“গনিব। আমার এক দুঃখ, এক সন্তাপ, এক ভরসা আছে। ১২০৩ সাল হইতে দিবস গণি। যে দিন বঙ্গে হিন্দুনাম লোপ পাইয়াছে, সেই দিন হইতে গণি। হায় কত গনিব ? দিন গনিতে গনিতে মাস হয়, মাস গনিতে গনিতে বৎসর হয়, বৎসর গণিতে গণিতে শতাব্দী হয়। শতাব্দীও ফিরিয়া ফিরিয়া সাত বার গণি”….
যা হারিয়েছি , তা একদিন আমার ছিল। যা হারিয়েছি তা একদিন আমাদের ছিল। সুপ্রাচীন গর্বিত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্পদ আজ যা অন্যের কুক্ষিগত, যা আজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কেবলমাত্র আগ্রাসনে তা আমার ছিল। যা আমার তা আমার বলতে লজ্জা কোথায়? যা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তা পুনরুদ্ধার করতে আপত্তি কিসের? আজ পশ্চিমবঙ্গ দিবসে আমাদের ফেলে আসা বিক্রমপুর রামপালের কথা বলব। বলব বিক্রমপুর চূড়াইনা গ্রামে প্রাপ্ত একটি রজত নির্মিত বিষ্ণু মূর্তির কথা।
বিক্রমপুরের প্রাচীনত্বের নির্দশন-স্বরূপ যা কিছু আছে, তৎসমুদয়ই রামপাল ও তৎসন্নিকটবর্তী গ্রাম সমূহ সাক্ষ্য বহন করছে। পাল বংশীয় নরপতি রামপালের নামানুসারে এই স্থানের নাম হয় রামপাল। বিক্রমপুরের ক্ষমতাশালী রাজাদের রাজধানী হবার জন্য সঠিক স্থানই ছিল রামপাল। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত #রামচরিত গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে – পূর্বদিকের অধিপতি বর্মরাজা নিজের পরিত্রাণের জন্য উৎকৃষ্ট হস্তী ও স্বীয় রথ প্রদান করেছিলেন।
বেলাব তাম্রশাসনের প্রতিপাদয়িতা ভোজবর্মাকেই এই প্রাগদেশীয় বর্মরাজা বলেই ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেন। বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস রজনীকাণ্ডতে উল্লিখিত হয়েছে -সামলবর্মার পিতা জাতবর্মা দিব্য নামক কৈবর্ত – নায়কের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। হয়তো কৈবর্তপতি ভীম পক্ষীয় যোদ্ধৃবর্গের অনুসরণ করে রামপাল কিছুদিনের জন্য পূর্ববঙ্গে আগমন করেছিলেন এবং তৎকালে রাজা সামলবর্মা ভীমকে পরাজিত করেন। রাজ কবি তাঁর রচনায় তারই আভাস দিয়েছেন। যেখানে সামলবর্মা গৌড়াধিপ রামপালকে অভ্যর্থনা করেন সেই স্থানই বর্তমানে বিক্রমপুরে #রামপাল নামে বিখ্যাত হয়েছে।
এই অনুমান একেবারেই অযৌক্তিক বলে মনে হয় না । আশুতোষ গুপ্ত মহাশয় তার লিখিত #রামপাল নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন – I am of opinion that the prince who gave his name to this city and lake of Rampal was a king of the Pal dynasty.
মুন্সিগঞ্জ হতে তিন মাইল পশ্চিমে বিক্রমপুরের প্রাচীন রাজধানী রামপাল অবস্থান করছে। বিক্রমপুর পাল শাসনে অত্যন্ত উন্নতির শিখরে উঠে আসে। বিক্রমপুরের বিভিন্ন প্রাচীন স্থান হতে প্রাপ্ত পালযুগের বহু শিল্পদ্রব্য, প্রস্তরমূর্তি এবং মৃদ্ভাকার্য হতে সেসবের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। সেন নৃপতি বল্লাল সেন সীতাহাটি তাম্রফলকে ” স খলু শ্ৰীবিক্রমপুর সমাবাসিত শ্ৰীমজজয়স্কন্ধাবারাৎ” লিখিত আছে। সুতরাং শ্ৰী বিক্রমপুর ও রামপাল অভিন্ন।
যদিও গোবিন্দকান্ত বিদ্যাভূষণ মহাশয় তাঁর #লঘুভারত গ্রন্থে লিখছেন –
রাম নামৈকা বৈদ্যরাজ মহাধনী
তৎপালিতা সানগরী রামপালেতি সংজ্ঞিতা।।
