পুরীর রথের কথা সবাই জানে। সারা ভারতব্যাপী তা বিখ্যাত, কিন্তু শ্রীক্ষেত্রের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার
শ্রীরামপুরস্থ জনপদ
মাহেশেও রয়েছে এক প্রাচীন মহাপ্রভুর মন্দির ও রথ যাত্রার ইতিহাস। মাহেশের রথ যাত্রার উল্লেখ রয়েছে সাহিত্য সম্রাট শ্রী বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী উপন্যাসে । শোনা যায় ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ এসেছিলেন এই রথযাত্রায়। আজ পবিত্র রথযাত্রার দিনে আসুন, আমরা জানি মাহেশের সেই প্রাচীন মহাপ্রভু মন্দির ও সেখানকার রথ যাত্রার কথা।
মাহেশ জনপদের অবস্থান পবিত্র গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তটে। গঙ্গার দক্ষিণ তট কাশী সদৃশ্ । এই বিশ্বাস নিয়েই এখানে গড়ে ওঠে বৈষ্ণবদের বাসস্থান। এখানে পূর্বে থেকেই বাস ছিল কিরাত, ধীবর, কৈবর্তদের । এনারা ছিলেন ভোলানাথ শিবের উপাসক। নদীয়া নবদ্বীপের বৈষ্ণবরা এই এলাকাতেই বসবাস শুরু করেন । বসবাসের কেন্দ্র ছিল মাহেশের লক্ষ্মী ঘাট বন্দর কারণ নদীপথে চলত ব্যবসা-বাণিজ্য। এই লক্ষ্মী ঘাট বন্দর আজও বর্তমান।
মাহেশের মহাপ্রভু শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের যে বিগ্রহ রয়েছে তার প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্রী ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী মহাশয়। কথিত আছে একবার তিনি পুরীতে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের দর্শনে যান, কিন্তু সেখানকার পান্ডারা তাঁকে বিতারিত করেন। এরপর তিনি স্বপ্নাদেশ পান যে ভাগীরথীর
পশ্চিমঘাটে নিমজ্জিত অবস্থায় তিনটি নিস্তব্ খন্ড দেখতে পাওয়া যাবে। স্বপ্নাদেশে তার থেকেই শ্রী শ্রী জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার ত্রিমূর্তি তৈরি করে মাহেশে নিত্য সেবার ব্যবস্থা করতে বলা বলা হয়েছিল। এরপর শ্রী ধ্রুবানন্দজী কঠিন সাধনা ও শক্তি প্রয়োগ করে কাষ্ঠখন্ড ত্রয় কে নদী থেকে উদ্ধার করেন এবং এক দক্ষ সূত্রধরের সাহায্যে মহাপ্রভু, বলভদ্র ও সুভদ্রার বিগ্রহ তৈরি করেন l আনুমানিক ৯৯৯ শকাব্দ তে গঙ্গার তীরে কুঁড়েঘরের মন্দিরের মধ্যে নিত্য সেবার ব্যবস্থা হয়।
মাহেশের বর্তমান মন্দিরগাত্রে লিখিত আছে। ‘শ্রীপাদ মাহেশের শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের প্রথম সেবাইত, দ্বাপর যুগের ব্রজধাম এর পঞ্চম গোপাল ও শ্রীমৎ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ শ্রীল শ্রী কমলাকর পিপলাই চক্রবর্তী ।’
তাঁর জন্ম ১৪১৪ শকাব্দ তে, মাহেশে আগমন ও জগন্নাথ দেবের সেবায় নিযুক্তি ১৪৫৫ শকাব্দ তে। মাহেশের অন্যতম লেখক শ্রী গোবিন্দ পরিডার মতে প্রভুপাদ কমলাকর ছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ বৈষ্ণব রাজা শ্রী করের প্রথম পুত্র l তিনি ছিলেন নবদ্বীপে ন্যায় শাস্ত্রের অধ্যাপক। মিথিলা থেকে তিনি ন্যায় শাস্ত্র অধ্যায়ন করেছিলেন l নবদ্বীপে তিনি মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেবের সংস্পর্শে আসেন এবং চৈতন্য প্রেমে ভেসে যান। শ্রী চৈতন্যদেব