আমাদের আগের প্রজন্মে অর্থাৎ খুড়োজ্যাঠাদের কালে বেশ কিছু উচ্চশিক্ষিত বিশিষ্ট মানুষ দেখেছি যারা নিজেদের কমিউনিস্ট বলতে গর্ববোধ করতেন। তারা মনে করতেন কমিউনিস্টরাই যথার্থ প্রগতিবাদী; বাকি সব করে কম্মে খাচ্ছে আর কী। এই ধারণা আমাদের কালে আরও ব্যাপ্তি লাভ করেছিল। আর এই কমিউনিস্টরা মনে করতেন তাদের থেকে বড় আর কেউ নেই, কিছু নেই। এই যে দুটো প্রজন্মের ধারণা তা গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের ফলে। তারা কথায় কথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখাতেন। আর এদেশে বিপ্লব বিপ্লব করতেন। আমরা যারা দেশ দেশ করতুম, তাদের ব্যঙ্গ করে বলতেন—“ওই দেখো ভাই চাঁদ উঠেছে। চাঁদ যেন শুধু রাশিয়াতেই ওঠে, ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে ওঠে না। ব্যাপারটা এই রকমই দাঁড়িয়েছিল। আমরা এই নিয়ে তর্ক করতে গেলে ওঁরা আমাদের মূলধন রবীন্দ্রনাথকে দেখাতেন। বলতেন, রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি’ পড়েছেন? রাশিয়া দেখে তিনি কেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন তা জানেন? আমাদের সময় পড়াশোনার একটু চল ছিল। তাই বলতুম, রাশিয়ার চিঠি’ পড়েছি। সেখানে তো রবীন্দ্রনাথের শুধু মুগ্ধতাই নেই, নানা সমালোচনাও আছে। যেমন…। কমিউনিস্টরা আর আমাদের কথায় বলতে দিতেন না। একসঙ্গে সবাই হইহই করে উঠতেন। চুপ করুন। ওঁদের প্রাবল্যে আমরা চুপ করে যেতুম।
এখন সেকালটা কেটে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে গেছে। ভেঙে চুরমার। লেনিন স্টালিনের মূর্তি রাস্তায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গেও কমিউনিস্টদের যাই যাই অবস্থা। ক্ষীণ কণ্ঠে এখনও কেউ কেউ মার্কস মার্কস করছেন। এরই মাঝখানে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবার্ষিকী আমিও নবীন থেকে আজ প্রবীণ হয়েছি। রাশিয়া ও রবীন্দ্রনাথকে দেখে আজ আমার মনে একটা প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে—কোনটা বড় রাষ্ট্রশক্তি, না ব্যক্তিশক্তি বা আত্মশক্তি ? সোভিয়েত ইউনিয়ন (পরিচিত অর্থে রাশিয়া) গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা। সেখানে রাষ্ট্রই সব, ব্যক্তি ছিল গৌণ। সেই রাশিয়া ধ্বংস হয়ে গেল সত্তর বছরের মধ্যেই। আমরা দেখলুম, দলসর্বস্ব রাষ্ট্রের উত্থান ও পতন। কিন্তু আত্মশক্তিতে উদ্বোধিত রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর (জন্মের নয়) প্রায় সত্তর বছর পরেও আজ উজ্জ্বলতম। দেশের সর্বত্র তিনি বিরাজমান। এই আত্মশক্তি বা ব্যষ্টির ক্ষমতাকে আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা কখনই মর্যাদা দেয়নি। দলতন্ত্র দলতন্ত্র করে তারা এক ধরনের মোহে আবৃত বা আবিষ্ট হয়েছিল। সেই মোহগ্রস্ত অবস্থায় আমার নবীন বয়সের বন্ধুরা রাশিয়ার চিঠি’-র রাশিয়াকে দেখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে নয়।
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণে যান। রাষ্টশক্তির উজ্জ্বল্য তিনি লক্ষ্য করেছিলেন ঠিকই; কিন্তু সেই সময়েই তিনি বুঝেছিলেন, এই আলো শীঘ্রই নিভে যাবে। এই রাষ্ট্র টিকবে না। তাই রাশিয়ার চিঠিতেই মৃত্যুহীন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মানুষের ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত সীমা এরা যে ঠিকমতো ধরতে পেরেছে তা আমার বোধ হয় না। সে হিসেবে এরা ফ্যাসিস্টদেরই মতো। এই কারণে সমষ্টির খাতিরে ব্যক্তির প্রতি পীড়নে এরা কোনো বাধাই মানতে চায় না। ভুলে যায়, ব্যষ্টিকে দুর্বল। করে সমষ্টিকে সবল করা যায় না, ব্যক্তি যদি শৃঙ্খলিত