পর্ব ৪

বনে রাজকুলে বহ্নিজলপীডায়ুতো নর:
পঠেদারণ্যকং কাণ্ডং শ্রৃণুয়াদ্ বা সমঙ্গলী

বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে অরণ্যকান্ড পাঠ করলে বন , রাজকুল, অগ্নি এবং জলপীড়া ইত্যাদির নাশ হয়। সংসারে মঙ্গল হয় । রামায়ণকে বোঝার নিমিত্ত , একে উপলব্ধি করার নিমিত্ত রামায়ণের অরণ্যকান্ড পাঠ করা একান্ত জরুরি। 

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।

যে গ্রন্থের প্রথম শ্লোক, যে গ্রন্থে প্রথমেই প্রকৃতির সন্তানের জন্য এমন করুণ আর্তনাদ, সেই গ্রন্থ , সেই মহাকাব্য, সেই মহা ইতিহাস প্রকৃতির জন্য , অরণ্যের জন্য না হয়ে কোথায় যাবে ? 

শোকার্তস্য প্রবৃত্তো মে শ্লোকো ভবতু নন্যথা।

নবম শতাব্দীর ধ্বনিকার আনন্দবর্ধন বলেছেন – 

” রামায়ণে হি করুণো রসঃ স্বয়মাদিকবিনা সূত্রিতঃ শ্লোকঃ শ্লোকত্বমাগতঃ ইত্যেবংবাদিনা। নির্বু্্যঢ়শচ স এব সীতাত্যন্তবিয়োগপর্যন্তমেব স্বপ্রবন্ধমুপরচয়িতা ।।”

 শ্লোক শোকত্বলাভ করেছে। এই বলে স্বয়ং আদি কবি রামায়ণে যে করুণরস অঙ্গী তা স্বীকার করেছেন। সীতা বিয়োগ পর্যন্ত স্বীয় কাব্যের বর্ণনা করে তিনি এইকেই নিশ্চিতরূপে প্রতিপাদিত করেছেন। 

রামায়ণ চিরভাস্বর। সমগ্র কাব্যেই করুণরস অধিক নিহিত। তবে বাকি রস তাই বকে সেখানে গৌণ হয়ে যায় নি।রামায়ণে করুণ হতে সুন্দর শৃঙ্গার , হাস্য হতে রৌদ্র হয়ে ভয়ানক রস সকলই বিদ্যমান। অরণ্যকাণ্ডে সেই সুন্দর রসের প্রকাশ ঘটেছে। আদি কবি নিজেকে উজাড় করে অপরূপ প্রকৃতির সুন্দর , শৃঙ্গার রসকে ব্যাখ্যা করেছেন। 

রামায়ণের আসল স্বার্থকতা হল তার প্রকৃতির প্রেমে, জীব প্রেমে, মানবিকতায়, তার কাব্যরসে। 

 স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,

কত সান্ত্বন করো বর্ষণ সন্তাপহরণে ॥
জগতে তব কী মহোৎসব, বন্দন করে বিশ্ব
শ্রীসম্পদ ভূমাস্পদ নির্ভয়শরণে ॥

এই জন্যই রামায়ণ যুগ হতে যুগান্তে, দিগ্ হতে দিগন্তে সূর্যের ন্যায় সমুজ্জ্বল , তাই রামায়ণ উপজীব্য। এই গুনেই রামায়ণ চিরকালের জন্য চিত্তকে জয় করে আসছে এবং পরবর্তী কোন কাব্য এই আদি কাব্য কে অতিক্রম করে যেতে পারেনি । রামায়ণের চরিত্র গুলো হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তাই আজও রামায়ণের প্রকৃতি প্রেম , ভ্রাতৃপ্রেম , মানবপ্রেম, দাম্পত্য ইত্যাদি আদর্শ স্থান অধিকার করে আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

