সন্ন্যাসী উপগুপ্ত

তবু তাঁর নির্জন বনভূমি বা অরণ্যবেষ্টিত পার্বত্যস্থান বিশেষ পছন্দের নয়৷ তপস্যার জন্যে গভীর,জনহীন অনন্তের মাঝে তিনি ধ্যান মগ্ন থাকেন ৷হিমালয়ের বরফাবৃত উচ্চ শিখরে চন্দ্রপ্রভার প্রতিফলন তার উজ্জ্বলতাকে আরও ভাস্বর করে তোলে৷উপগুপ্ত ধন,মান,যশ্ব-প্রত্যাশী নন৷প্রভুত্ব করার স্বাভাবিক প্রলোভনে তাঁর মন নেই৷ তিনি শুধু চান প্রতিটি জীবাত্মার মধ্যে জ্ঞানের আলোক প্রজ্বলিত করতে,অজ্ঞানতা-অসূয়াকে ধ্বংস করে৷

ধ্যান তাঁর অধ্যাবসায়, -ঠিক পেশাদার কোনো দক্ষ শ্রমিকের কর্মকুশলতার মতন৷ মাঝে মাঝে তাই বিশ্রামের প্রয়োজনে দীর্ঘ পদক্ষেপে হেঁটে চলেন জনালোকে৷চরৈবেতি-কালে তাঁর মনের অন্ধকার,সঙ্কীর্ণতা-সংশয় দূর হয়ে যায়৷ক্রোধহীন সাধুর অন্তর ভরে ওঠে প্রশান্তিতে৷ মাধুকরী জীবনে খুব অল্প চাল-আনাজ-ফল প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট হন৷যে অবস্থায়ই যে দেয়, আনন্দের সাথেই দানকৃত দ্রব্য তিনি গ্রহণ করেন৷চলতি পথে কোন গ্রামের পাশে বটগাছের নিচে বসে বিশ্রাম নেন৷ পাশেই মাঠ, রাখাল বালকেরা গাভী ছেড়ে দিয়ে তা – না -না রবে খেলায় মত্ত হয়৷ উপগুপ্ত তৃষিত নয়নে, পুলকিত হৃদয়ে সেই অপার্থিব দৃশ্য উপভোগ করেন৷ মধ্যাহ্নের বেলা শেষে আশ্রয় নেন কোন মন্দিরের বারান্দায়৷

একবার এমনই ভ্রমন বিলাস চলাকালীন তিনি খেয়াল করলেন আগের সেই চেনা বালকদের দেখা মিলছে না৷ শুনশান মাঠ একা পড়ে আছে৷ পায়ে চলার পথে অজস্র লতার জট বুঝিয়ে দেয়,অনেক দিন এ পথে কেউ আসেনি৷ অবাক সাধু দিব্যদৃষ্টিতে দেখলেন,এক কালসর্প মাঠের পাশে ডেরা বেঁধেছে৷ তার সর্ব অঙ্গে বিষ৷ খেলারত অনেক কিশোর এবং তাদের গোধন এই কালভূজের বিষে প্রাণ হারিয়েছে৷

বহুদিন পরে মানুষের পদধ্বনিতে সাপটিও নিজ গর্ত ছেড়ে দ্রুত ছুটে এসেছে সাধুকে ছোবল দেবার অভিপ্রায় নিয়ে৷ কাছে আসতেই সাধু নিজ দৈবশক্তি কাজে লাগিয়ে তার উদ্যত ফণাকে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন৷ তারপর তাকে হিংস্রতার বিপরীতে ভালবাসার মাহাত্য বুঝালেন৷ক্রমাগত সুমিষ্ট ভাষার যাদুতে সেই বিষধর সাধুর শিষ্যত্ব নিল৷ একই সাথে সে প্রতিজ্ঞা করল,আর কোনদিন সে কাউকে দংশন করবে না৷ চরম বিষধর,হেলে সাপ হয়ে গেল৷

পরের বছর সাধুর খুব ইচ্ছে হোল শিষ্যের খোঁজ নেবার৷ তিনি মাঠের প্রান্তে এসে শিষ্যের নামধরে ডাকলেন৷ বহু সময় অতিবাহিত হলে এক সময় সেই সাপটি গুরুর নিকটে এসে প্রনাম করল৷ উপগুপ্ত তার চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন৷ কোথায় সেই রাজকীয় চলন! চলার গমকে কালো দেহ থেকে ঝলসান বিদ্যুৎ রেখাই বা কোথায়! এই-ই কী তার সেই শিষ্য!দেহটা শুকিয়ে দড়ির মতন,মেরুদন্ডটা ভাঙা…৷তিনি অশ্রুসজল চোখে জানতে চাইলেন”তোমার এমন অবস্থা হোল কেন?”

সাপ থেমে থেমে কষ্ট করে জানাল, দরকার না হলে সে গর্ত থেকে বাইরে আসত না৷ তাকে দীর্ঘদিন না দেখতে পেয়ে ছেলেরাও আবার মাঠে ফিরে এল৷ তারা মনের আনন্দে খেলা শেষে ঘরে ফিরত৷ একদিন তারা সাপটিকে দেখতে পায়৷ বেলকাঠের তৈরি লাঠি ছিল তাদের হাতে৷ ঐ লাঠি দিয়েই নির্দয়ভাবে তাকে প্রহার করতে লাগল৷ ইচ্ছে করলেই সে কয়েকজনকে ছোবল দিতে পারত৷ গুরুর নিষেধ, আর নিজ প্রতিজ্ঞা তাকে সেই হিংসার কর্ম থেকে বিরত রেখেছে৷তাদের আঘাতকে পূজা মনে করে বালকদের সে ক্ষমা করে দিয়েছে..৷

উপগুপ্ত সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷তারপর শিষ্যের মস্তকে নিজ হাতখানি রেখে বললেন “বাবা!আমি তোমাকে দংশন করতে বারণ করেছি৷
ফোঁস করতে নয়!”

তপতি বাসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.