হয় তবে সমষ্টি স্বাধীন হতে পারে না। এখানে জবরদস্ত লোকের একনায়কত্ব চলছে। এইরকম একের হাতে দশের চালনা দৈবাৎ কিছুদিনের মতো ভালো ফল দিতেও পারে, কিন্তু কখনোই চিরদিন পারে না। এই চিঠির তারিখ-৯ অক্টোবর ১৯৩০। আমার রাশিয়া প্রাণ বন্ধুরা রাশিয়ার চিঠি’-র প্রথম চিঠির প্রথমাংশ পড়ে আর পাতা ওলটাননি। এই তো রবীন্দ্রনাথ বলে চীকার করেছেন। সেই প্রথমাংশ উদ্ধার করি রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে। এই চিঠির তারিখ-২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩০
তাহলে দেখা যাচ্ছে রাশিয়ায় থাকাকালীন ১৯ দিনের মাথায় রবীন্দ্রনাথ দেশটির ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এই–পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের পতন বুঝতে আমাদের ৩৪ বছর লাগল; আর রাশিয়ার পতন বুঝতে রবীন্দ্রনাথের ১৮ দিন লেগেছে। এই হচ্ছে আত্মশক্তি বা ব্যক্তির ক্ষমতা।
আত্মশক্তি কী তা রবীন্দ্রনাথ জীবনসাধনার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই সাধনার মূল মন্ত্রই হচ্ছে-উত্তিষ্ঠত,জাগ্রত। মানুষকে ঠেলে কেউ ঘুম থেকে জাগাবে না। তাকে নিজেকেই জাগতে হবে। আর জেগে সে কুম্ভকর্ণের মতো শুধু খাবে না, তাকে সৃষ্টি করতে হবে। সেই সৃষ্টিই হবে কাজ যা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এরই প্রকাশ যেমন রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতায়, তেমনই শেষ জীবনের ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ কবিতায়। দুটি কবিতা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ একটু উদ্ধার করি : ‘নিৰ্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’
কী জানি কী হল আজি,
জাগিয়া উঠিল প্রাণ
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ওরে চারিদিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাতে কর।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি এসেছে রবির কর।
‘তোমার সৃষ্টির পথ’
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।
এই প্রাণ জেগে ওঠা আর অনায়াসে ছলনা সহ্য করার শক্তিই হচ্ছে আত্মশক্তি। এই শক্তিকে যাঁরা চিনেছেন, উপনিষদের ভাষায় ‘ন ততো বিজুগুপ্সতে অর্থাৎ অপ্রকাশিত থাকেন না। রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির এই শক্তিকে দমিত করে রাখে অথবা মূল্য না দেয় তাহলে সেই রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। রাশিয়ার পতন ও পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের আসন্ন পতন অনেকটা এই কারণেই।
১৯০৫ -এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কালে রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন এই আত্মশক্তির ওপর। তিনি আত্মশক্তি’ নামে এসময় একটি প্রবন্ধ গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। সেখানেই রয়েছে তার বিখ্যাত ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধ। বাঙালির জাগরণের ক্ষেত্রে এসময় তাঁর গানগুলি যেমন শক্তি জুগিয়েছে তেমনই ‘আত্মশক্তির প্রবন্ধগুলিও বাঙালি চিত্তকে উদ্বুদ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথ চিরকালই আত্মার সাধনাকে বড় করে দেখেছেন, রাষ্ট্রিক প্রভাবকে নয়। রাশিয়ার চিঠি’-রই এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, বাইরের সকল কাজের উপরেও একটা জিনিস আছে সেটা আত্মার সাধনা। রাষ্ট্রিক আর্থিক নানা গোলেমালে যখন মনটা আবিল হয়ে ওঠে তখন তাকে স্পষ্ট দেখতে পাইনে বলেই তার জোর কমে যায়।