সূর্য চলেন ধীরে

      ​​ সন্ন্যাসীবেশে

পশ্চিম নদীতীরে

      ​​ সন্ধ্যার দেশে

বনপথে প্রান্তরে

      ​​ লুণ্ঠিত করি

গৈরিক গোধূলির

      ​​ ম্লান উত্তরী।

পিঠে লুটে পিঙ্গল

      ​​ মেঘ জটাজূট,

শূন্যে চূর্ণ হ’ল

      ​​ স্বর্ণমুকুট।

সেই পঞ্চবটি। সেই পঞ্চবটি ছিল দন্ডকারণ্যের একটি অংশ। তখন শরৎকাল। শ্রীরাম সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে অগস্ত‍্য‍ ঋষির আশ্রমের দিকে গমন করলেন। পথে ঋষির শিষ্য তাঁদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে নিয়ে গেলেন আশ্রমে। তথায় অগস্ত‍্য‍ মুনি মহা সমারোহে শ্রীরাম, সীতা ও লক্ষ্মণকে আপ্যায়ন করলেন। আহারান্তে কিয়দ্ কাল বিশ্রামের পর ঋষির নিকট কিছু উপদেশ পাওয়ার জন্য শ্রীরাম , সীতা এবং লক্ষ্মণ এসে বসলেন। দেবসুর সংগ্রামের সময়ের কিছু দিব্য অস্ত্র ঋষির নিকট ছিল। তা তিনি রামকে প্রদান করে বললেন, ” এ অস্ত্রের তোমার থেকে ভালো উত্তরাধিকারী কেউ এ জগতে নেই।” 

শ্রীরাম ঋষির হতে প্রাপ্ত সেই প্রসাদ গ্রহণ করে বললেন , ” আপনার অপার করুণা মুনিবর যে, আপনি আমাকে এই সকল দিব্য অস্ত্রের উত্তরাধিকারী হিসাবে চয়ন করেছেন। “

ঋষি তখন বললেন , “না রাম!  এতে করুণার প্রশ্নই আসে না।  আপনারা আমার আশ্রমে আগত এক অসাধারণ অতিথি। আমার হৃদয় আপনাদের দেখে কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।  অনুজ লক্ষ্মণকে দেখে অনুভূতি হচ্ছে যে, তাঁর বিশাল বাহুটি বিশ্বজুড়ে বিজয়ের পতাকা উত্তোলনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। দেবী জানকীর স্বামী-প্রেম  বিশ্বের মহিলাদের জন্য অনুকরণী। আদর্শ এই পরিবার প্রীতি। আদর্শ এই পিতৃসত্য পালন। আদর্শ এবং ধন্য সেই প্রেম যে প্রেমে স্ত্রী রাজনন্দিনী হয়েও স্বামীর সম্মানের জন্য সর্বত্যাগী হয়ে, কঠোর বনে আপনার সাথে চলেছে। আপনারা কেবল মানব সমাজেই নয় দেব, দানব, যক্ষ , কিন্নর , অপ্সরা সকলের যুগ হতে যুগান্তে আদর্শ হয়ে থাকবেন। আপনাদের তিনজনকেই এই আশ্রম মাঝে খুঁজে পেয়ে আমার হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।  আপনি  দীর্ঘ যাত্রা করে এস্থানে উপস্থিত হয়েছেন, আপনি ক্লান্ত ,তাই এখন বিশ্রাম গ্রহণ করুন।  আমার ইচ্ছা এই যে, আপনারা এস্থানে নির্বাসনের অবশিষ্ট সময়টি ব্যয় করুন। এই আশ্রমে আপনার কোনো প্রকার সমস্যা হবে না।”

অগস্ত‍্য‍ মুনির বক্তব্য শ্রবণ করে শ্ৰী রাম প্রণাম করে বললেন, ” হে মুনিরাজ!  আজ, আমার এমন সৌভাগ্য যে , যাঁর দর্শন পাওয়ার জন্য দীর্ঘকাল বড় বড় মহর্ষি সম্রাট, দেব ও দানবরা অপেক্ষা করে থাকেন , তাঁকে আমি এত নিকট হতে স্নেহ বৎসল হিসাবে পেয়েছি। এই সমগ্র বিশ্বে আমার থেকে কে বেশি ভাগ্যবান হবেন? আমরা আপনার দয়া এবং আতিথেয়তার নিমিত্ত কৃতজ্ঞ।  আমরা আপনার আদেশ অনুসরণ করে আজ রাতে অবশ্যই এখানে বিশ্রাম করব, তবে নির্বাসনের অবশিষ্ট সময়টি এই অপূর্ব আশ্রমে ব্যয় করা সম্ভব হবে না।  আপনার তপস্যাতে আমি কোনও বাধা উপস্থাপন করতে চাই না, তবে আপনার সৎসঙ্গ ও উপকার থেকে বঞ্চিতও হতে চাই না।  সুতরাং, দয়া করে আমাকে এই আশ্রমের নিকটে একটি জায়গা বলুন যা ফলের গাছ, স্বচ্ছ জল এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সহ একটি ঘন বন  আছে। সেখানে কুটির বেঁধে  থাকব ”।

