রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বর্তমান সরসঙ্ঘচালক মোহনরাও ভাগবত সংরক্ষণ নীতি নিয়ে মন্তব্য করায় জাতপাত ভিত্তিক ও ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি অযথা ‘হল্লাবোল’ শুরু করেছে। কেউ আবার হুমকি দিয়েছেন যে, সঙ্ঘ নাকি আগুন নিয়ে খেলছে। অযথা আবেগ এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত নিহিত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যুক্তিসঙ্গত ভাবে একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, সঙ্গত কারণেই তিনি এই মন্তব্য করেছেন।
স্বাধীনোত্তর ভারতে বাবাসাহেব আম্বেদকর সহ অন্যান্য বিচক্ষণ ব্যক্তিরা এই ভেবে সংবিধানে সংরক্ষণ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেন যে, সংরক্ষণের ফলে তপশিলি জাতি উপজাতির ধাপে ধাপে উত্তোরণ ঘটবে এবং পনেরো-কুড়ি বছর পর আর সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু এর মধ্যে গঙ্গা-গোদাবরী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ভারতে তখন কংগ্রেসই ছিল প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারি, তাঁর ক্ষমতা হারানো ইত্যাদি ঘটনার পর কংগ্রেস রাজনৈতিক অধিপত্য হারাতে থাকে এবং সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে থাকে জনসঙ্ঘ(বর্তমানে ভারতীয় জনতা পার্টি), দক্ষিণ ভারতের কিছু জাত্যাভিমানী দল, কমিউনিস্ট পার্টি, জনতা দল ইত্যাদি এবং এর পরিণতি স্বরূপ কেন্দ্রে জোট সরকার গঠিত হতে থাকে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি আর্থসামাজিক পরিবর্তনও ঘটতে থাকে –
১. আশির দশকে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী প্রায় ৫০% জনসংখ্যার একটা ভালো অংশই ছিল হতদরিদ্র এবং যাঁরা অধিকাংশই ছিলেন গ্রামে বসবাসকারী ও তপশিলি জাতি-উপজাতি ভুক্ত। শিক্ষা, সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের সুবাদে এই জনসংখ্যা নগন্য অংশই মধ্যবিত্ত ও সম্পন্ন শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার অনুকরণে গৃহীত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গতিও ধরন গ্রামীণ সমাজে উচ্চ ও অনুন্নত বর্গের মধ্যে ফাঁক তৈরি করে। পরম্পরাগত ভাবে বঞ্চিত বর্গ এবং মধ্যম ও উচ্চবর্গের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অভিভাবকসুলভ শোষণ। মত বিনিময় ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বঞ্চিতরা তখন উচ্ছ-মধ্যম বর্গের অভিভাবকত্ব বা পৃষ্ঠপোষকতায় শুধু আপত্তি বা অসন্তোষই ব্যক্ত করতে শুরু করেনি বরং তাদের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ প্রতিযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে।
পরিণতি স্বরূপ, গ্রামাঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক অভিভাবকত্ব বা পৃষ্ঠপোষকতা এবং শোষণের পরিবর্তে সংঘর্ষ ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ফলে গ্রামগুলি সামাজিক গোষ্ঠী থেকে রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
২. সবুজ বিপ্লব পরম্পরাগত কৃষকদের আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা সত্ত্বেও স্বাধীনতার আগে বা জমিদারি প্রথা বিলোপের আগে যেসব উচ্চবর্ণীয়রা তাঁদের জমিদার ছিল তাঁদের তুলনায় তাঁরা নিজেদেরকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বঞ্চিত বা পিছিয়ে পড়া মনে করতে থাকে। অর্থাৎ তাঁদের মনে হয় যে আর্থিকভাবে যথেষ্ট সম্পন্ন হলেও তাঁরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত শহুরে, আধুনিক ও উচ্চবর্গের মতো সামাজিক মর্যাদা পাচ্ছেন না। এই উঠতি মধ্যবিত্ত সম্পন্ন শ্রেণি একদিকে তাঁদের থেকে পিছিয়ে থাকা তথাকথিত অনগ্রসর, অতি-অনগ্রসর ও দলিতদের সঙ্গে শোষণ ও আধিপত্যের সম্পর্কে বিশ্বাসী। অন্যদিকে, উচ্চবর্গীয়দের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ প্রতিযোগিতায় আগ্রহী।