…অতএব আমাকে সত্য হবার চেষ্টা করতে হবে, প্রিয় হবার নয়। আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকাই তাহলে দেখব সেখানে আত্মার সাধনার গুরুত্ব কোথায়, শুধু তো দলসর্বস্বতার আয়োজন। এখানে রাষ্ট্রশক্তি মানুষের ওপর পেষণ চালাচ্ছে। আর যে সব কর্মসূচি গ্রহণ করছে তা শুধু দলের কাছে প্রিয় হবার জন্যে, দেশের কাছে সত্য হবার জন্যে নয়। এই উলটপুরাণ পশ্চিমবঙ্গকে তথা বাঙালিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ কথাটা বোঝার মতো দেশনেতা আজ এ রাজ্যে নেই। আসলে যে পলিটিক্স আজ আমরা দেখছি, এর জন্ম কোনো ব্যক্তিশক্তির আত্ম-উদ্বোধনে নয়। এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিয়েছে ব্রিটিশরা। এই বাইরের জিনিসকে আমরা আন্তর-স্পর্শে নতুন করতে পারিনি। তাই এই পলিটিক্সের প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠেছে বিরোধিতা, গড়া বা সৃষ্টি নয়। যেটা ছিল রবীন্দ্রনাথের কাজ। একটু গভীরভাবে ভেবে দেখলে দেখব, গান্ধিজি যে পলিটিক্স ভারতে দাঁড় করালেন তা মূলত ইংরেজের বিরোধিতা। একটার পর একটা আন্দোলন করে তিনি ভারতবাসীকে ইংরেজ বিরোধী করে তলতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চিন্তা এমন ছিল না। তিনি কর্মের মধ্যে দিয়ে, সাধনার মধ্য দিয়ে জাতিকে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ ও প্রণোদিত করতে চেয়েছিলেন। শুধু ইংরেজ বিরোধিতায় জাতিকে তৈরি হতে বলেননি। এই জন্যেই তাঁর লক্ষ্য ছিল স্বদেশী সমাজের দিকে, বিদেশি পলিটিক্সের দিকে নয়। তিনি গান্ধিজির মতো দল গড়েননি, তিনি জীবনের সুরের আগুন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সবখানে। যে-কোনো বিরোধিতার মধ্যে দুটো দিক থাকতে হবে ভাঙন ও সৃজন। কিন্তু আমাদের দেশে পলিটিক্সে ভাঙনের খেলাই মুখ্য, সৃজনের নয়। সৃজনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিশক্তির গুরুত্বকে স্বীকার করতেই হবে। তা কি হচ্ছে? গান্ধি থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত বিরোধিতাই হচ্ছে পলিটিক্স। গান্ধির ইংরেজ বিরোধিতা, মমতার সিপিএম বিরোধিতা। এরই আর এক দিক হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-এর মমতা বিরোধিতা আর দিল্লিতে কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধিতা। এই বিরোধের যে একটা উল্টো দিক আছে ‘মিলন’ সেটা রবীন্দ্রনাথ ধরতে পেরেছিলেন। তাই তিনি লিখেছিলেন—“দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে/এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।” একথা গান্ধিজি বলতে পারেননি। তাঁর কথা—‘কুইট ইন্ডিয়া’, ইংরেজ ভারত ছাড়ো। পলিটিক্স গান্ধিজিকে প্রিয় করেছে, আত্মশক্তি রবীন্দ্রনাথকে সত্য করেছে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার পলিটিক্স গান্ধিজিকে দেশে বিদেশে বেশি পরিচিত করিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সেভাবে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েননি। সত্য বড় কঠিন বলে ? যে কথা দিয়ে প্রবন্ধ শুরু করেছিলুম-রাশিয়ায় রাষ্ট্রশক্তির উত্থান ও পতন, সেই কথা ধরে একটু বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে নামি। পশ্চিমবঙ্গে তিন দশকের বেশি সময় ধরে বামফ্রন্টের বিশেষত সিপিএম-এর যে এক ধরনের প্রাদেশিক রাষ্ট্রশক্তির পরিচয় পেয়েছি তা ওই রাশিয়া থেকেই আমদানি। সেই রাষ্ট্রশক্তি সবচেয়ে যে বড় সর্বনাশ করেছে তা হচ্ছে মানুষকে ভীরু ও কাপুরুষ করে তুলেছে। কমিউনিস্টরা যে প্রগতির কথা বলত তার নমুনা কি এই। আমি প্রগতি বলতে বুঝি-চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির’। এটা পশ্চিমবঙ্গে আজ আছে? মানুষ সর্বত্র সর্বকাজে ভীতু, সন্ত্রস্ত এবং শির তাদের অবনত। প্রগতি আসে বন্দিদশা থেকে নয়, মুক্তচিন্তা থেকে। সেই মুক্তচিন্তার পরিবেশ কি রাষ্ট্রশক্তি তৈরি করতে পেরেছে? মানুষ আজ অপমান ও অমর্যাদা নিয়ে বেঁচে আছে-কী গ্রামে, কী শহরে। রাষ্ট্রশক্তির এই কদর্য রূপ রবীন্দ্রনাথের মতো কেউই চিনতে পারেননি। রাশিয়া পরিভ্রমণের অনেক আগে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, আমাদের বাঁচিবার উপায় আমাদের নিজের শক্তিকে সর্বতোভাবে জাগ্রত করা। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি কি এই পরিবেশ তৈরি করেছে? শিক্ষার প্রাঙ্গনটাই দেখুন না। বিদ্যালয়ে বিদ্যা নেই, মহাবিদ্যালয়ে মহত্ব নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব নেই। সবই ‘দলালয়’ হয়ে গেছে। মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে কি দল করবার জন্যে? না, আত্ম-উদ্বোধনের জন্যে? পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষায় কোথাও আজ আত্ম উদ্বোধনের সুযোগ আছে? রাষ্ট্রশক্তি সে সুযোগের পথ বিনষ্ট করে দিয়েছে। এখানে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের নির্ভর করতেই হবে। কারণ এদেশে যথার্থ শিক্ষার কথা রবীন্দ্রনাথের মতো কেউ ভাবেননি। আর অনেকেই হয়তো জানেন না, রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালে রাশিয়া গিয়েছিলেন কী জন্যে ? তার মুখেই জবাবটা শুনি-“তাই যখন শুনলুম, রাশিয়াতে জনসাধারণের শিক্ষা প্রায় শূন্য অঙ্ক থেকে প্রভূত পরিমানে বেড়ে গেছে, তখন মনে মনে ঠিক করলুম, ভাঙা শরীর আরও যদি ভাঙে তো ভাঙুক, ওখানে যেতেই হবে। এরা জেনেছে অশক্তকে শক্তি দেবার। একটি মাত্র উপায় শিক্ষা-অন্ন-স্বাস্থ্য-শান্তি সমস্ত এরই পরে নির্ভর করে। ফঁকা ল অ্যাণ্ড অর্ডার’ নিয়ে না ভরে পেট, না ভরে মন। অথচ তার দাম দিতে গিয়ে সর্বস্ব বিকিয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টরা যাঁরা রাশিয়া রাশিয়া’ করতেন (এখন চিন। চিন করেন) ভঁরা ওদের শিক্ষাটা নিয়েছিলেন কি? নিলে প্রাথমিক শিক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের এই হাল হয়! তবে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার শিক্ষাকেও সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন। তাই বলেছিলেন, একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে-কিন্তু ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনও টেকে না। এখানেও তিনি উদার মুক্ত মনের সমর্থক। মন স্বাধীন না হলে কোনো কিছুই টেকে না।
আমার যৌবন বয়সে কমিউনিস্ট বন্ধুরা বলতেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার তেমন মূল্য নেই যদি না অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসে। রাশিয়াতে তো এসেছিল, তাও টিকল না কেন? জবাবি ভাষণে,আবার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসব। গান দিয়ে, –চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি…’। এই হৃদয়। পশ্চিমবঙ্গের যাঁরা শাসক তঁাদের এটা আছে? তাঁদের বাহু আছে, হূদয় নেই। কেবলই বাহুর প্রসার ঘটিয়ে আস্ফালন করেন, হৃদয়ের প্রসার ঘটিয়ে কিছু করেছেন বলে তো শুনিনি। রবীন্দ্র অনুরাগী স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যেমন বলেছিলেন,—Freedom first, freedom second and freedom always, এরই অনুকরণে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি বলতেন, Education first, education second and education always, তাহলে বুবতুম তঁারা একালের নায়ক। কিন্তু তাঁরা অবলম্বন করলেন, Power first, power second and power always.
