সব রাজনৈতিক দলে নিয়মিত ক্লাসের বন্দোবস্ত হোক

[ দলীয় নেতা-কর্মীদের সংযত করে পার্টির ভাবাদর্শে চালিত করা বর্তমানে সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছেই একটি চ্যালেঞ্জ। তাদের অনিয়ন্ত্রিত কাজ ও কথাবার্তায় দলের দুর্গতি বাড়ে। শাসকদল মানেই সদস্যরা মনে করেন যা-খুশি-তাই করার ছাড়পত্র! সামাল দিতে অনেক সময় পার্টির সুপ্রিমোকে বিবৃতি দিতে হয়। কাটমানি, সিণ্ডিকেট রাজের খেয়োখেয়ি আর গুণ্ডামি তো আছেই। পক্ষান্তরে বিরোধী দলগুলিকে আন্দোলনমুখী করা, জনগণের দাবীর সমর্থনে পথে নামানো মস্ত বড় সমস্যা। আড়মোড়া ভেঙে, নিষ্ক্রিয় সদস্যকে সক্রিয় করার উপযুক্ত পন্থা নিয়ে বিরোধী সব দলগুলিই চিন্তিত। সাইনবোর্ড-সর্বস্ব সংগঠনকে ময়দানে নামাতে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস এবং ইচ্ছাশক্তি। সব কিছুর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক শিক্ষা। প্রত্যেক দল তাই সমাজশিক্ষা এবং রাজনৈতিক বোধ গড়ে তুলতে নিয়মিত ক্লাসের বন্দোবস্ত করুক। ]

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন বঙ্গবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে। করোনা ও সন্ত্রাস – এ দু’য়ের আবহে মানুষ এমনিতেই তখন দিশেহারা। ভোটের ফল প্রকাশের পর অভূতপূর্ব দিশেহারা হল তখনকার সম্ভাবনাময় দল অর্থাৎ বর্তমানে বিরোধী আসনে বসা বিজেপির কর্মী ও সমর্থকেরা। বিধানসভা ভোটের আগে সেই দলের নেতা, কর্মী ও সমর্থক যে সংখ্যায় ছিল, গলায় উত্তরীয় এবং বুকে ব্যাজ পরে যত সংখ্যক নবাগত সদস্যরা পার্টি অফিসগুলিতে ভীড় করে থাকতেন, ভোটের পরে সেই অনুযায়ী বর্তমান শাসদলের অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক আগ্রাসন ও সন্ত্রাসকে বিন্দুমাত্র প্রতিহত করার সঙ্গবদ্ধ সাহস তারা দেখাতে পারেন নি। আসলে উপনিষদের ‘সংগঠন মন্ত্র’-টাই পাঠ করেন নি তাদের নেতা এবং কর্মীরা। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন তাদের অনেকই ছিল, সেই আবহ সত্ত্বেও তারা এক একজন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়েই ছিলেন। কিন্তু কেন? তার কারণ, কর্মীদের জমাট বাঁধিয়ে একত্রিত করার কৃত্য ও কৌশল তাদের পার্টিতে শেখানো হয় নি।

