উনিশ শতকের বাংলার ধর্মীয় নবজাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের আধ্যাত্ম সাধনার লীলাভূমি দক্ষিণেশ্বর ও তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক রানী রাসমণি (২৮ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩ – ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৬১)। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হালিশহরের এক কৃষক পরিবারের কন্যা রাসমণি জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্রের পত্নী থেকে লোকমাতা রানী রাসমণি হয়ে উঠেছিলেন নিজ কর্মগুন, ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতায়।
অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান রানী জানবাজারের ধনাঢ্য পরিবারের বধূ হিসেবে এলেও তিনি দরিদ্রের কষ্ট বুঝতেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি প্রজাদের ‘রাজ্ঞী’ ছিলেন। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী রাজচন্দ্র দাসের তিরোধানের পর রাসমণি তাঁর সমস্ত ব্যবসা ও সম্পত্তির দায়ভার গ্রহন করেন। স্বামী পরলোকগত হলে তাঁর বিধবা স্ত্রীর সম্পত্তির দায়ভার গ্রহন আজকের যুগে সাধারণ ঘটনা হলেও উনিশ শতকের বাংলায় একজন বিধবা রমণীর পক্ষে তাঁর স্বামীর সুবিশাল জমিদারির দায়ভার গ্রহন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ – বলা যেতে পারে নারী জাগরণের এক ঐতিহাসিক পটভূমি।
রানী রাসমণি পর্দাসীনা হয়েও নিয়মিত সংবাদপত্রের মাধ্যমে বহির্জগতের খবর রাখতেন। নিজের জামাতাদের বিশেষ করে সেজো জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাসের সহযোগিতায় নিজ জমিদারির পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি রানী তাই বৈষয়িক চিন্তা তার ছিল বৈ কি ! তবে তাঁর চরিত্রে দয়া, মমতা, সহনশীলতার পাশাপাশি তেজ, দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের সুন্দর সংমিশ্রণ দেখা যায়।
প্রজা কল্যাণে সদাতৎপর রানী বহুবার ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। দরিদ্র মাঝিদের উপর জলকর চাপানোর প্রতিবাদে গঙ্গা ইজারা নিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের পর্যদুস্ত করেছেন। নীলকর সাহেবরা প্রজাদের উপর অত্যাচার করলে তিনি প্রজাদের হয়ে মোকদ্দমা লড়েছেন। দুর্গাপুজোয় সাড়ম্বরে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে নবপত্রিকা নিয়ে যাওয়ার রীতিতে বাধা দিতে চেয়েছিল গোরা সাহেবরা। প্রতিবাদে রানী তাঁর জমিদারির মধ্যে বাবুঘাট যাওয়ার রাস্তা গোরা সাহেবদের জন্য আটকে দিলেন। জানবাজারের বাড়িতে উশৃঙ্খল গোরা সেনাদের থেকে কূলদেবতাকে রক্ষা করতে নিজ হাতে তরবারি ধরেছেন রানী। তৎকালীন ভারতের সর্বময় প্রভু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এরূপ পরাক্রম প্রদর্শন শুধুমাত্র জমিদারের জোরে সম্ভব হয়নি, তার সাথে ছিল রানীর চারিত্রিক দৃঢ়তা, স্থির প্রতিজ্ঞ মনোভাব, দুর্দমনীয় সাহসিকতা ও প্রজাদরদী মন।
মহানুভব রানী রাসমণি সমাজের উন্নতি কল্পে ছিলেন সদা সচেষ্ট ও পরম দানশীলা। বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে সমর্থন জানান তিনি। গঙ্গায় নিত্য স্নানযাত্রীদের সুবিধার্থে বাবুঘাট, আহিরীটোলা ঘাট, নিমতলা ঘাট প্রতিষ্ঠা করেন। তীর্থ যাত্রীদের জন্য সুবর্ণরেখা নদীর তীর থেকে পুরী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী (বর্তমানে ন্যাশনাল লাইব্রেরী), হিন্দু কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) -এ প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
উনিশ শতকের ধর্মীয় আন্দোলনে নবদিশা দেখিয়েছিলেন রানী রাসমণি। স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত রানী ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। মন্দিরের নির্মাণকার্য থেকে শুরু করে মন্দির উদ্বোধন বা তার পরবর্তী সময়ে মন্দিরের পূজা বিধি নিয়ে বহুবার রানীকে স্বদেশীয় মানুষের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে। গোঁড়া বাঙালি সমাজে এক শূদ্র বিধবা রমণী মাতৃ মন্দির প্রতিষ্ঠা করবে এমন সম্ভাবনা সমূলে বিনাশ করতে সচেষ্ট হয়েছিল তখনকার ব্রাহ্মণ সমাজ। মহৎ কার্য কবেই বা সহজ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে ! এ পথও ছিল বেশ কঠিন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে মন্দির নির্মাণ সম্পন্ন হলেও মন্দির উদ্বোধনে পেরিয়ে গেল আরও দুটি বছর। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণেশ্বর মন্দির উদ্বোধন হলো- যেখানে পূজারী হলেন শ্রী রাম কুমার চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীতে যাঁর হাত ধরে এলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। দক্ষিণেশ্বর মন্দির শুধু মাতৃমন্দির নয়- শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মচেতনার অপূর্ব সংমিশ্রন।
বর্তমান বিশ্বে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারার যে পুণ্য প্রবাহ সর্বত্র বিরাজমান তার শুভ সূচনা ঘটিয়েছিলেন রানী রাসমণি। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব রানীকে ‘অষ্ট মাতৃকার এক মাতৃশক্তি’ বলেছিলেন। উনিশ শতকের বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ এ বাঙালি জাতি আশীর্বাদ ধন্য হয়েছিল এমন এক মাতৃশক্তির আবির্ভাবে।
“বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ?
জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”
– বিবেকানন্দের এই অমোঘ বাণী তো আমরা পূর্বেই রানীর মাঝে প্রস্ফুটিত হতে দেখি। দয়া ধর্মে দীক্ষিতা রানীর উৎসব সম্পূর্ণ হতো দরিদ্র নরনারায়ণ সেবার মাধ্যমে। সিস্টার নিবেদিতা রানী রাসমণি সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘রানী রাসমনি না থাকলে দক্ষিণেশ্বর হতো না, দক্ষিণেশ্বর ছাড়া গদাধর – শ্রীরামকৃষ্ণ হতেন না, শ্রীরামকৃষ্ণ না থাকলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত – বিবেকানন্দ হতেন না, বিবেকানন্দ ছাড়া ভারতের নবজাগরণ অসম্পূর্ণ থাকতো।’
ডঃ শিশুতোষ সামন্ত রানীর জীবনী বর্ণনায় বলেছেন, “ব্রাহ্মণের সমদর্শিতা, ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রতেজ, বৈশ্যের বিষয়বুদ্ধি এবং শূদ্রের সেবা রানীর মধ্যে সমন্বিত হয়েছিল।” যথার্থই বলেছেন ডঃ সামন্ত। আজ থেকে দুই শতক পূর্বে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ পুণ্যলগ্নে জন্ম নেওয়া মাতৃশক্তিকে আজও বিস্ময়চিত্তে স্মরণ করছে বাংলা তথা দেশবাসী। ক্ষাত্র তেজে বলীয়ান, দয়া ধর্মে দীক্ষিতা সৎ, নির্ভীক, মহীয়সী বাঙালি নারী কর্মগুনে হয়েছেন লোকমাতা রানী রাসমণি।
সুচরিতা চৌধুরী