নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণীকে নিক্ষিপ্ত লোষ্ট্র যেমন আলোড়িত করে তোলে সেরকমই সরকারের কোনও কোনও সিদ্ধান্ত অনেক সময় দেশের সংবাদমাধ্যম ও জনমানসকে আলোড়িত করে তোলে। সম্প্রতি ভারত সরকার আরসিইপি নামাঙ্কিত এক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে পিছিয়ে এসেছে। দেশের সংবাদমাধ্যম ও জনমানস বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে আলোড়িত। আরসিইপি কী ? দেশের অর্থনীতির উত্থান পতনে তার ভূমিকাই বা কতটা? জনমনে এই প্রশ্ন আজ সদাজাগ্রত।
আরসিইপি (R.C.E.P.বা Regional comprehensive economic partnership) 2607 সম্ভাব্য ষোলোটি দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হলো ১৬টি দেশের মধ্যে একটি সুসংহত বাজার তৈরি করা। এর ফলে এই দেশগুলির উৎপাদিত পণ্য এবং পরিষেবা অন্য দেশে পাওয়া সহজতর হবে। এই ষোলোটি দেশের মধ্যে আসিয়ানের অন্তর্ভুক্ত দশটি দেশ আছে, দেশগুলি হলো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রনেই, ভিয়েতনাম, লাওস, মায়ানমার, কম্বোডিয়া। এছাড়া আরও যে ছটি দেশ এর মধ্যে বর্তমান সেগুলি হল জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত ও চীন। এই ষোলোটি দেশের মিলিত জনসংখ্যা ৩৪০ কোটি যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ আর ক্রয়ক্ষমতার সূচক (পারচেজিং পাওয়ার ক্যাপাসিটি) অনুযায়ী এই ষোলোটি দেশের মিলিত জিডিপি হলো ৪৯.৩ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার যা বিশ্বের মোট জিডিপি-র ৩৯ শতাংশ এবং মোট বিশ্ববাণিজ্যের ৩০ শতাংশ। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে কম্বোডিয়াতে আয়োজিত শীর্ষ সম্মেলনের তত্ত্বাবধানে প্রথম এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আনা হয়েছিল। এই চুক্তির নিয়মানুসারে উক্ত ১৬টি দেশ থেকে আসা পণ্য ও পরিষেবার ওপর ইমপোর্ট ট্যাক্স অত্যন্ত কম এবং কখনও কখনও শূন্য করে দেওয়া হবে।
বর্তমানে যে কোনো দেশ থেকে ভারতে যখন কোনো পণ্য আমদানি হয় তখন সেই পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক এবং কখনও কখনও অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি দিতে হয়। তা সত্ত্বেও চীন তার আগ্রাসী অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে ভারতের বাজারকে গ্রাস করে ফেলতে উদ্যত। এমনিতেই বর্তমানে চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বছরে চার লক্ষ কোটি টাকার কিছু বেশি। বর্তমানে শুল্কের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও চোরাপথে ভারতের বাজারে অনুপ্রবেশ করেই চীন বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করে ফেলেছে। আরসিইপি-মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আশ্রয় পেলে চীন ভারতের বাজারকে সম্পূর্ণ ভাসিয়ে দিত তার সস্তায় উৎপন্ন ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যাদির দ্বারা। অপরদিকে জাপান প্রযুক্তিবিদ্যায় ভারত থেকে অনেক উন্নত, তারা উন্নত প্রযুক্তির ভোগ্য সামগ্রী নির্মাণ করে সেই ভোগ্য সামগ্রী দ্বারা ভারতের উচ্চবিত্ত বাজারটি সম্পূর্ণ দখল করে ফেলত। এক্ষেত্রে জাপানের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়াও সমানতালে পা ফেলত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী এই দুই দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রযুক্তিবিদ্যায় বর্তমানে গোটা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এবং ইউরোপ ও ইউরোপের এককালীন প্রযুক্তিবিদ্যার শ্রেষ্ঠ দেশ জার্মানি এমনকী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত প্রযুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত উৎপাদিত সামগ্রীর লড়াইয়ে এদের সঙ্গে পেরে উঠবে না, সেখানে আমাদের দেশের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ শিল্পগুলির কী হাল হতো এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তা বলাই বাহুল্য। শিল্পের ওপর নির্ভরশীল দেশের কুড়ি শতাংশ মানুষ (সংখ্যায় প্রায় পঁচিশ কোটি) জীবিকাচ্যুত