সংগঠন ও সরকার ভালোভাবে চালাতে গেলে সব দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের জন্য পার্টিসিপেটরি বা অংশগ্রহণীয় পলিটিক্যাল ক্লাস শুরু করা দরকার, দরকার কিছুটা কর্মশালা গোছের আয়োজনও। পার্টি চালানোর মেথোডোলজি শেখা দরকার, দরকার কিছুটা ম্যানেজমেন্টের ক্লাস। আন্তর্জাতিক, জাতীয়, রাজ্য ও স্থানীয় স্তরের ঘটনাবলীকে কীভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করতে হবে, কীভাবে বিবৃতি দিতে হবে এবং সেগুলো করবার জন্য কী কী মনে রাখতে হবে, সেটা অত্যন্ত জরুরি। মাস মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে তার দ্বারা পার্টির বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, তার আনুপূর্বিক খসড়া তৈরি করা দরকার। কেমন করে পার্টির বক্তব্য উপস্থাপন করতে হয়, দলীয় মীটিং করার আগে কী কী চেক লিস্ট বানাতে হবে, রেজোলিউশন কীভাবে লিখতে হবে, কার্যকর্তারা কীভাবে উপরমহলে রিপোর্ট পাঠাবেন, পার্টির তদন্ত কমিটির কাজ কীভাবে করতে হয়, নির্বাচন বিধি কী, জনপ্রতিনিধি হবার জন্য মনোনয়ন দিতে প্রার্থীর কী কী বিষয় পর্যালোচনা করা দরকার, মানুষ দলের কাছে কী চাইছে তার ফিডব্যাক কীভাবে নিতে হবে, নির্বাচনী ইস্তাহারের টেক্সট কীভাবে লিখতে হয়, জন সমাবেশে জনগণকে কীভাবে সম্ভাষণ করতে হয় ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয় দক্ষতার সঙ্গে করতে গেলে নিয়মিত পার্টি ক্লাসে যেতেই হবে৷ এই ক্লাসের পাঠ্যসূচী তৈরির জন্য উপরমহলে কর্মশালার আয়োজন করা দরকার৷ সময়ে সময়ে পাঠ্যসূচীতে সংযুক্তি-বিযুক্তিও করা দরকার। কোনো স্তরের কর্মীই যেন মনে না করেন, তিনি সর্বজ্ঞ, অজেয় এবং অপ্রতিরোধ্য; কাজেই ক্লাসের বাইরে থাকবেন। প্রশ্ন আসবে, ক্লাস করে কী হবে? সংগঠন কী এতে আদৌও বাড়বে? এক কথায় উত্তর হল, পার্টির ইতিহাস, ভাবাদর্শ, চিন্তাচেতনা, কৌশল, রূপক-চিহ্ন-সংকেত, এগিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি যদি দলীয় কর্মীর অন্তরে প্রবেশ করাতে হয়, তারও তো একটা মেথোডোলজি আছে! নিয়মিত পার্টি ক্লাস তা উপযোগী করে তুলবে।

প্রথমে যে কাজটি অবশ্যই করা উচিত, তা হল — নানান দলের মধ্যে দল-বদল করে আসা নেতাকর্মী যারা রয়েছেন, তাদের সেই দল মোতাবেক সংস্কারিত করা। তাদের দলীয় আদর্শ ও মনীষার সঙ্গে পরিচিতি ঘটানো, দলীয় ইতিহাস, প্রাককথন ও ক্রমপর্যায় জানানো, দলের সুদিন-দুর্দিনের পূর্বতন আনন্দ-বেদনায় জারিত করানো৷ দলীয় কর্মীর মুখে যেন শুনতে না হয়, “অমুক দাদার দল করি আমি।” “ওই দাদাকেই এখন সর্বোচ্চ নেতৃত্বে বসাতে হবে।” “আমি তার লোক”। না, দল সবার। দলে সকলেরই মতামতের মূল্য রয়েছে। একজন সাধারণ কর্মীও যেন যথাযথ ভাবে তার মতামত দলের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন।

দলে ‘ফিজিক্যালি আসা’ আর ‘মননে দল বাসা বাঁধা’ — এক নয়। হতেও পারে না। দলে ব্যক্তি বিশেষের কখনোই দলীয় প্রতির্স্পধী হয়ে ওঠার কথা নয়৷ যদি হয়, তবে দল ভেতরে ভেতরেই মরে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে।