৩. শহুরে উদ্যোগপতি, ব্যবসায়ীদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে জাতিগত বা সম্প্রদায়গত বিশেষত্ব থাকায় পৃথক অস্তিত্ব বজায় থাকে। যেমন জৈন, পার্শি, সিন্ধ্রি, মারোয়াড়ি ইত্যাদি। স্বাধীনোত্তর ভারতে সবুজ বিপ্লবের ফলে উঠে আসা উপরোক্ত নতুন রাজনৈতিক ও আর্থিক অভিজাত বর্গ বিভিন্ন দক্ষতাভিত্তিক পেশা, প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত চাকরি(সরকারি ও বেসরকারি) সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ে। তাঁরা শিল্প ও ব্যবসাতেও পিছিয়ে পড়ে, কারণ ওই ক্ষেত্রগুলি জাত বা সম্প্রদায় ভিত্তিক এবং সেই পরম্পরা তাদের ছিল না(অবশ্য সামান্য কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে)।
[১,২,৩ বিশ্লেষণ সূত্র – সোশ্যাল চেঞ্জ ইন ইন্ডিয়া, যোগেন্দ্র সিং]
এরকম আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে শ্রীরামজন্মভূমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিজেপি’র যখন উত্থানপর্ব শুরু হয় এবং আসেতুহিমাচল হিন্দুসমাজ যখন জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামের নামে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে ঠিক সেই সময় ভি পি সিং হিন্দু ঐক্য বিনষ্ট করতে জাতপাতের রাজনীতিকে উস্কে দিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরার জন্য ধুলো ঝেড়ে ‘মন্ডল আয়োগ’-এর প্রতিবেদন বার করেন। ফলে জাতপাত ভিত্তিক বিভিন্ন দল যেমন সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল ইত্যাদি গঠিত হয় এবং তারা নির্বাচনী সাফল্যও পায়। কারণ, নতুন উঠতি গ্রামীণ সম্পন্ন বর্গ সামাজিক ও সরকারি স্তরে উচ্চবর্গীয়দের মতো কৌলিন্য ও মর্যাদা লাভের জন্য সংরক্ষণকেই আঁকড়ে ধরে এবং বিভিন্ন জাতের জন্য নতুন করে সংরক্ষণের দাবি করা দলগুলিকে ঢেলে সমর্থন দেয়।
সারাদেশে ঐক্য ও সংহতির পরিচায়ক ‘হিন্দুত্ব’ বা ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের’ ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ‘বিজেপি’র অগ্রগতি সংরক্ষণের প্রলোভন দেখিয়ে জাতপাতের বিভেদ উস্কে তখনকার মতো সম্ভব হয়। এবং তারপর থেকেই সংরক্ষণের মতো একটি নিখাদ সংবেদনশীল সামাজিক ব্যবস্থা হয়ে ওঠে শাসন ক্ষমতা দখলের এক রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। এছাড়াও, এই সংরক্ষণভিত্তিক জাতপাতের রাজনীতির ফলে – ১. ধাপে ধাপে উঠে যাওয়ার পরিবর্তে সংরক্ষণ ব্যবস্থা আরও গেড়ে বসেছে। ২. ‘কে বা আগে প্রাণ করিবেক দান’-এর মতো নতুন নতুন জাতিগোষ্ঠী নিজেদেরকে অনুন্নত, অনগ্রসর, অতি-অনগ্রসর বা দলিত শ্রেণির তালিকাভুক্ত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সংরক্ষণের দাবিতে গুর্জর, জাঠ, প্যাটেল, পাতিদারদের আন্দোলন এর সাম্প্রতিক নমুনা। ৩. সবাইকে তুষ্ট করার জন্য সংরক্ষণের হার বাড়তে বাড়তে অধিকাংশ রাজ্যে ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। ৪. হিন্দু সমাজের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী সংরক্ষণের সুবিধা পাচ্ছে দেখে ভোট ব্যবসায়ী কিছু রাজনৈতিক দল সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে মুসলমান খ্রিস্টানদের সংরক্ষণ দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছে।