 অগস্ত্য মুনি এক মুহুর্তের জন্য ভেবে উত্তর দিলেন, “হে রাম!  আপনি আমার কাছে থাকলে আমার কোনো সমস্যা হবে না।  কিনজ আপনি যদি এখনও নিজের কুটির নির্জন স্থানে গড়ে তুলতে চান তবে এখান থেকে আট ক্রোশ দূরে পঞ্চবটী নামে একটি মহাবন রয়েছে। তার পাশ দিয়ে পবিত্র গোদাবরী নদী পবিত্র হয়েছেন । সেই স্থানটি খুব সুন্দর, শান্তিপূর্ণ, পরিষ্কার এবং ভব্য। ঐ যে মধুক বন দেখতে পাচ্ছেন , ওটি উত্তর দিক থেকে অতিক্রম করার পরে, আপনি একটি পর্বত দেখতে পাবেন। সেইখানে পঞ্চবটি ।  জায়গাটি এতই সুন্দর যে ,এটি খুঁজে পেতে আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। “

সেদিন সন্ধ্যায় আকাশ আলোকিত করে চন্দ্রদেব প্রকাশিত হলে শ্ৰী রাম, সীতা এবং লক্ষ্মণ মুনির আশ্রমে সন্ধ্যার পূজাদি করে রাত্রি বাস করলেন। পরদিন ভৈরবী প্রাতে তাঁরা পঞ্চবটির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। পথে দেখা হল সুবিশাল প্রাচীন পক্ষী অরুণ পুত্র জটায়ুর সঙ্গে। 

পঞ্চবটি বনে উপস্থিত হয়ে রাম অনুজ লক্ষ্মণকে বললেন , ” সৌম্য ! মহর্ষি অগস্ত‍্য‍ আমাদের যে স্থান বর্ণন করেছিলেন  , সেই পরিচয় অনুযায়ী ভব্য স্থানটিতে আমরা পৌঁছে গেছি।  এটিই পঞ্চবটি বনাঞ্চল। সমুখে গোদাবরী স্বচ্ছ সলিলা গোদাবরী নদী প্রবাহিত হচ্ছেন। তুমি কোনো জলাশয়ের নিকট রমণীয় স্থান চয়ন করে কুটির নির্মাণের প্রারম্ভ করো।”

লক্ষ্মণ আশ্রম নিৰ্মাণ করার নিমিত্ত গোদাবরী তটে এক রম্য স্থান চয়ন করলেন। সেখানে বৃক্ষ ও পুষ্পরাজিঅত্যন্ত মনোহর প্রতীত হচ্ছিল। স্থানটি চারিদিকে পুষ্প, গুল্ম, লতাবল্লরী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল।।তথায় শাল, তাল, তমাল, খর্জুর, পনস, জলকদম্ব, তিনিশ, পুংনাগ, আম্র, অশোক, তিলক, কেওড়া, চম্পক, শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দন, কদম্ব, লকুচ ধব, অশ্বকর্ণ , শমি, পলাশ ইত্যাদি বৃক্ষে সমাকীর্ণ ছিল। নিকটস্থ গোদাবরী নদীর বুকে হংস , কারন্ডব ইত্যাদি জলজ পক্ষী খেলা করছে। মৃগের দল গোদাবরীর তটে সকল দিবস জল পানের উদ্দেশ্যে দলবদ্ধ হয়ে আসছে।

তথায়, লক্ষ্মণ শুষ্ক কাষ্ঠ, শুষ্ক ঘাস , কুশ , কাশ ও পুষ্প লতার মাধ্যমে এক অপূর্ব কুটিরের নিৰ্মাণ করলেন। সেই কুটিরের নিকটে সুন্দর লতা প্ল্লব দ্বারা আরো একটি ভব্য কুটির নিৰ্মাণ করলেন। নিৰ্মাণ করলেন এক অপূর্ব স্তম্ভযুক্ত পবিত্র যজ্ঞবেদী। কুটির গৃহের চারিপার্শ্বে কণ্টক যুক্ত লতাগুল্ম দ্বারা বেড়া নির্মাণ করলেন। 

