ভারতবর্ষে সেবার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইংরেজি বা অন্য কোন বিদেশী ভাষায় সেবা শব্দটিকে সম্পূর্ণরূপে বোঝান সম্ভব নয়। ‘Service’ সেবার একটি দুর্বল ইংরেজি প্রতিশব্দ। ভারতীয়ত্বের সঙ্গে এই সেবা জিনিসটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর মহত্তম সেবা হল নিষ্ঠাসহকারে স্বার্থশূন্য দায়িত্ব পালন করা নিজের মাতৃভূমির জন্য, ধর্মের জন্য।
অধ্যাপিকা মালিনী ভট্টাচার্য (Malini Bhattacharya) তাঁর “Disaster Relief and The RSS: Resurrecting ‘Religion’ Through Humanitarianism” গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, সেবা হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। ‘The Brotherhood In Saffron: The Rashtriya Swayamsewak Sangh and Hindu Revivalism’ গ্রন্থে Walter K. Anderson এবং Sridhar D. Damle মন্তব্য করেছেন যে, ‘community’ এবং ‘commitment’ – এই দুটি জিনিসের ওপর ভিত্তি করে সঙ্ঘ ধীরে ধীরে তার বিস্তৃতির সোপান নির্মাণ করেছে।
সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা সর্বদাই দেশবাসীর কোন সংকটের সময় সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছেন। তা দেশবিভাগের সময়ই হোক (১৯৪৭) বা চীনা আগ্রাসনের সময় সীমান্তে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতেই হোক (১৯৬২) বা অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িষ্যায় সাইক্লোনের সময়ই হোক (১৯৭১) বা ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় (১৯৮৪) ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা করতেই হোক। পরবর্তীকালেও ওড়িষ্যায় সুপার সাইক্লোনের সময় (১৯৯৯), গুজরাটে ভূমিকম্পের সময় (২০০১), সুনামির সময় (২০০৪), উত্তরাখণ্ডে বন্যার সময় (২০১৩) এবং বর্তমানে করোনা মহামারীর সময় (২০২০) সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা দুর্গত মানুষদের জন্য সেবাকার্যে সর্বত্র ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জাত-পাত, ধর্ম, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদির বিচার না করেই তাঁরা সেবাকাজ চালান এবং এর দ্বারা মূলত সমাজের প্রান্তিক মানুষরাই বেশি উপকৃত হন।
সংঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠন – সেবা ভারতী, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, আরোগ্য ভারতী, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, জাতীয় সেবিকা সমিতি, হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ(বিদেশী শাখা), হিন্দু জাগরণ মঞ্চ প্রভৃতি করোনার মোকাবিলায় দিনরাত কাজ করে চলেছে। পাঁচ জন স্বয়ংসেবককে নিয়ে যে সঙ্ঘের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ ৯০ লক্ষের ওপর স্বয়ংসেবক এবং ৫৮,৯৭০টি শাখাসহ বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবীণ মানুষদের যত্ন ও সুরক্ষার জন্য সঙ্ঘ উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগটির নাম ‘‘Each one, Adopt one.’’ সঙ্ঘ ‘উৎকর্ষ’ নামে একটি এপ চালু করেছে যাতে বিভিন্ন সমস্যায় পড়া ব্যক্তিরা সাহায্য চাইতে পারেন। ‘সেবা ভারতী হেল্পলাইন’, ‘স্টুডেন্ট হেল্পলাইন’, ‘দিব্যাঙ্গ হেল্পলাইন’, ‘ডিজিটাল হেল্পলাইন’, ‘নর্থ ইস্ট পিপল হেল্পলাইন’ এবং ‘ব্লাড ডোনেশন হেল্পলাইন’ চালু করা হয়েছে।
সঙ্ঘের সরকার্যবাহ ভাইয়াজী যোশী এই বছরের ২রা এপ্রিল রামনবমীর দিন লকডাউনের সময় ‘পরিবার প্রবোধন’-এর মত কার্যক্রমের গুরুত্বের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, পরিবারের সকল সদস্য একত্রে ‘প্রার্থনা’ করলে তার দ্বারা ‘সংস্কার’-এর প্রবেশ ঘটবে এবং এই দুর্দিনে পরিবারগুলোর মনোবল বজায় থাকবে। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন, ২৬-এ এপ্রিল সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত জী-র বক্তৃতায় সঙ্ঘের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বর্তমান দুর্দিনের মোকাবিলায় ‘আত্মপ্রতিবন্ধ’, ‘আত্মীয়বৃত্তি’ ও ‘স্বদেশী’ জিনিসপত্রের ব্যবহারের প্রতি জোর দেন। তিনি বলেন ১৩০ কোটি মানুষই ভারত মাতার সন্তান এবং আমাদের প্রত্যেকের উচিত করোনা- সংক্রান্ত দুর্যোগের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা করা।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে সারা ভারতবর্ষেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তাদের সেবাকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সঙ্ঘের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে ৫ই মে সংক্ষেপে একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে এই সেবাকার্যের। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২রা মে পর্যন্ত ভারতবর্ষের ৬৭,৩৩৬ টি জায়গায় সেবাকাজ চালান হয়েছে। এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন ৩,৪২,৩১৯ জন স্বয়ংসেবক। মোট ৫০ লক্ষ ৪৮ হাজার ৮৮টি পরিবারে রেশন কিট সরবরাহ করা হয়েছে। রান্না করা খাদ্যের ৩ কোটি ১৭ লক্ষ ১২ হাজার ৭৬৭ টি প্যাকেট প্রদান করা হয়েছে। ৪,৮৯,৮২৪ জন পরিযায়ী শ্রমিককে বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হয়েছে। ২২,৪৪৬ টি রক্তদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ৪৪,৫৪,৫৫৫ টি মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। ৫৮,৭৩৯ জন গৃহহীনের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাইরের রাজ্যে ভ্রমণ, শিক্ষা, তীর্থদর্শন ইত্যাদি করতে গিয়ে আটকে পড়া ১,৬১,০০৫ জনকে সহায়তা করা হয়েছে।