এত কিছু সত্বেও, বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সামনে সংরক্ষণের মাধ্যমে যে ‘সুখের স্বর্গের’ স্বপ্ন তুলে ধরা হয়েছিল তা ব্যর্থ। কারণ- ১. সরকারি চাকরি দেশের মোট কর্মসংস্থানের তুলনায় খুবই কম হওয়ায় সংরক্ষণভুক্ত খুব কম মানুষই স্বাধীনোত্তর প্রায় ৭০ বছরের সংরক্ষণের ফলে লাভবান হয়েছেন। ২. প্রথমদিকে সংরক্ষণের সুবিধাপ্রাপ্তদের আর্থিক সামর্থ্য বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা নিজেদের সন্তানদের জন্য উন্নত ও ব্যয়বহুল শিক্ষা গৃহ শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থা করতে সমর্থ। যাঁরা পাননা তাঁদের সন্তানরা যেমন তেমন শিক্ষা পেয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুবিধাভোগীদের সন্তানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। ফলে সংরক্ষণের সুযোগ বংশপরম্পরায় সুবিধাভোগী তপশিলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এদেরকেই ‘ক্রিমি লেয়ার’ বলা হয়। ৩. বিশেষ ভাবে তপশিলি উপজাতি, তথাকথিত অতি অনগ্রসর, দলিতদের অধিকাংশই সংরক্ষণের সুযোগ পেতে গেলেও যে ন্যূনতম শিক্ষা ও যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন তাও অর্জন করতে পারে না। ফলে বছরের পর বছর বহু পথ শূন্য থেকে যায়। ৪. বর্তমান সময়ে সামাজিক মেলামেশা, মত বিনিময়, অসবর্ণ বিবাহ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ায় জাতপাতের বৈষম্য, বিভেদ আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে যদিও এখনও অনেক পথ বাকি। কিন্তু অন্যদিকে উন্নয়নের বৈষম্য বা অপ্রতুলতা জনসংখ্যার অত্যধিক চাপ এই প্রীতি ও সহাবস্থানের সম্পর্ককে বিষিয়ে দিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ ও সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি করছে। এক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতি ‘গোদের উপর বিষফোঁড়ার’ কাজ করছে ফলে চিত্র অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে- দরিদ্ররা সরকারের উন্নয়ন নীতি কে ধনীর পক্ষে বলে মনে করেন। মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্তরা পুঁজিপতিদের পক্ষে বলে মনে করেন।
এরকম অবস্থায় তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়রা আবার সংরক্ষণ নীতি কে তাঁদের উন্নতির পক্ষে বাধা বা বিপদ মনে করেন। তাঁরা মনে করছেন যে নিম্নবর্ণীয়দের জন্য অত্যধিক সংরক্ষণের ফলে তারা জীবনে কিছু করে উঠতে পারছেন না। জন্মসূত্রে উচ্চবর্ণীয় কিন্তু দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী সংরক্ষণের জন্য সরকারকে দোষ দেন এবং যাঁরা সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছেন তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে হতাশার গর্ভে তলিয়ে যান। ৫. মাত্রাতিরিক্ত সংরক্ষন রাজনৈতিক নেতৃবর্গ, সামাজিক কার্যকর্তা এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কিত সরকারি আধিকারিকদের মধ্যে এক ধরনের দায়সারা ভাবের জন্ম দিয়েছে যে, তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় ও দলিতরা কিছু শিখুক বা না শিখুক কোটায় তো তাঁদের চাকরি বাঁধা ফলে তাদের শিক্ষা গুণগতমানের উন্নয়নের জন্য এদের কোনও মাথা ব্যাথা নেই এবং রাজকোষের হাজার হাজার কোটি টাকা জলে যাচ্ছে বা নয়ছয় হচ্ছে। অন্যদিকে তাঁদের উন্নয়নের নামে