দীর্ঘ ৩৪ বছর পর এই Power-ই তঁাদের পতনের কারণ হল। অথচ রবীন্দ্রনাথের পতন নেই। এই সরকারই সাড়ম্বরে তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পালন করছে। এখানেই রাষ্ট্রশক্তির পতন ও আত্মশক্তির প্রতিষ্ঠা। তাই বলতে ইচ্ছে করে, জগতে যা কিছু সুন্দর তা তৈরি করেছে ব্যক্তি, যা কিছু অসত্য তা তৈরি করেছে দল। রাশিয়ার পতন সেই অসত্যকেই প্রমাণ করল। আর রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন সত্য সুন্দরুকে। ২০১১-য় বাঙালির আবার নবজাগরণ ঘটুক। সে জাগরণ ঘটুক রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। রাজনৈতিক পালাবদলই পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন হোক মানুষ থেকে মনুষ্যত্বে। রাজনীতিতে শুধু মানুষ মানুষ করলে হবে না। মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠাই হবে রাজনীতির ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ এই মনুষ্যত্বের উজ্জ্বল মুর্তি। বিংশ শতাব্দী গেছে কার্ল মার্কসের; একবিংশ শতাব্দী হোক রবীন্দ্রনাথের। এক্ষেত্রে কারও কারও মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে রাজনীতি কি হবে দলহীন, পলিটিক্সে দলের প্রয়োজন নেই ? দলহীন রাজনীতির কথা আমাদের দেশে যে ওঠেনি, তা নয়। কিন্তু কার্যকরী হয়নি। রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে আত্মশক্তির মিলন দরকার। দল বলতে শুধু সমষ্টি বুঝলে হবে না। ব্যষ্টির সঙ্গে সমষ্টির মিলনই দল। দলের দুটো অংশ-নেতা ও কর্মী। নেতাকে শুধু দল দল করলে চলবে না। তাকে আত্মশক্তিতে খানিকটা উদ্বুদ্ধ হতেই হবে। এখানেই তার প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথকে। পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টরা একথা বোঝেননি। মার্কস, মার্ক করে সময় কাটিয়েছেন। সময় কাটিয়েছেন, মার্কসকে নিয়ে চিন্তা করেছেন বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তো নয়ই। এখন রবীন্দ্র-চিন্তার সময়। যে-চিন্তা রাজনীতির থেকে জীবনকে বড় করে দেখেছে। তাই তাঁর আহ্বান
এসো অপরাজিত বাণী, অসত্য হানি-
অপহত শঙ্কা, অপগত সংশয়॥
এসো নবজাগ্রত প্রাণ, চিরযৌবন জয়গান।
এসো মৃত্যুঞ্জয় আশা, জড়ত্বনাশা-
ক্রন্দন দূর হোক, বন্ধন হোক ক্ষয়॥
অধ্যাপক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
[লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান (বাংলা) ও গণমুক্তি পরিষদের সভাপতি]