঞানী S M Rao ও K M Kulkarni রাজস্থানের বিভিন্ন অংশে প্রাচীন নদীখাতের উপরে কুয়ো খনন করেন এবং ৫০-৬০ মিটার গভীরে পর্যাপ্ত মিষ্টি জলের সন্ধান পান কিন্তু স্যাটেলাইটের ছবি অনুযায়ী বালির নীচে অবস্থিত নদীখাত থেকে ১০০ মিটার দূরের কুয়োর জল অতি অল্প এবং লবণাক্ত। তেজস্ক্রিয় ট্রিশিয়াম ডেটিং পদ্ধতিতে সেই জলের বয়স নির্ণয় করে জানা গেলো তা প্রায় ৫০০০-৭০০০ বছর আগের যেসময় সেখানে বৃষ্টিপাতের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
শুধু স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবির বিশ্লেষণ নয় , নদীখাতের গভীরে জমে থাকা জল ও পলির পরীক্ষা করে সরস্বতী নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও তার সময়কাল সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে।


সরস্বতী নদীর প্রাচীন নদী খাতের এই আবিষ্কার শুধুমাত্র বৈদিক সভ্যতার সঠিক ইতিহাস খুঁজে পেতেই গুরুত্বপূর্ণ নয় সরস্বতী-গবেষণা হরিয়ানার শুষ্ক অঞ্চল এবং রাজস্থানের বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চলের জল সমস্যা দূরীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ।গুজরাটের কচ্ছের রণে সরস্বতীর পুরনো নদীখাতের আবিষ্কার সেনা জওয়ানদের জলের অভাব পূরণ করবে।

সিন্ধু নদীর তীরে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হওয়ার পর ১৯৫৫ থেকে আজ অব্দি লোথাল , কালিবাঙ্গান , ধোলাভিড়া ,রাখিগাড়ি সহ প্রায় ২৭০০ স্থানে ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে যা মোট প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষের ৬০% এবং সরস্বতীর হারিয়ে যাওয়া নদীখাতের ধারে অবস্থিত।তাহলে এতদিন আমরা যাকে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নামে জেনে এসেছি তার নাম হওয়া উচিত ‘সরস্বতী-সিন্ধু সভ্যতা’ কারণ এই সভ্যতা মূলতঃ সরস্বতী নদীর উপর নির্ভরশীল এবং সরস্বতীর ধারেই গড়ে উঠেছিল।
সরস্বতী-সিন্ধু নদীর তীরের ধ্বংসাবশেষ কে বিশ্লেষণ করে একই ধরনের নগর পরিকল্পনা , রাস্তার এবং অন্যান্য নির্মাণের পরিমাপ , ওজন ও দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক শুল্ডসূত্র ,কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’ তে উল্লিখিত পরিমাপ ব্যবস্থার সঙ্গে মিলে যায়।প্রত্মতাত্ত্বিক বি বি লাল এর মতে কালিবাঙ্গানের ধ্বংসাবশেষে টেরাকোটার গৃহ নির্মাণের পদ্ধতি প্রায় ৪৫০০ বছর পরেও ঐ অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।’সরস্বতী-সিন্ধু’ সভ্যতায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ধার্মিক চিহ্ন যেমন স্বস্তিকা, যজ্ঞবেদী , অগ্নির উপাসনা , বিভিন্ন যোগাসনের মূর্তি বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে ‘সরস্বতী-সিন্ধু’ সভ্যতার পার্থক্যের সম্ভাবনা কে অকল্পনীয় করে তোলে। সাম্প্রতিক গবেষণা ভিরানা সহ একাধিক স্থান থেকে প্রাপ্ত শিল্পকর্মের রেডিও কার্বন ডেটিং প্রমাণ করে সরস্বতী-সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল প্রায় ৯০০০ বছর আগের। IIT Bombay ও PRL Ahmedabad এর গবেষণা অনুযায়ী এই সময়ে সরস্বতী নদী একটি বৃষ্টির জলে নির্ভরশীল নদীতে পরিণত হয়েছে । অর্থাৎ খকবেদে বর্ণিত হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট সরস্বতী নদীর এ অনেক পরের অবস্থা।’Science Report’ পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির মতে সরস্বতী নদী আজ থেকে প্রায় ৮০০০০ বছর থেকে ২০০০০ বছর আগে পর্যন্ত একটি নিত্যবহ নদী ছিল।এরপর শেষ হিমবাহ যুগের(Last Glacial Age) শুষ্কতার জন্য সরস্বতী নদীর জলপ্রবাহে টান পড়ে।তারপর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের জন্য সরস্বতী বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে নিজের শক্তি ফিরে পায়।
সরস্বতী নদীর জীবনকে প্রধানত পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়—
১) হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট নিত্যবহ ঋকবেদীয় সরস্বতী।
২) সরস্বতী নদী থেকে যমুনার বিচ্ছিন্ন হওয়া।
৩) সরস্বতী থেকে শতদ্রুর (শুতলেজ) বিচ্ছিন্ন হওয়া।
৪) অতিবৃষ্টির জন্য সরস্বতীর জলপ্রবাহ বৃদ্ধি যা আজ থেকে প্রায় ৯০০০-৪০০০ বছর আগের ঘটনা।
৫) এরপর শুষ্ক জলবায়ুর জন্য সরস্বতীর শুকিয়ে যাওয়া ও ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন জলাশয়ে বিভক্ত হয়ে অদৃশ্য হওয়ার।
সরস্বতীর জীবনের এই চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের মাঝেই ‘হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো’র সময়কাল নির্ধারিত হয়েছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনে অনাবৃষ্টির ফলে সরস্বতী নদী শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সরস্বতী-সিন্ধু সভ্যতার স্থানগুলিকে ক্রমশঃ উত্তর-পূর্বে সরতে দেখা যায়।