বহু ‘এন জি ও’ দেশি-বিদেশি অনুদান নিয়ে বেশ রসেবশেই আছে বা মাওবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ কার্যকলাপ চালাচ্ছে। ৬. আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সংরক্ষণের সুবাদে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, আই আই টি-র মতো উচ্চশিক্ষায় নিম্নমেধাসম্পন্ন তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় বা দলিতরা সুযোগ তো পাচ্ছেন কিন্তু উচ্চশিক্ষার মূল পাঠক্রম তাঁরা অনেকেই আত্মস্থ করতে পারছেন না।
ফলে সেমিস্টারের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে অনেকেই পড়া ছেড়ে দিচ্ছেন বা ড্রপ আউট করছেন। সাম্প্রতিক এরকমই কিছু তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে ওই আসনগুলি ফাঁকা থেকে যাচ্ছে।
উপরোক্ত কারণগুলির জন্য মনে হয়, শীঘ্রই সরকারি স্তরে সমাজের সকল বর্গের মধ্যেকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিম্নোক্ত এক বা একাধিক বিকল্প গ্রহণ করে সংরক্ষণ বিষয়ে চূড়ান্ত বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
১। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধাপ্রাপ্ত দ্বিতীয় ও তদূর্ধ শ্রেণির আধিকারিক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাদের সন্তানরা সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন না।
২। জাতপাত ভিত্তিক সংরক্ষণ না রেখে আর্থিক ভাবে অনগ্রসরদের জন্য সংরক্ষণ চালু করা অথবা সংরক্ষণ তুলে আর্থিক ভাবে অনগ্রসরদের জন্য নিঃশুল্ক বা সামান্য শুল্কের বিনিময়ে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা। তাঁদেরকে যত্নসহকারে এমন ভাবে তৈরি করা যাতে সরকারি চাকরির ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে বেসরকারি ক্ষেত্রে যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হচ্ছে বা হবে, তাঁরা যেন উপযুক্ত হয়ে ওঠে এবং বেসরকারি ক্ষেত্রটি যেন উচ্চ বংশীয় মেধাসম্পন্ন ও ইতিমধ্যেই সংরক্ষণের সুবিধা পেয়ে প্রতিষ্ঠিত নিম্নবর্গীয়দের জন্য খোলা ময়দান হয়ে না দাঁড়ায়। অর্থাৎ অর্থের অভাবে কোনও মেধাবী ছাত্র যেন উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।
৩। যে সব পদের ক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষতা, মেধা প্রয়োজন সেসব পদ সংরক্ষণের বাইরে রাখা। যেমন- কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রথম শ্রেনির আধিকারিক (আই এ এস, আই পি এস), ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, গবেষক, উচ্চ মাধ্যমিক ও তদূর্ধ শিক্ষক ও অধ্যাপক। এর ফলে তাঁদের দ্বারা সম্পাদিত কাজের গুনগত মান উন্নত হবে। সরকারি কোষাগারের অর্থে অযোগ্য বাক্তিদের যোগ্যতার তুলনায় অনেক বেশি পারিশ্রমিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে না। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও মর্যাদা রক্ষিত হবে। কারণ, বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখায় যে অযোগ্য ব্যক্তি সংরক্ষণের সুযোগে উচ্চ পদে আসীন হয়েও নিম্ন পদস্থ কর্মচারীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা, মান্যতা না পাওয়ায় কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং পরিণামে সামগ্রিকভাবে কাজের গুণগত মান ও পরিমাণ (Quality and Quantity) যথোপযুক্ত হয় না। ফলে সরকারি অর্থের অপচয় হয়।
