৩০ শে জুন হুল দিবস, সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মরণ দিবস। ১৮৫৫ সালে ইংরেজ অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল সরল সাধাসিধে অথচ প্রাণশক্তির প্রাচুর্যে বলীয়ান এক ভারতীয় বনবাসী গোষ্ঠী; তারা লড়াই করেছিল গোলা-বন্দুকের বিরুদ্ধে, আগ্রাসী প্রবল এক শক্তির বিরুদ্ধে। যদি ভারতমাতার এই লড়াকু মানুষদের কাছে পর্যাপ্ত আধুনিক সমরাস্ত্র থাকতো, তাদের পূর্ব পরিকল্পনা থাকতো, তাহলে কিন্তু লড়াইয়ের ফলাফল উল্টো হত। যে বীর বিক্রমে সাঁওতাল বীরেরা সেই অসম লড়াই লড়েছিল, তারই স্মরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে হুল দিবস।
সাঁওতালরা প্রকৃতির সন্তান, ভারতবর্ষের বহু প্রাচীন অরণ্য-কেন্দ্রিক সভ্যতার এক নান্দনিক সৌকর্যের প্রকাশ। লেপাপোঁছা কুটির, সুঠাম-সুন্দর দেহসৌষ্ঠব, অরণ্যের নৈকট্য, প্রকৃতির সামীপ্য-সান্নিধ্য তাদের সম্পর্কে অনন্য অনুভূতি নিয়ে আসে৷ তবুও তাদের জীবনচর্যা, মানসচর্চা, লোকসংস্কৃতি, অরণ্য-সম্পৃক্তি নিয়ে আমরা কতটুকু জানি! সে এক বিস্তৃত আলোচনার পাঠ! প্রস্তুত-আলোচনায় আমরা কেবল এই গ্রুপের (ভারতীয় ক্রীড়াসঙ্ঘ) উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ একটি ক্ষুদ্র বিষয়ের অবতারণা করবো। সাঁওতালি শিকার ও রণনৃত্যে কতটা শারীরিক সক্ষমতার প্রকাশ।
সাঁওতালরা যে নাচের সংস্কৃতি এখনও জিইয়ে রেখেছেন, তা তিনটি ভাগে বিভক্ত। কিছু নাচ রয়েছে সামাজিক নাচ; যেমন প্রতিযোগিতামূলক ‘দং’-নৃত্য যা বিবাহ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। সামাজিক নাচের মধ্যে ‘লাগড়ে’-নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় উৎসব ও পালপার্বণে। সামাজিক নাচের মধ্যে আর রয়েছে ‘ঝিকা’-নৃত্য, যাতে জীবনের দুঃখ-বেদনা-অানন্দরূপের অনন্য প্রকাশ। এছাড়া রয়েছে ‘দাঁসায়’-নৃত্য, যা দুর্গাপূজার সময় অনুষ্ঠিত হয়। আর রয়েছে ‘ডাহার’-নৃত্য, যা একান্তই কুমারী-নাচ।
দ্বিতীয় ধরনের যে নাচ, তা হল ধর্মনৃত্য। যেমন — ‘বাহা’-নৃত্য, যা বসন্তকালীন বাহা পরবের সময় নাচা হয়; ‘করম’-নৃত্য, যা বর্ষাকালে করমপূজার সময় পরিবেশিত হয়; ‘মাঃ মঁড়ে’-নৃত্য, যা গ্রীষ্মকালে দেবতার ক্রোধ নিবারণের উদ্দেশ্যে মাদলের ছন্দে ছন্দে অনুষ্ঠিত হয়। নাচের যে তৃতীয় প্রকার, তা হল শিকার নৃত্য ও যুদ্ধনৃত্য। এরমধ্যেই তাদের সামগ্রিক শরীরচর্চা ও আত্মরক্ষার অনন্য বিস্তারণ। এই নৃত্যানুশীলনের মধ্যে তাদের আপন গোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও খাদ্য-অন্বেষণের সাফল্য লুকিয়ে থাকে। বনবাসী-সংস্কৃতি রক্ষার পরিমণ্ডলে আমরা যেন এই বিশেষ ধরনের নৃত্যগুলিকে কখনও ভুলে না যাই!