পুরী যাবার পথে কমলাকরকে মাহেশের ধ্রুবানন্দজী প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথদেবের সেবার ভার দিয়ে যান। শ্রীচৈতন্যদেবের নির্দেশে তিনি শ্রী ধ্রুবানন্দ জীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন এবং হরিপ্রিয়া কে বিবাহ করে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের প্রথম সেবাইত রূপে মাহেশে বসবাস শুরু করেন l তার উত্তর পুরুষরা চক্রবর্তী বংশীয় l
১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দ । মুর্শিদাবাদের নবাব ওয়ালিশ খান গঙ্গা পথে নৌকা করে যাচ্ছিলেন সুতানটির বিখ্যাত কবিরাজের নিকট, তাঁর একমাত্র অসুস্থ কন্যাকে দেখাতে। পথিমধ্যে তার কন্যা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখনকার সেবায়েত শ্রী রাজীব লোচন চক্রবর্তী মহাপ্রভুর মন্দিরে তাঁদের আশ্রয় দেন এবং নবাব কন্যা ঠাকুরের চরণামৃত ও তুলসীর গুনে সুস্থ হয়ে ওঠেন । নবাব মহাপ্রভুর কৃপায় তার কন্যার সুস্থ হয়ে ওঠায় খুশি হন এবং যাওয়ার সময় তিনি মহাপ্রভুর দৈনিক খরচ নির্বাহের জন্য ১১৮৫ বিঘা জমি রিষড়ার পশ্চিমে দেবতার জন্য নিস্কর করে দান করেন । নবাব মন্দিরের দেবতাকে গঙ্গা বক্ষ থেকে দর্শন করেছিলেন, তাই তাঁর নির্দেশে গঙ্গা নদী পথ থেকে দেবতাকে যাতে দর্শন করা যায়, তার জন্য মন্দিরের দ্বার পূর্বমুখী করা হয়। শ্রী রাজীব লোচন চক্রবর্তীকে তিনি অধিকারী পদবী দান করেন । তারপর থেকে চক্রবর্তী পদবীর পরিবর্তে তাঁর বংশধরেরা অধিকারী পদবী ব্যবহার করতে থাকেন ।
বঙ্গের ইতিহাস গ্রন্থে ( তৃতীয় খন্ড) শ্রী নগেন্দ্র নাথ বসু লিখেছেন শেওড়াফুলির রাজা শ্রী মনোহর রায় মাহেশের জগন্নাথ মন্দির প্রথম নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে শ্রী রায় কর্তৃক নির্মিত মন্দির ভগ্নদশা প্রাপ্ত হলে সপ্তগ্রাম থেকে সুতানুটি তে স্থানান্তরিত সুবর্ণবণিক শ্রী নয়নচাঁদ মল্লিক শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের জন্য পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির এর অনুকরণে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। এটি ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা । গঙ্গা পথে যাতে সবাই শ্রী মহাপ্রভুর দর্শন পান ,তার জন্য মন্দিরের সদর দরজা পূর্বমুখী করা হয় ।
শ্রী ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর সময়ে শ্রী মহাপ্রভুর কোন রথ ছিল না । শ্রী কমলা কর পিপলাই এর আমল থেকে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা শুরু হয়েছিল । প্রথম রথ নির্মাণ করে দেন শেওড়াফুলির রাজা শ্রী মনোহর রায়। আরামবাগের তড়া নিবাসী দেওয়ান বসু পরিবারের শ্রী কৃষ্ণরাম বসু, তস্য পুত্র শ্রী গুরুচরণ বসু, তৎপরে শ্রী কালাচাঁদ বসু প্রভৃতি ব্যক্তিরা রথ ভগ্নদশা প্রাপ্ত হলে পুনর্নির্মাণ করে দেন। তবে এসবই ছিল কাষ্ঠনির্মিত রথ। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র বসু তৎকালীন কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে ৪৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ১২৫ টন ওজনের চারতলা বিশিষ্ট লোহার রথ মার্টিন বার্ন কোম্পানি দ্বারা তৈরি করান। এখন অব্দি সেই রথটি রথযাত্রার দিন টানা হয়ে থাকে।
