মহাত্মা গান্ধীর ভাবনা আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের আদর্শের মধ্যে অনেকটাই সাযুজ্য আছে। গান্ধীজির ভাবনার সম্পূর্ণটাই ছিল ভারতকেন্দ্রীক। আরএসএস–ও শাশ্বত ভারতের আদর্শকেই তুলে ধরতে চায়। ভারতের মূল শক্তি আধ্যাত্মিকতা। মহাত্মা গান্ধীও তাঁর জীবন, সাধনা আর বাণীর মাধ্যমে সেই আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমেই দেশের ‘সর্বোদয়’–এর চেষ্টা করেছেন। কেবলমাত্র ক্ষমতা পাওয়ার জন্য রাজনীতি নয়, সমাজের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের কাজটাই মুখ্য– এটাই ছিল মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষা। সত্যের প্রতিষ্ঠা, সত্যের রক্ষা আর জীবনের প্রতিপদে সত্যানুসরণ, এটাই তাঁর শিক্ষা ছিল।

ভারতবর্ষের হাজার হাজার বছরের সাধনার ধন হল অহিংসা। বাপুজি আধুনিক যুগে এর সার্থক রূপ দিয়েছেন। কেবল ভারতের শষ্যশ্যামলা নদীমাতৃক ভূমিতেই নয়, আফগানিস্তানের গিরিকন্দরেও যে একজন খান আবদুল গফ্ফর খান সীমান্ত গান্ধী হয়ে অহিংসার পথে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অটুট থাকতে পারেন, তা গান্ধীজি করে দেখিয়েছেন। ভারত স্বাবলম্বী হবে, আর স্বদেশী পদ্ধতিতেই হবে। এই স্বদেশী স্বাবলম্বনের উপর ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। ভারতবর্ষের মুনিঋষিরা আবহমান কাল থেকে ”সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে যন্তু নিরাময়া” বলে বিশ্বমঙ্গলের প্রার্থনা করেছেন। গান্ধীজির দেশপ্রেমও ছিল পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। তাই ১৯৬৩ সালে যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের ‘একাত্মতা স্তোত্র’ পুনঃরচনা করা হল তখন স্বাভাবিকভাবেই লোকমান্য তিলকের পরেই গান্ধীজির নাম এল। আজও সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক প্রতিদিন ‘তিলকো গান্ধীরাদ্রিতা’ বলে প্রাতঃস্মরণ করেন।

সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তাঁর বিপ্লবী জীবনের বেশ কিছুটা অংশ মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কেটেছে। কলকাতায় ডাক্তারি পড়ার সময় পুলিনবিহারী দাসের অনুশীলন সমিতি যেমন আকর্ষণ করেছিল তেমন লোকমান্য তিলক ও মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বও তাঁকে টেনেছিল। ১৯১৭ সালে তাঁর ডাক্তারির ইন্টার্নশিপ সম্পূর্ণ হয়েছিল। গান্ধীজির আহ্বানে সাড়া দিয়েই ড. হেডগেওয়ার ১৯২১ সালে কারাবরণ করেন।

১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ড. হেডগেওয়ার তাঁকে পূজ্যপুরুষ বলে সম্বোধন করেন। হেডগেওয়ারের ভাষায় গান্ধীজির কথায় ও কাজে কোনও অন্তর নেই। সেদিনের খদ্দরের পোষাক আর গান্ধীটুপি পরা যুবকটিই ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করলেন।

১৯২৯ সালের কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে যখন পূর্ণস্বরাজের ডাক এল তখন ডাক্তারজি ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রত্যেক শাখায় ভারতের তৎকালীন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে লবন সত্যাগ্রহ শুরু হল। ড.হেডগেওয়ার সত্যাগ্রহে অংশ নিলেন। গান্ধীজির নেতৃত্বে চলা স্বাধীনতা সংগ্রামের সামাজিক সংগঠন হিসাবে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা।

সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠিত কার্যকর্তা, সঙ্ঘচালক বা প্রচারক অনেক ঝুঁকি নিয়েও স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছেন, লড়াইয়ের সামগ্রী পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছেন। ডাক্তার হেডগেওয়ারের মতো নেতৃত্বের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু, ত্রৈলক্যনাথ বা রামভাউ রুইকরের যেমন সম্পর্ক ছিল তেমন সহজ সম্পর্ক ছিল মহাত্মা গান্ধীর।