শিকার নাচের অন্যতম হল ‘দুঙ্গের’, যার আয়োজন ঘটে বনের অভ্যন্তরে, শিকারকে সফল করে তোলার এক মনোযোগের অধ্যয়নে, পারস্পরিক বোঝাপড়ার সুস্পষ্ট নান্দনিক প্রকাশে। সাঁওতাল সুঠাম পুরুষেরা একে অপরের কাঁধে হাত রেখে, ডাইনে-বামে সরে সরে, বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নেচে ওঠে। শিকারের আগে মানসিক প্রস্তুতি। সঙ্গে আদিবাসী -বাদ্য বেজে ওঠে ‘দেন্ দেন্, দেন্ দেন্, দেন্ দেন্….।’ এক সুবিস্তৃত অরণ্যভূমি কেঁপে কেঁপে ওঠে সেই বাদ্যে, বনে বনে পশুরা সচকিত হয়ে শুরু করে ছুটোছুটি। আর বনজ সৌন্দর্যের পরতে সাঁওতাল পুরুষের শিরায় শিরায় ছোটে অশান্ত শোণিত; পেশিতে পেশিতে বয়ে যায় তারই রোমাঞ্চ। লড়াই, লড়াই, লড়াই করেই এতকাল খাবার জুটেছে। একে অপরে সেই লড়াইয়ের বার্তা ছড়িয়ে যাচ্ছে সমবেত দৃঢ়তায়, গোষ্ঠী-ঐক্যের অনন্ত আভাষে। এই নৃত্যের তালে উদ্ভূত হয় এক বেপরোয়া মনন, আজ খাবার পেতেই হবে! আজ সমবেতভাবে আহার জুটবে।
আর একটি রণনৃত্য হল ‘পাদকন’, লাঠি নিয়ে এই দেহসৌষ্ঠবের নাচ। কখনও সেই লাঠি দেহের উপরে উঠে আসছে, কখনও নিচে নেমে আসছে অদ্ভূত কৌশলে, কখনও ঘুরে ঘুরে লাঠি নিয়ে নানান অঙ্গভঙ্গি, কখনও আক্রমণের দৃশ্য, কখনও প্রতি আক্রমণ। পুরো নাচটি জুড়েই সদা সক্রিয়তা, নিরন্তর চোখে চোখ রাখা। এই নৃত্যে তাই আত্মরক্ষার মেজাজটি অনুভূত হয়।
আজ এ সকল নৃত্যের মহড়া হারিয়ে যাচ্ছে বনবাসী জীবন থেকে। কিন্তু জীবনের নানান পথে চলতে গিয়ে, আক্রমণের মুখে সত্যের জন্য লড়তে গিয়ে তা জীবনবোধ থেকে বাদ দেওয়া চলে না। এইসব নাচ হাজার হাজার বছরের উত্তরাধিকার। এর মধ্যে রয়ে গেছে শরীর গঠনের এক অপরূপ কৌশল। সহজ সরল মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাদের আপন সংস্কৃতি থেকে উৎখাত করে ধর্মান্তকরণের প্রক্রিয়া যেখানে আজও জারি আছে, সেখানে এই যুদ্ধ নৃত্য বন্ধ করা কখনই উচিত নয়। তা বনবাসী সমাজকে ভেতর থেকে শক্তি জোগাবে। হে অরণ্যের সন্তান, তোমরা অনন্ত জীবনের দ্যোতক, অসীমকালে প্রসারিত তোমাদের সঙ্গীত ধ্বনি আজও মাদলের তালে তালে ভারতমাতার জয়ধ্বনি করে উঠুক। এই মহান দেশকে রক্ষার জন্য সাঁওতাল বিদ্রোহের পুণ্যপ্রভাত চির-ভাস্বর হয়ে থাকুক।
পাহাড়ে-জঙ্গলে
ভারতমাতার কোলে
বীর মাদলের ওই কী বাণী
শোনালে অঞ্চলে।
আমার বনবাসী
শ্রদ্ধা লও গো রাশি
কালোসোনার পরাণখানি
না যেন হয় বাসি।
বনের রক্ত বহে
ইতিহাস তারে কহে
অরণ্যজয় পায় কী রানী
লোকায়তিক দহে?
কল্যাণ গৌতম।