বিভিন্ন দলের নেতা ও কর্মীদের সুসংগঠিত করতে এই মুহূর্তে কোনো পলিটিকাল ক্লাসের বন্দোবস্ত নেই, যতদূর জানি। কিন্তু এই পাঠের আশু প্রয়োজন। একজন নেতাকর্মী কী ভাষায়, কী নান্দনিকতায় কথা বলবেন, মানুষের সঙ্গে মিশবেন, তা সঠিকভাবে জানেন না অধিকাংশ দলের অধিকাংশ নেতারা। কোনো কোনো সম্ভাবনাময় দলের অনেক নেতা ও কর্মী দম্ভ ও আত্মম্ভরিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি; তাই তারা মানুষের কাছে পৌঁছাতেও পারেন নি। নতুন ভোটার, ফ্লোটিং ভোটার, পরিবর্তনকামী ভোটারকে প্রভাবিত করে দলীয় প্রতীকে মতদান করানোর জন্য নেতাকর্মীদের নিজেদের আগে তৈরি হতে হয়। নইলে অবৈধ পথের নেশা দেখিয়ে কর্মী আনতে গেলে, সেই দল ভেঙে পড়বে। নেতা হতে গেলে ধ্যান লাগে, রাজনৈতিক জ্ঞান লাগে, বিশ্বজগতকে জানা লাগে। কূপমণ্ডূক হয়ে আর যাইহোক আজকের দিনের গ্রহণযোগ্য নেতা হওয়া যায় না। যে দলকে মনে রাখতে হয়, বাকী সমস্ত দল একযোগে তাকে প্রতিহত করতে চাইছে, তার তো আলাদা প্রস্তুতি নিতেই হবে! একটা বৃহত্তর, জোরদার লড়াই চারিদিক থেকে তাকে করতে হবে। হাওয়াই ভেসে তো আর ভোট পাওয়া যাবে না! তারজন্য কনটিনিউয়াস পলিটিকাল এডুকেশন দরকার

প্রশ্ন আসবে, দলে কারা ক্লাস নেবেন? ওখানেও কী খেলা হবে! অন্য দল থেকে আসা শিক্ষাবিদদের দিয়ে ক্লাস করানোর ঝুঁকি অনেক। দলের নিজস্ব, নিবেদিত প্রবুদ্ধ ও চিন্তাশীল মানুষকে নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হবে নিজেদের মধ্যে বসে। নিত্যনতুন ন্যারেটিভ তৈরি করার জ্ঞান চাই, কাউন্টার ন্যারেটিভ রচনার হিম্মত চাই। তবে না নেতা! তবে না এমএলএ/এমপি! তাই সমস্ত দল নিয়মিত রাজনৈতিক শিক্ষার আয়োজন করুক; দুর্নীতি, কাটমানি, সিণ্ডিকেটরাজ ও ভোগদখলের প্রচেষ্টা বন্ধ হোক। দলীয় নীতি-আদর্শ ভেঙে কেউ যাতে যথেচ্ছাচার না করেন, তার শিক্ষা পাক দলের অভ্যন্তরেই। দলীয় সংস্কারের জন্য অশিক্ষা থাকলে চলে না। বিপরীত দল থেকে আসা নেতা পূর্বদর্শনজনিত মতাদর্শ এবং অশোভন-সংস্কার যেন সেই দলের নীতিনিষ্ঠ কর্মীদের ভেতরে অজান্তে প্রোথিত করে না দেন! এটা সবসময় খেয়াল রাখতে হবে দলে থাকা নেতাকর্মীদের। হয়তো অজান্তে, অনবধানেই এটা হয়ে যেতে পারে। না-জানাটা কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু জেনে নিয়ে নিজেকে দলের জন্য প্রস্তুত করাটাই ন্যায়। এই রাজনৈতিক ফিল্টার দলীয় নীতিশিক্ষা থেকে আসে, আত্মোপলব্ধি থেকে আসে।

সংগঠন কীভাবে করতে হয় তা কিছুটা শেখারও আছে। সংগঠক যদিও আপন সৌকর্যে নিজে থেকেই অন্তর্নিহিত কিছু গুণ নিয়ে জন্মান, পারিবারিক-সামাজিক ভাবে কিছুটা তৈরি হয়েই আসেন, তবুও তাদের ফাইন টিউনিং দরকার, বিশুদ্ধরূপ দরকার, দলীয় আদর্শে সম্পৃক্ত হওয়া দরকার। অনেকেরই ভারতবোধ নেই; নেই ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম সম্পর্কে পরিস্কার ধ্যান ধারণা। নেই ভারতীয় সংবিধান সম্পর্কে ধারণা, সংসদীয় গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক পাঠ। দরকারে মক পার্লামেন্ট, মক অ্যাসেম্বলী, পুর অধিবেশনের খেলাঘর বসিয়ে প্র্যাক্টিকাল শিক্ষা দেওয়া হোক দলীয় কর্মীদের। ভোট পরিচালনা কীভাবে করতে হয়, কোন কোন বিষয় খেয়াল রাখতে হয়, কোন বিষয়ে অভিযোগ জানাতে হয়, কবে/কোথায়/কেন, তা যেন দলীয় নেতাকর্মীর জানা থাকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দলীয় প্রতিনিধি কীভাবে আলোচনায় বসবেন, কথা বলবেন, তা নিয়ে দলীয় শিক্ষা ও কর্মশালার যেন ব্যবস্থা থাকে।