কুটির নিৰ্মাণ সম্পূর্ণ হলে লক্ষ্মণ শ্রীরাম ও সীতাকে আবাহন করে কুটির প্রদর্শন করলেন। ভব্য, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন কুটির দেখে রাম বললেন , ” লক্ষ্মণ তুমি যে বন মাঝে প্রাসাদ রচনা করেছ ভ্রাতা। “

 শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ ও সীতা একত্রে বসে যজ্ঞ কুটিরে হোম করে গৃহপ্রবেশ সম্পন্ন করলেন। পঞ্চবটির সুন্দর পরিবেশে বড় সুখে দুই মাস শরৎ কাল অতিবাহিত হল।

শরৎ গমন অতঃপর হেমন্ত লক্ষ্মী এল। এক হৈমন্তী প্রভাতে শ্রীরাম সীতার সাথে গোদাবরীতে স্নান, আহ্নিক করতে  যাচ্ছিলেন।  লক্ষ্মণ তাঁদের পিছনে কলসী 

নিয়ে অনুসরণ করছিলেন।  গোদাবরীর তীরে পৌঁছে লক্ষ্মণ উপলব্ধি করলেন যে,  হেমন্তকাল  রামচন্দ্রের বড় প্রিয়। তখন তিনি কলসী মাটিতে নামিয়ে বললেন , ” ভ্রাতা , এই হেমন্তঋতু আপনার নিকট বড় প্রিয়।।  আপনি এই ঋতুকে বৎসরের অলঙ্কার বলতেন। সময় এখন শীত ঋতুর  নিকটবর্তী। সূর্যের রশ্মির ক্রমশ স্পর্শ প্রিয় হতে শুরু করেছেন। পৃথিবী হয়ে উঠছেন অন্নপূর্ণা।  উল্লাসে নদী প্রবাহিত হচ্ছেন।  রাজা-মহারাজা তাঁর চতুরঙ্গিনী বাহিনী নিয়ে শত্রুদের পরাজিত করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন।  সূর্যদেবের উত্তরায়ন সমাপ্ত হয়ে দক্ষিণায়ন সূচিত হতে চলেছে। অগ্নির উত্তাপ প্রিয় হতে শুরু করেছে।  রাতগুলি হিমের ন্যায় শীতল হয়ে উঠেছেন।  যব এবং গমের ভরা মাঠে শিশিরের বিন্দুগুলি মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছেন।  শিশিরের জলে পদ সিক্ত হয়ে উঠছে…..”

এই যে শ্রীরাম অগস্ত‍্য‍ ঋষির আশ্রম হতে আট ক্রোশ দূরে গোদাবরী তীরে পঞ্চবটি বনে কুটির নিৰ্মাণ করলেন , সেই স্থান বাস্তুতন্ত্রীয় সাম্যের জন্য আদর্শ স্থান ছিল। এই বন বা মহাবনের  ( যদিও উপঅরণ্য)  তরুলতা , পশুপক্ষীকুল, বনরাজি ও জল – সব কিছুর মধ্যে সুসমাঞ্জস্য ছিল। রামচন্দ্রের  ভাষায় – এই অরণ্যের বৃক্ষ, লতা, গুল্ম , বল্লরী , জল সকলই রমণীয় এবং এখানে সমিধ্ , পুষ্প, কুশ, সলিল সন্নিকটে পাওয়া যায়। ….পুষ্পিত বৃক্ষপরিবৃত রমণীয় গোদাবরী নানা জলজ পক্ষী ও মৃগে শোভিত । প্রফুল্ল তরুশোভিত , ময়ূরনাদিত, বহু কন্দরবিশিষ্ট , পরম মনোহর, দিব্যদর্শন অতু্্যন্নত গিরিসকল দেখা যাচ্ছে। নানা বৃক্ষ, পুষ্প, লতা ও গুল্ম পবর্ত অরণ্য আবৃত ও অলংকৃত করেছেন।

রাম,লক্ষ্মণ ও সীতার পর্ণ কুটির শমীবৃক্ষের শাখা সমূহে আস্তৃত , দৃঢ় বন্ধনে বদ্ধ , কুশ- কাশ- শরপত্র দ্বারা উত্তমরূপে আচ্ছাদিত ছিল। তা অতিশয় এবং নিরতিশয় শোভাবিশিষ্ট এবং তার মৃত্তিকা ভিত্তিরূপে অবস্থিত সমতল এবং স্তম্ভ সকল সুশোভন । এই  বর্ণনা থেকে পর্ণকুটির নির্মাণের উপাদান ও কৌশলের কথা জানা যায়। পঞ্চবটি ও রামের পর্ণশালার পারিপার্শ্বিক বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায় , পঞ্চবটির পর্যাবরণ বা পরিবেশের বাস্তুতান্ত্রিক উপদানগুলির মধ্যে সংহতি ও সুসামঞ্জস্য গোটা পরিমন্ডলে এক শান্তিপূত ও নিবিড় সংহতি গড়ে তুলেছিলেন। 