পুরীতে যেমন শ্রী শ্রী
জগন্নাথের মাসির বাড়ি রয়েছে, মাহেশেও সেইরূপ মহাপ্রভুর মাসির বাড়ি বর্তমান । ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে পাথুরিয়াঘাট নিবাসী শ্রী নয়নচাঁদ মল্লিকের বংশধর শ্রী মতি লাল মল্লিকের সহধর্মিনী শ্রীমতি রঙ্গমনি দাস এখানে ঠাকুরের নামে প্রচুর ভূ-সম্পত্তি দেবোত্তর করেন ও শ্রী গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন । মনে রাখতে হবে দ্বাপরের শ্রীকৃষ্ণই কলি কালে শ্রী জগন্নাথ দেব । সেই কারণে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেব যখন কুঞ্জ বাটিতে অবস্থান করেন, তখন তিনি গোপিকাদের নাথ অর্থাৎ গোপীনাথ হয়ে মাধুর্য লীলা করেন। সেই কারণেই নির্মিত হয় গোপীনাথ বিগ্রহ ও মন্দির। এই গোপীনাথ মন্দির ই হল মহাপ্রভুর কুঞ্জ বাটি তথা মাসির বাড়ি। এটি মাহেশের সদগোপ পাড়ার বিপরীতে অবস্থিত l
এই মন্দির যেখানে অবস্থিত, সেই এলাকার ও নাম হয় মাসির বাড়ি । এই মাসির বাড়ি মন্দির প্রথমে ছিল প্রাচীরবেষ্টিত। মন্দিরের পশ্চিম পাশে ছিল সুদৃশ্য পুষ্করিণী, আর ধারে নারিকেল বৃক্ষ শোভাবর্ধন করত। মাসির বাড়ি প্রাঙ্গণে বসত রথের মেলা। বর্তমানে এই প্রাচীর বা পুকুর আর অবশিষ্ট নেই, তবে রথের মেলা এখনো বসে।
মাহেশের রথযাত্রা এখানকার মানুষকে এক ধর্মীয় আবেগে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন এই ধর্মীয় আবেগ পরিণত হয় জাতীয়তাবাদী ইংরেজ বিরোধী বিক্ষোভে। চিরকালই মাহেশের প্রধান সড়ক পথে মহাপ্রভুর রথ চলত। উক্ত বছর হুগলি জেলার শাসনকর্তা হার্সেল সাহেব রথ চালানো যাবে না বলে আদেশ দেন ।তিনি যুক্তি দেন এই যে মহাপ্রভুর রথের চাকার কোন গতিরোধক যন্ত্র নেই , তাই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞা মাহেশ বাসীকে ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগরিত করে। মাহেশের স্থানীয় বাসিন্দারা ভাবলেন মহারানী হিন্দু ধর্মে আঘাত হানতে চাইছেন। তাঁরা তৎকালীন দিনের বিখ্যাত আইনজ্ঞ শ্রী বিশ্বম্ভর বসুর কাছে আবেদন জানান এবং তাঁকে মাহেশ নিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি সমস্ত পর্যবেক্ষণ করে রায় দেন যে রথ এই বছর চলবে না । এর প্রতিবাদে সমগ্র মাহেশ বাসি অরন্ধন পালন করেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। যদিও এটা একটা আঞ্চলিক ঘটনা তবুও তাঁদের জোট বদ্ধতা পরবর্তীকালে বৃহত্তর আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করে। ইংরেজ সরকার প্রথমে ধর্মীয় আবেগকে গুরুত্ব না দিলেও পরের বছর সুর নরম করে ও রথের চাকার সন্মুখে বাঁশ দিয়ে বেড়া দেওয়া রথের টান অনুমোদন করে। এই ঘটনা ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে জুন তৎকালীন অমৃতবাজার যুগান্তর পত্রিকায় প্রচারিত হয়।
তথ্যসূত্র: মাহেশ সমাচার
লেখক: শ্রী অমরেশ চন্দ্র হালদার l
????????জয় জগন্নাথ????????
???????? জয় শ্রীরাম????????
সূর্য শেখর হালদার