গবেষণা যত এগিয়েছে সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব এবং সরস্বতী নদীর উপর নির্ভরশীল বৈদিক সভ্যতার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। এরপরেও একশ্রেণীর ঐতিহাসিক নিজেদের মতাদর্শের বশবর্তী হয়ে সত্য স্বীকার করতে চান না , তারা পুরোনো আর্য-অনার্য তত্ত্বের পক্ষে হাস্যকর যুক্তি তুলে ধরেন। ভারতবর্ষের ১২০০০ বছরের থেকেও বেশি নিরবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক ও প্রমাণ সরস্বতী নদী। সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব ঋকবেদ,ব্রাক্ষ্মণ,রামায়ণ ও মহাভারত কে ভারতবর্ষের ইতিহাস হিসেবে প্রমাণ করে।যে নদীর ধারে বসে প্রাচীন ঋষিগণ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন গ্ৰন্থের শ্লোক রচনা করেছিলেন , শিল্প ও বিজ্ঞান চর্চা করেছিলেন , পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার ভীত তৈরি করেছিলেন সেই নদী যে ‘মা’ হিসেবে, ‘জ্ঞানের দেবী’ হিসেবে পূজিত হবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
সরস্বতী পূজা ; তাই বিশ্বের প্রাচীনতম ঐতিহ্যের , ভারতবর্ষের গৌরবময় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এবং এক সুস্পষ্ট জাতীয়তার উদযাপন।’মা’ সরস্বতীর এক হাতে ‘বেদ’ যেনো সেই সভ্যতা, তাঁর ইতিহাস ও জাতীয়তার প্রমাণ এবং অন্য হাতে সমস্ত বিভেদকামী মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যতান সৃষ্টিকারী ‘বীণা’।

তথ্যসূত্র :
১) THE LOST RIVER- On the trail of the SARASVATI by Michel Danino

২) The Sarasvati Civilisation: A Paradigm Shift in Ancient Indian History by G.D Bakshi

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.