পঞ্চবটিতে শরতের প্রারম্ভে অরণ্যের শস্য ক্ষেত্রে গম, শালিধান্য , যবের ন্যায় ফসলের সুপক্ক হয়ে ওঠার সুন্দর বিবরণ আমরা বাল্মীকির রামায়ণ হতে প্রাপ্ত হই। বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃঙ্খলের অন্তর্গত জলচর পক্ষী যেমন – ক্রৌঞ্চ , সারস ইত্যাদিরা পাকা ফসলের ক্ষেত্রে শস্যকণা আহারের সময়ে যে নৃত্যপরায়ণ ভঙ্গি প্রদর্শন করত। অর্থাৎ ,পক্ষীদের আচরণ ভঙ্গি – তার কথাও বাল্মীকি উল্লেখ করেছেন। 

পঞ্চবটির বেশ কিছু বৃক্ষ ছিল যা স্বভূমিজ ছিল না। সেই কথা আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি।  বেশ কিছু বৃক্ষ, লতা, গুল্ম , ওষধি ইত্যাদি ভিন্ন স্থান হতে আনয়ন করা হয়েছিল মুনি, ঋষি ও আশ্রমিকদের দ্বারা।  সেগুলি রোপিত ও লালিত হয়েছিল। এর একটিই উদ্দেশ্য ছিল – তাহল , আরণ্যক পরিবেশকে কিঞ্চিত আশ্রমিকদের বসবাসের উপযোগী করে তোলা।

পঞ্চবটি জীবকুলের মধ্যে প্রধান বলে উল্লেখ করা হয়েছে মৃগ , ময়ূর , কারন্ডব ও চক্রবাক।

মূল অরণ্যের স্বভাবিকতা থেকে ঈষৎ পরিবর্তিত পঞ্চবটির বাস্তুতন্ত্রীয় বৈশিষ্ট্য- 

ক) জলের প্রাচুর্য এই অঞ্চল সমৃদ্ধ। জলরাশির উৎস বৈচিত্র্যও ছিল।

খ) বহু সংখ্যায় বিভিন্ন প্রকার গাছপালা , তরুলতারা এই পঞ্চবটি বনকে বৈচিত্র্যময় রূপ দিয়েছিল। এর মধ্যে অনেকগুলিই দৈনন্দিন জীবনে একান্ত প্ৰয়োজনীয়। এই বন বহুপ্রকার ওষধি উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ছিল।

গ)  এই পঞ্চবটি বিভিন্ন পক্ষীর কলরবে মুখর। অর্থাৎ, পক্ষীদের জীবন যাত্রার উপযোগী সর্বপ্রকার উপাদান এখানে বহুল পরিমানে ছিল এবং তা পরিবেশের সঙ্গে পক্ষীকুলের জীবনযাপনের সার্বিক সমতা বজায় রেখেছিল।

ঘ) শান্ত ও দূষণ মুক্ত পরিবেশ বাস্তুতন্ত্রকে ভারসাম্যময় ও সুস্থিত রাখতে সাহায্য করত।

নানা রঙের ফলগুলি সব

     ভুঁয়ে পড়ত পেকে,

ঝুড়ি ভরে ভরে এনে

     ঘরে দিতেম রেখে;

খিদে পেলে দুই ভায়েতে

     খেতেম পদ্মপাতে–

লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার

     থাকত সাথে সাথে।

রোদের বেলায় অশথ-তলায়

     ঘাসের ‘পরে আসি

রাখাল-ছেলের মতো কেবল

     বাজাই বসে বাঁশি।

ডালের ‘পরে ময়ূর থাকে,

     পেখম পড়ে ঝুলে–

কাঠবিড়ালি ছুটে বেড়ায়

     ন্যাজটি পিঠে তুলে।

ক্রমশ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. শ্রীমদ বাল্মীকি রামায়ণ 

২. বাল্মীকি রামায়ণ : উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

৩. প্রাচীন ভারতের পরিবেশ চিন্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.