সুপ্রাচীন বঙ্গের এক সুপ্রাচীন অঞ্চল শ্ৰীবিক্রমপুর আজও অখণ্ডভারতের গর্বিত ইতিহাস বহন করে চলেছে। বিক্রমপুর শিক্ষা , সভ্যতা এবং উন্নতিতে সর্বজন পরিচিত ছিল। গৌড়দেশ অর্থাৎ সুপ্রাচীন বঙ্গ। গৌড় অর্থাৎ জনপদ। মৎস্য পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ, কূর্ম পুরাণ, বায়ু পুরাণ, আদি পুরাণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র , বাৎস্যায়ন কামসূত্রে গৌড় নামটি প্রাপ্ত হয়। গৌড় বলতে বোঝায় রাজমহল পাহাড়ের অপরাংশ। সেই অপরপাড় অনেকাংশে বিভক্ত – পুন্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গ, কানসোনা বা কর্ণসুবর্ণ , সমতট অর্থাৎ কুমিল্লা, ফরিদপুর, ঢাকা, তাম্রলিপ্ত অর্থাৎ তমলুক।
মৌখিরিরাজ ঈশানবর্মার হারহা লিপিতে গৌড়দিগকে #সমুদ্রাশ্রয় বলে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সমুদ্রই তাঁদের আশ্রয় স্থল। গৌড়গণ সামুদ্রিক জাতি ছিলেন। কালীদাস বঙ্গবাসীকে #নৌসাধনোদ্যত বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ রণতরী ছিল তাঁদের যুদ্ধের সাধন। তাঁরা জলপথে রণপোতের সাহায্যে যুদ্ধ করতেন। বঙ্গবাসী সুবিশাল পঙ্খী, নাও, মধুকর নিয়ে বাণিজ্য নিমিত্ত বহুদূর যাতায়াত করতেন। সমুদ্রপারে তাঁদের কীর্তি সাক্ষ্য চিন্হ আজও সিংহল , যবদ্বীপ, ব্রহ্ম , শ্যাম বহন করে চলেছে।
শ্ৰীবিক্রমপুর চন্দ্র , বর্ম সকল পরাক্রমশালী নৃপতিদেরই রাজধানী ছিল। বিজয়সেনের বারাকপুর তাম্রশাসন থেকে আমরা অবগত হই যে বিজয়সেনের সময়ই শ্ৰীবিক্রমপুর সেনরাজাদের অধীন হয়। দীর্ঘ সময় শ্ৰীবিক্রমপুর সেন বংশের রাজধানী ছিল। নানা তাম্রলেখতে দেখা যায় যে বিভিন্ন বংশের নৃপতিরাই শ্ৰীবিক্রমপুরবাসিত – জয় স্কন্ধাবার হতে তাম্রশাসন প্রদান করেছেন। ফলে নানা রাজবংশের রাজধানী শ্ৰীবিক্রমপুর ছিল সে বিষয় বিতর্ক নাই।
প্রসঙ্গত, শ্ৰীচন্দ্রদেবের তাম্রশাসন , শ্যামলবর্মার তাম্রশাসন ও সেননৃপতিদের তাম্রশাসনে বিক্রমপুরকে #শ্ৰীবিক্রমপুর নামে অভিহিত করেছেন। গুপ্ত হতে সেন দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসধারক শ্ৰীবিক্রমপুর রামপাল নানা পল্লীর সমাহারে গড়ে উঠেছিল। রামপাল, সুবাসপুর, বজ্রযোগিনী, আটপাড়া , সুয়াপাড়া, নাহাপাড়া, রঘুরামপুর, শঙ্করবান্দ, জোড়াদেউল, মানিকেশ্বর , পানাম, পঞ্চসার, চাঁপাতালি, চূড়াইন, মহাকালী, কেওয়ার, শাঁখারিবাজার, সিপাহিপাড়া, কামারনগর, দেওসার, সোনারঙ্গ, টংগিবাড়ি, পুরাপাড়া ইত্যাদি গ্রাম নিয়ে প্রাচীন বিক্রমপুর – রামপাল গঠিত হয়েছিল।
রামপাল নামক এক প্রকান্ড দীঘির পাড়ে প্রাচীন বিক্রমপুরের অবস্থান ছিল। দিঘীটির দৈর্ঘ্য এক মাইলের তিন চতুর্থাংশ এবং প্রস্থে এক চতুর্থাংশ।এই দীঘির উত্তরে অবস্থিত ছিল বল্লাল বাড়ি বা সেনরাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদ। এর ভগ্নাংশই একসময় ছিল প্রায় ৩০০০ বর্গফুট। এখন বোধহয় এটি একটি মাটির ঢিবি মাত্র। চারিদিকে ২০০ বর্গফুটের একটি খাল বেষ্টন করে আছে। এই দীঘির চারিদিকে নানা ভবনাদি ভিত্তি এবং ভগ্নাবশেষ চিহ্ন প্রাপ্ত হয়। বল্লাল রাজবাটীর অভ্যন্তরে একটি স্থান খনন করে একটি অগ্নিকুণ্ড প্রাপ্ত হয়েছে। জনশ্রুতি আছে , সাম্রাজ্যবাদী মরু অত্যাচার থেকে রক্ষার জন্য এক সময় এখানেও জহরের ন্যায় অগ্নি ব্রত পালন করে স্ত্রী , পুরুষ সহ এক রাজপুত্রও প্রাণ দিয়ে স্বীয়ধর্ম রক্ষা করেছিলেন।