কোনো দল যখন পাওয়ারে নেই, তখন নানান কর্মীদের কী কী কাজে ব্যাপৃত রাখা উচিত — বিশেষ করে শিক্ষক-অধ্যাপক, গবেষক, ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের — দলের সংশ্লিষ্ট নেতাদের তা জানা উচিত। সমস্ত স্তরের পার্টি অফিসে নিয়মিত বিষয় ভিত্তিক আলোচনা রাখা উচিত। সকলকে পড়াশোনা করে আসতে বলা উচিত। দলের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়মিত টাস্ক দেওয়া ও তার পর্যালোচনা করা উচিত। বৃহৎ পরিকল্পনা রচনা করার শিক্ষা না থাকলে, তা রচনা করতে এবং রূপায়ণ করতে তারা অসমর্থ্য হবেন। ক্ষমতায় এলেও আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা চলে আসবে। আমলাদের হাতের পুতুল হয়ে থাকা কোনো দলেরই ভালো লক্ষণ নয়। তাতে আগের দলের জের চলে আসে, তাতে পূর্ব দলের নীতির পুনরালোচনাই হয়। জনগণ বুঝতে পারেন না, নতুন দলটা কোন দিক থেকে আলাদা। নতুন সরকার কোন বিশেষ নীতি অবলম্বন করছেন।

দলীয় নেতাকর্মীদের নানান বিষয়ে সমীক্ষা করা শিখতে হবে, সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলের বিশ্লেষণ করতে শিখতে হবে। পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলিতে বুথ-ভিত্তিক দলীয় ভোটের হ্রাসবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্লেষণ করার মধ্যেও অনেক অজানা বিষয় বেরিয়ে আসে। এটা না জানলে সমীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনের পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হবে না; সমীক্ষা-দুর্নীতি প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।

দু’বছর আগে দেশজুড়ে রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীর জন্মশতবর্ষ পালিত হয়েছে। সকল দলেরই তাঁর সাংগঠনিক মণিমাণিক্যগুলি গ্রহণ করা দরকার। এক সংগঠন থেকে অন্য সংগঠনে কোনো ব্যক্তি যোগদান করলে সংগঠন তার সম্পর্কে কী দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করবে, তার শিক্ষা রাজনৈতিক কর্মী সমর্থকদের গ্রহণ করা উচিত। দল বৃহত্তর অর্থে একটি কুসুমোদ্যান, মালঞ্চ৷ ফসলের জমিতে আগাছা বাছার শিক্ষা চাই! তাই পার্টিকর্মীদের জন্য নিয়মিত রাজনৈতিক ক্লাসের বন্দোবস্ত হোক। মননশীল, ক্ষুরধার মেধার রাজনৈতিক ও বিষয়-ভিত্তিক শিক্ষকদের কর্মশালা বসিয়ে লেসেন-প্ল্যান বানানো হোক। রাজ্য জুড়ে সব দলেরই ‘স্কুল অফ থট’ গড়ে উঠুক। দলীয় কর্মীকে ধরে রাখা, তাদের সুখে দুঃখে পাশে থাকা, মেধাবী, প্রবুদ্ধ ও সৎ মানুষকে দলে ধরে রাখার শিক্ষা জরুরি, আগে তা খুঁজুক সমস্ত দল। এতে দেশের ও দশেরও মঙ্গল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা প্রবল ধাক্কা। সব দলের অন্তরঙ্গ সমর্থকরাই দেখতে চান, তার দল গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতি মেনে চলছে, সরকারে জনগণের জন্য কাজ করছে।

কল্যাণ গৌতম
…………………………………………………………………….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.