৪। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাহায্যে অসবর্ণ বিবাহে উৎসাহ দেওয়া। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে আজকের জাতপাতের রাজনীতির ক্ষমতায়নের ফলে উচ্চবর্গের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্গীয়রাও এখন নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখতেই গর্ববোধ করে। তাই তাঁরা অসবর্ণ বিবাহে সম্মত হতে চায় না। কারণ, নিম্নবর্গীয় রূপে সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ার সাথে নিজের জাতের জনসংখ্যাও অটুট রাখা যাতে গণতন্ত্রে যে অঞ্চলে যে জাত সংখ্যাগরিষ্ঠ-পঞ্চায়ত/পৌরসভা থেকে লোকসভা সর্বত্র তাঁরাই নির্বাচনে দাপট দেখাতে পারে। এ ব্যাপারে সংরক্ষণ নীতির পথিকৃৎ বাবাসাহেব আম্বেদকরও জাতিপ্রথার নিরসনে অসবর্ণ বিবাহের ওপরই সব থেকে জোর দিয়েছিলেন।
তিনি তাঁর ‘দি অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট’ প্রবন্ধে লেখেন – “ I am convinced that the real remedy is intermarriage. Fusion of blood can alone create the feeling of being kith and kin. Unless this feeling of kinship, of being kindred, becomes paramount, the separatists feeling – the feeling of being aliens – created by caste will not vanish … where society is already knit by other ties, marriage is an ordinary incident of life. But where society is cut asunder, marriage as a binding force becomes a matter of urgent necessity. The real remedy for breaking caste is intermarriage. Nothing else will serve as the solvent of caste,” অসবর্ণ বিবাহের মাধ্যমে জিনগত সংমিশ্রণের ফলে নিম্নবর্ণীয়দের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বংশগতির নিয়মে স্বাভাবিকভাবেই উন্নত প্রজাতির হবে এবং তাঁদের আর সংরক্ষণের দয়ায় চাকরির প্রয়োজন হবে না। অথচ আম্বেদকরের একনিষ্ঠ পূজারি বলে দাবি করা জাত-ভিত্তিক রাজনীতির কারবারিরা তাঁরই ভাবনাকে অপমান করে নিজেদের জাতিভূক্ত মানুষদের অসবর্ণ বিবাহে উৎসাহ দেন না যাতে জাতের নামে তাঁরা রাজনৈতিক মৌরসিপাট্টা বজায় রাখতে পারেন।
এসব দেখে এটা সহজেই অনুমেয় যে সংরক্ষণ তোলা বা কাটছাঁটের কোন সিদ্ধান্ত যদি সরকার নিতে চায় তবে দেশে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা হবে । জাঠ, গুর্জরদের আন্দোলনের নমুনা আমরা দেখেছি। সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করবে মুসলিম বিচ্ছন্নতাবাদী, মিশনারি ও মাওবাদী অর্থাৎ ‘3M’ দুষ্টচক্র। এখনই বিভিন্ন নির্বাচনে মুসলিম-দলিত, মুসলিম-যাদব জোট এসবেরই পূর্বলক্ষণ। তাই এই ‘অশনি সংকেত’-কে মাথায় রেখে দেশের কর্ণধারদের অবশ্যই ব্যতিক্রমী, কঠোর ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ ব্যাপারে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন পথিকৃৎ হতে পারেন। দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে সেখানে দুটি সম্ভাব্য পথ দেখা দিয়েছিল। একটি দাসপ্রথাকে মেনে নেওয়া এবং তার জন্য আমেরিকার বিভাজন। অন্যটি গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে আমেরিকাকে অখণ্ড রাখা এবং দাসপ্রথা বর্জন। লিঙ্কন নির্দ্বিধায় ঝুঁকিবহুল দ্বিতীয় পথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। পরিণামে আজ আমেরিকা অখন্ড এবং সেখানে দাসপ্রথাও নেই।
আশা করা যায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই (মোহনজীও সে কথাই বলেছেন) পথ বার হবে। আর যাঁরা আগুন নিয়ে খেলার হুমকি দেন তাঁদের জন্য তো চূড়ান্ত পর্যায়ে লিঙ্কনের উদাহরণই যথেষ্ট।