নাগপুরের পাশেই ওয়ার্ধা। ওয়ার্ধাতে ১৯৩৪ সালে সঙ্ঘের এক বড় শিবির চলছিল। গান্ধীজি দেখতে গেলেন আরএসএস–এর শিক্ষাশিবির। সেদিন ডাক্তারজি ছিলেন না। গান্ধীজি শিবিরে এসেছেন শুনে তিনি দেখা করতে গেলেন বাপুজির সঙ্গে। অনেকক্ষণ আলোচনা করলেন আরএসএসের কাজকর্ম নিয়ে। ওয়ার্ধার এই সঙ্ঘদর্শন গান্ধীজিকে আপ্লুত করেছিল। বিশেষত সঙ্ঘের অনুশাসন আর জাতিভেদের বিরূদ্ধে সাফল্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, দেশভাগের পরেও গান্ধীজির সঙ্গে সহজ সরল সম্পর্ক ছিল আরএসএস–এর। স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লির ডাঙ্গিকলোনি মাঠে আরএসএস–এর প্রায় ৫০০ জন কার্যকর্তার একটি সভাতে বক্তব্য রেখেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। সেখানে তিনি বলেন, ”আমি ওয়ার্ধাতে বহুদিন আগে আরএসএস–এর একটি ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। তখন প্রতিষ্ঠাতা শ্রী হেডগেওয়ার জীবিত ছিলেন। শ্রী যমুনালাল বাজাজ আমাকে শিবির দেখতে নিয়ে গেছিলেন। আমি তাদের কঠোর অনুশাসন অস্পৃশ্যতামুক্ত ব্যবস্থা আর সরলতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম।” (কালেকটেড ওয়ার্কস অফ মহাত্মা গান্ধী, ভল্যুম ৮৯, পৃ: ১৯৩–১৯৪)।

আরএসএস–এর তদানীন্তন সরসঙ্ঘচালক গুরুজি গোলওয়ালকার গান্ধীজির মৃত্যুর দিনে চেন্নাইতে ছিলেন। এই অশুভ সংবাদ শোনার পরে তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ”দেশের কী দুর্ভাগ্য!” তিনি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল আর গান্ধীজির সবচেয়ে ছোট ছেলে দেবদাস গান্ধীকে টেলিগ্রাম করলেন। মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার নেহরুজি ও সর্দার প্যাটেলকে লিখিত শোকবার্তা পাঠালেন।

কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সালে নেহরুজির সরকার আরএসএস–কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। সরসঙ্ঘচালক গুরুজি গোলওয়ালকর গ্রেফতার হলেন। গ্রেফতার হলেন কুখ্যাত ”বেঙ্গল স্টেট প্রিজনারস অ্যাক্ট” আইনে। ভাগ্যের পরিহাস হল নেহেরুজি–ই একসময় একে ”কালা কানুন” বলেছিলেন।

গুরুজি গোলওয়ালকারকে ছ’মাস পরে একবার মুক্ত করে সঙ্গে সঙ্গে আবার গ্রেফতার করা হল। দেশজুড়ে শুরু হল সত্যাগ্রহ। ৭৭ হাজার স্বয়ংসেবক গ্রেফতার হয়েছিলেন। সরকার অনেক চেষ্টা করেও আরএসএস–এর বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার কোনও প্রমাণ পায়নি। ১৯৪৯ সালের ১২ জুলাই সঙ্ঘের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল।

১৯৬৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবার গান্ধীজিকে হত্যার উপর তদন্ত কমিশন বসালেন। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জেএল কাপুরের নেতৃত্বে এই কমিশন ১০১ জন সাক্ষী আর ৪০৭টি নথিপত্র দেখে রিপোর্ট তৈরি করল। রিপোর্টে বলা হল গান্ধীজির হত্যাকারীরা আরএসএস–এর সদস্য ছিল না। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এই রিপোর্টে আরও বলা হয় যে গান্ধী হত্যা তো দূরের কথা আরএসএস–এর কোনও নেতা মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে কোনও প্ররোচনামূলক ভাষণও দেননি।

এই কাপুর কমিশনকে দেওয়া বয়ানে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের এক অফিসার, আরএল ব্যানার্জি বলেন, গান্ধী হত্যার আগেও যদি আরএসএস নিষিদ্ধ হতো তাতেও কোনও লাভ হতো না, ”কারণ হত্যাকারীরা আরএসএস–এর সদস্য বলে প্রমাণ হয়নি, ওই সংগঠনেরও এই হত্যাকাণ্ডে কোনও হাত ছিল না।”

আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের কোনও আদালতে গান্ধী হত্যার জন্য আরএসএস দোষী প্রমাণিত হয়নি। তবু রাজনৈতিক কারণে অনেকে এই প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষের হত্যা নিয়ে আরএসএস কে জড়িয়ে ফায়দা তুলতে চায়। মহামান্য আদালত অনেকবার এই অন্যায় আচরণের জন্য ভর্ৎসনা করেছেন। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট এই ধরনের অপরিণত বক্তব্যের জন্য আরএসএস–এর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। এসবের পরেও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী দলের রাজ্য নেতৃত্বে থাকা কোনও দায়িত্ববান নেতা যখন আবার একই মিথ্যা কথা বলেন তখন তাদের বাধ্যবাধকতাটা বোঝা প্রয়োজন।