হতেন। অপরদিকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এই দেশগুলি পশুপালনে উন্নত। তার নানাবিধ কারণও আছে। অস্ট্রেলিয়ার আয়তন ৭৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা মাত্র দু’কোটি, সেখানে ভারতের আয়তন ৩৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। অস্ট্রেলিয়ার আয়তন ভারতের আড়াই গুণ আর জনসংখ্যা মাত্র ৬৫ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ এ কথা বলা যায় অস্ট্রেলিয়ায় বহু জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। ফাকা জায়গা থাকার কারণে সেখানে প্রচুর পশুচারণভূমি পাওয়া যায় এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পশুখাদ্য অনেক বেশি। পাওয়া যায়। পশুপালনের মাথাপিছু খরচ তাই সেখানে অনেক কম। ফলে পশুপালন করা সেখানে তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। সেজন্য মাথাপিছু পশুর সংখ্যা সেখানে অনেক বেশি। পক্ষান্তরে জনবহুল ভারতে তুলনামূলকভাবে পশুচারণভূমি এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পশুখাদ্য অনেক কম, তাই পশুপালনের মাথাপিছু খরচ ভারতে বেশি। মাথাপিছু পশুর সংখ্যাও তাই ভারতে কম। দুগ্ধজাত বা পালিত পশুজাত অন্যান্য দ্রব্যের দাম ভারতে অনেক বেশি। আরসিইপি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বলে বলীয়ান অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের পশুপালকরা যদি ভারতের বাজারে নিঃশুল্ক অবস্থায় প্রবেশ করে তাহলে ভারতের ১০ কোটি পশুপালক তাদের বাজার হারাবে ও কর্মচ্যুত হবে।
বিপদের এখানেই শেষ নয়। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রুনেই, ভিয়েতনাম, লাওস, মায়ানমার, কম্বোডিয়া আসিয়ানের এই দশটি দেশ কৃষিতে অত্যন্ত উন্নত। তাদের উৎপন্ন সস্তার ফসল নিয়ে তারা বিশ্বের যে কোনো বাজার দখলে মরিয়া। তাদের হাত থেকে নিজেদের কৃষকদের রক্ষা করার জন্য উদার অর্থনীতির প্রবক্তা পশ্চিমি দেশগুলি এমনকী WTO পর্যন্ত এই দেশগুলির ফসলকে তাদের মুক্ত বাণিজ্যের আওতায় আনেনি। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে এই দেশগুলি যদি ভারতের বাজারে প্রবেশ করতো তাহলে ভারতের কৃষিক্ষেত্র সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো এবং কৃষির ওপর নির্ভরশীল দেশের ষাট শতাংশ মানুষ (সংখ্যায় প্রায় আশি কোটি) জীবিকাচ্যুত হতেন। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায়, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর হলে ভারতের কৃষি, পশুপালন ও শিল্পের ওপর নির্ভরশীল প্রায় একশো কোটি মানুষের জীবন সংকটাপন্ন হতো। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পক্ষাবলম্বীদের বক্তব্য ছিল ভারতের পরিষেবা ক্ষেত্র এর ফলে বিস্তৃত বাজার পেয়ে লাভবান হবে। একথা সত্য যে উপরোক্ত দেশগুলির তুলনায় ভারত পরিষেবা ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। তাই চুক্তির ফলে ভারত পরিষেবা ক্ষেত্রে এক বিস্তৃত বাজার পেতে পারতো। কিন্তু পরিষেবা ক্ষেত্র যেহেতু বস্তুনির্ভর নয় বরং মানুষনির্ভর, তাই পরিষেবা ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড়াও অন্যান্য নানান পদ্ধতির দ্বারা (যেমন পাসপোর্ট ভিসায় লাগাম দেওয়া ইত্যাদি) অন্য দেশগুলি ভারতকে আটকে দিতে পারতো। তাছাড়া পরিষেবা ক্ষেত্রের ওপর নির্ভরশীল মাত্র কুড়ি শতাংশ। তিরিশ কোটি লোকের সুবিধার জন্য বাকি একশো কোটি মানুষের অসুবিধার সৃষ্টি করা অর্থনৈতিক দূরদর্শিতার নিদর্শন নয়।
মনমোহন সরকার অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে আরসিইপিতে গিয়েছিলেন। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব ছিল সেই ভুলের স্থালন করা। প্রথম দিকে বর্তমান সরকারও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল আরসিইপি নিয়ে, কিন্তু স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ আর সিইপির বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই আন্দোলনরত ছিল। অবশেষে ভারত ভাগ্যবিধাতা সঠিক পথাবলম্বন করলেন, সরকার পিছিয়ে এল আরসিইপির থেকে। দেশ রক্ষা পেল ভয়ংকর অর্থনৈতিক বিনাশের হাত থেকে।
অম্লান কুসুম ঘোষ
2019-11-15