এপ্রিল মাসে মুম্বই শহরের ১ লক্ষের ওপর মানুষকে প্রতিদিন খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল সঙ্ঘ ও তার অধীনস্থ বিভিন্ন সংগঠন। ‘অন্নপূর্ণা যোজনা’ নামক এই পরিকল্পনায় মুম্বই পৌরসভার ২৪ টি ওয়ার্ডে ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষকে ১৭ টি কমিউনিটি কিচেনের মাধ্যমে দিনে দু’বার রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়। করোনা ও লকডাউনের সময় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গেও সঙ্ঘ তার সেবাকার্য অব্যাহত রেখেছে। করোনা নিয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচার, রক্তদানের আয়োজন, মাস্ক বিতরণ, শুকনো রেশন, রান্না করা খাবার বিতরণ প্রভৃতি ব্যাপক পরিমাণে পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেই চলছে বিগত দেড় মাস ধরে।
সাংগঠনিকভাবে পশ্চিমবঙ্গকে সঙ্ঘ দু’ভাগে বিভক্ত করে- উত্তরবঙ্গ প্রান্ত ও দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত। দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের মধ্যে আবার আন্দামান ও নিকোবরও অন্তর্ভুক্ত। ২০২০-র ৩০এ এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গে সঙ্ঘের ১৪,৩২৮ জন স্বয়ংসেবক ৩,৭৮১ টি স্থানে সেবাকার্য চালিয়েছেন। এর দ্বারা মোট ১,৫৫,০৫৪ টি পরিবার উপকৃত হয়েছে। মোট ৫৪,৪০৯ টি মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। ১,০৪,০০৬ জন মানুষকে ও ১,৩৬৩ জন পরিযায়ী শ্রমিককে খাদ্য প্রদান করা হয়েছে। ৩১৬টি রক্তদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর উত্তরবঙ্গে এই বছরের ২রা মে পর্যন্ত সঙ্ঘের ৬,১২১ জন স্বয়ংসেবক মোট ২,৬৬৪ টি স্থানে সেবাকাজ চালিয়েছে। এর ফলে উপকৃত হয়েছে ৭৭,৯৭৮ টি পরিবার। ৫৬,৮৩২ টি শুকনো রেশন কিট ও ১৮,৯৮৭ টি খাদ্যের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গে মোট ২৫,৪২৫ টি মাস্ক ও ১২,০৯০ টি সাবান ও স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকা স্যানিটাইজ করা, শিশুদের জন্য দুধ প্রদান, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিষেবা প্রদান প্রভৃতিও গোটা পশ্চিমবঙ্গেই বহু জায়গায় করা হয়েছে।
ভারতবর্ষের বাইরেও সঙ্ঘের বহির্ভারতীয় শাখা হিন্দু স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ করোনা সংকটের মোকাবিলায় সেবাকার্যে নেমে পড়েছে। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার ২৪-এ এপ্রিলের খবর অনুযায়ী, হিন্দু স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম বড় সেবাকার্য পরিচালনা করছে যাতে প্রায় ১,৫০০ স্বয়ংসেবক অংশগ্রহণ করেছেন। এই প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে, সঙ্ঘ পরিবারেরই অংশ ‘সেবা ইন্টারন্যাশনাল’ প্রায় ৫ লক্ষ আমেরিকান ডলার সংগ্রহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ টি রাজ্যে সেবাকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সঙ্ঘ পরিবারেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। ৯ই মে ‘যুগশঙ্খ’ সংবাদপত্রে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মিলিন্দ পরান্দের কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এতে মিলিন্দ পরান্দে বলছেন, ‘‘গোটা বিশ্বে ও দেশ জুড়ে করোনা ভাইরাসের কারণে সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।… সমগ্র দেশে আমাদের ২৭ হাজারের বেশি কার্যকর্তা করোনা মোকাবিলাসহ বিভিন্ন সেবাকাজ করছেন। পিছিয়ে পড়া গরীব মানুষ, যারা লকডাউনের কারণে প্রভাবিত হয়েছেন তাঁদের প্রতিদিন রান্না করা খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আমরা প্রতিদিন ২ লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে অন্নদান করছি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে ৩ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি পরিবারকে আমরা ৭ থেকে ১০ দিন কোন কোন জায়গায় ১৫ দিনের রেশন দিচ্ছি। আমাদের সদস্যরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই সেবাকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর জন্য দেশের প্রতিটি রাজ্যে হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে।’’
‘সঙ্ঘ সংস্কার’-এর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল সেবা। করোনা ভাইরাস বা চীনা ভাইরাস যা-ই বলা হোক না একে কেন- এর দ্বারা বিপদে পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়ান স্বয়ংসেবকদের কাছে নতুন কিছু নয়। যত বড় সমস্যাই আসুক না কেন ভারতবর্ষের সামনে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা সর্বদাই বিপদের ভয় না করে দেশের সেবায় এগিয়ে আসেন। আর এর জন্য তাঁরা কোন প্রশংসা বা প্রচার চান না, কারণ, সঙ্ঘ পরিবারের শিরায়-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে সেবার আদর্শ। কারণ সঙ্ঘ বিশ্বাস করে ভারতীয় সংস্কৃতির চিরন্তন ঐতিহ্যে; যা শেখায়-
‘‘ওঁ সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ
সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।
সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু
মা কশ্চিদুঃখভাগভবেত্।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।’’