গান্ধীজির মতবাদ এবং বামপন্থা পরস্পর বিরোধী। বামপন্থীরা বিগত ৯০ বছরে ভারতের যে কয়েকজন প্রণম্য মহাপুরুষের সঙ্গে জঘন্য নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন, তার মধ্যে মহাত্মা গান্ধী অন্যতম। প্রথমেই আদর্শগত পার্থক্য। গান্ধীবাদের মূল ভিত্তিই হলো অহিংসা আর ভালোবাসা। কমিউনিজমের মূলেই হলো হিংসা আর ঘৃণা। যোসেফ স্তালিন বলেছিলেন, ”মৃত্যুই হল সব সমস্যার সমাধান, মানুষ না থাকলে সমস্যাও থাকবে না।” স্তালিন কেবল মুখেই বলেননি, করেও দেখিয়েছিলেন। ‘হলোডোমোর’ কথাটার ইউক্রেনীয় ভাষায় মানে হল না খেতে দিয়ে হত্যা করা। ১৯৩২–৩৩ সালে যোসেফ স্তালিনের সরকার নিজের দেশের ইউক্রেনবাসী ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলেছিল খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে সেই যোসেফ স্তালিন যাদের আদর্শ তারা গান্ধীজিকে সহ্য করতে পারে?

পরাধীন ভারতে গান্ধীজির নেতৃত্বের সবকটি আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন বামপন্থীরা। সবরমতি আশ্রম থেকে ডান্ডি পর্যন্ত ২৪০ কিলোমিটার লবন সত্যাগ্রহে কমিউনিস্ট পার্টি কোনও ভূমিকা নেয়নি। প্রকৃতপক্ষে ওই সময় থেকেই তারা গান্ধীজির বিরোধিতা করতে থাকেন। ১৯৪২ সালে যা প্রকাশ্যে এসে যায়। ৮ অগস্ট মহাত্মা গান্ধী মুম্বই থেকে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তার সক্রিয় বিরোধিতা করল। আছার সিং চিন্না মস্কো থেকে নির্দেশ নিয়ে এলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সবকিছুই জানা ছিল। গান্ধীজির ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন যার জন্য তিনি ‘মন্ত্রের সাধন বা শরীর পতন’–এর ব্রত নিয়েছিলেন, ইংরেজ সরকারকে খুশি করতে সেই আন্দোলনকে অবলীলায় ছুরি মারলেন পি সি যোশিরা।

বামপন্থী তাত্ত্বিকরা কখনও ভারতবর্ষকে বোঝার চেষ্টা করেনননি। মস্কোতে বৃষ্টি হলে তারা কলকাতায় তাড়াতাড়ি ছাতা খোলার চেষ্টা করেছেন। অপরদিকে মহাত্মা গান্ধীর চিন্তার সবটুকু জুড়ে ছিল ভারতবর্ষ। সেটা না বুঝলে গো–নির্ভর কৃষি, কুটীরশিল্পের অবদান বা অহিংসার অমিত শক্তিকে বোঝা সম্ভব নয়। তাই কমিউনিস্টরা গান্ধীজিকে সবসময় অসম্মান আর অসহযোগিতা করেছে।

গান্ধীজির প্রতি কমিউনিস্টদের চরম ঘৃণা ফুটে উঠেছে রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ গ্রন্থে। সফদর আখ্যানে সেই ঘৃণা ছত্রে ছত্রে প্রবাহিত। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রথম গণআন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তার প্রতীক ছিল চরকা। কিন্তু কমিউনিস্ট ব্যাখ্যাতে ”কল–কারখানার যুগ ছেড়ে তাঁর অতীতে ফিরে যাবার প্রচেষ্টা আমি প্রতিবিপ্লবী বিচ্যুতি মনে করি।” ‘সুমের’ আখ্যানে গান্ধীজির প্রতি ঘৃণার আরও স্পষ্ট উদগিরণ হয়েছে। ”সেবাগ্রাম থেকে প্রলম্বিত অন্ধকারে যে–সব সমাজবাদীদের অস্তিত্ব তাদের অভিভাবক শয়তান। হিটলারও নিজেকে সমাজবাদী বলে গান্ধীর চেলারাও।”

হে রাম!

জিষ্ণু বসু

লেখকসাহা ইনস্টিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ কর্মরত। বাংলায় প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস লেখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.