আজ রামপাল হতশ্রী। সুপ্রাচীন দালানদি প্রায় দৃষ্ট হয় না। তবে বহু ইষ্টকালয় ও ঘাটলা যে মৃত্তিকাসাৎ হয়েছে তা প্রমাণ পাওয়া যায়। রামপাল হতে সুবচনী খালের পূর্বপার পর্যন্ত যেসকল গ্রামের অবস্থান আছে সেখানে মৃত্তিকার নিম্ন দেশে বহুল পরিমাণে প্রাচীন ইষ্টকাদি দেখতে পাওয়া যায়। উপরি অংশেও ইষ্টক ইত্যাদি পাওয়া যায়। এতদ্বারা প্রমাণিত হয় যে পূর্বে এইস্থানে আঢ্য লোকেদের ব
বাসছিল। নানা সংবাদ , প্রবন্ধ পড়ে জানা যায় যে এইসকল অঞ্চলে ভূমি খনন করে বহু স্বর্ণ ও রৌপ্যপাত এবং ইষ্টকাদি প্রাপ্ত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে জোড়ার দেউল গাঁয়ে জনৈক ব্যক্তি প্রচুর স্বর্ণ গুপ্তধন হিসাবে প্রাপ্ত হয়ে সোনকাপালিয়া নামে খ্যাত হন।
বজ্রযোগিনী সুয়াপাড়া নামক স্থানে ভূমি চাষ করতে গিয়ে একটি উজ্জ্বল প্রস্তর প্রাপ্ত হন। পরে নানা মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদির মাধ্যমে জানা যায় যে ঐ পাথর আসলে একটি হীরক খণ্ড বই অন্য কিছু ছিল না। এ সম্পর্কে টেলার সাহেব লিখেছিলেন – A few years ago a ryott while ploughing a field in this place and found a diamond of the value of Rs 70000 it after wards gave rise to a law suit before the provincial court of Appeal.
উক্ত হীরকখণ্ডটি রামপালের রাজবাটীর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত হয়। ১৩১০ সালের আশেপাশে সুবর্ণ নির্মিত একটি তলোয়ারের খাপ , স্বর্ণ গোলক সহ প্রায় সাত সের ওজনের সোনা প্রাপ্তি হয়। রামপালের নিকটবর্তী রতনপুর গ্রামে জনৈক ব্যক্তি কিছু স্বর্ণ মুদ্রা প্রাপ্ত হন। পরে তা সরকারী সম্পত্তি হিসাবে বাজেয়াপ্ত হয়। জনরবে প্রকাশিত যে, তার সংখ্যাও শতাধিক ছিল।
এবিষয়ে ডক্টর শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় বলেছেন – ” আমি নিজেও রামপালের নানাস্থান হতে নানারূপ ধনরত্ন প্রাপ্তির কথা জানি। ধামদার দীঘির অভ্যন্তর হতে একখানি সোনারপাত নির্মিত একখানি পুঁথি প্রাপ্ত হয়। কিন্তু সেটি গলিয়ে ফেলা হয় বলে শুনেছি। সুতরাং সে সম্পর্কে আমার কোনো তথ্য নেই। একবার এক ব্যক্তি সোনারঙ্গের দেউল থেকে একঘটি মুদ্রা পেয়েছিলেন। সে কলকাতায় গিয়ে গোপনে বিক্রিবাটা করতে গিয়ে জুয়াচোরদের পাল্লায় পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে গৃহে ফেরেন। আরেকবার পঞ্চসার গ্রামের একব্যক্তি ২৪ টি স্বর্ণ ইট বা ফালি পায়। “
আমাদের আলোচ্য শ্ৰী বিষ্ণুর রজত নির্মিত মূর্তিটি বাংলার ১৩১৬ সালে অর্থাৎ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে চূড়াইন গ্রামের মৃত্তিকাভ্যন্তর থেকে প্রাপ্ত হয়। সুতরাং সময়টি ছিল অখণ্ড বঙ্গ তথা ভারতের সময়। বঙ্গভঙ্গ বরোধী আন্দোলনের আঁচে সিক্ত হয়ে সোনার বিপ্লবে ভারত স্বাধীনতার জন্য পুনরায় নব যৌবন লাভ করছে। সেই গাঁয়ের বারুজীবীদের কেউ কেউ বোরোজ নির্মাণের নিমিত্ত একটি শুষ্ক পুষ্করিণী খনন করতে গিয়ে মূর্তিটি প্রাপ্ত হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় মৃত্তিকাভ্যন্তরে থাকার জন্য কেউ নির্ণয় করতে পারেন নি দেব বিগ্রহটি কোন ধাতু নির্মিত! পরে ঢাকা নগরীতে নীত হলে কর্মকারগণ দেবমূর্তির মলিনত্ব দূর করতে গিয়ে প্রকাশিত হয় যে মূর্তিটি রজত নির্মিত।
ক্রমশঃ
তথ্যঃ ১ .বিক্রমপুর -রামপালের ইতিহাস
২.পুরান ঢাকা
৩. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস রজনীকাণ্ড
@দুর্গেশনন্দিনী