পর্ব ১
যো দেবো হগ্নৌ যোহপসু
যো বিশ্বং ভুবনাবিবেশ।
য ওষধিসু যো বনস্পতিষু
তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ।
গাছের ছায়ায় বসে বহুদিন, কাটিয়েছি
কোনোদিন ধন্যবাদ দিইনি বৃক্ষকে
এখন একটা কোনো প্রতিনিধি বৃক্ষ চাই
যাঁর কাছে সব কৃতজ্ঞতা
সমীপেষু করা যায়।
ভেবেছি অরণ্যে যাব-সমগ্র সমাজ থেকে প্রতিভূ বৃক্ষকে খুঁজে নিতে
সেখানে সমস্তক্ষণ ছায়া
সেখানে ছায়ার জন্য কৃতজ্ঞতা নেই
সেখানে রক্তিম আলো নির্জনতা ভেদ করে খুঁজে নেয় পথ….
সত্য , যে আমাদের পূর্ব পুরুষরা অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা ধন্যবাদ জানাতেন , তাঁরা প্রণাম করতেন সেই ব্রহ্মকে যিনি অগ্নি, জল, ওষধি , বনস্পতি এবং বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। সেই সুপ্রাচীন কালে , মুনি ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতির শক্তির সঞ্চার ঘটলেই জীবকুলের জীবন ধারণ সম্ভব হবে।
মাতা চ যত্র দুহিতা চ ধেনূ সবদুর্ঘে ধাপয়েতে সমীচী।
ঋতস্য তে সদসীলে অন্তৰ্মহদ্দেবানামসুরত্বমেকম্।।
জীবনে জল, মৃত্তিকার গুরুত্ব, বাস্তুতন্ত্রে জলের ভূমিকা , জলচক্র ইত্যাদি সম্বন্ধীয় ধারণা সকলই বেদ আমাদের প্রদান করেছেন। সুপ্রাচীন ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিগণ প্রকৃতির বক্ষে যেস্থানেই শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছেন সেখানেই তাঁকে উপাসনা করেছেন। সেই শক্তিকে সদাই সকল জীবকুলের থেকে ভীষণ এবং অপরাজেয় তা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন।
চিত্রং দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুর্মিত্রস্য বরন্যস্যাগ্নেঃ।
আহ প্রা দ্যাবা পৃথিবী সূর্য আত্মা জাগতস্তস্থুষশচ।।
বেদে ও উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতি , মন্ত্রের গরিষ্ঠ অংশ জুড়ে আছে আর্তি ও প্রার্থনা। সাধারণ জীবসহ মানবকুলের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্ন , বাসস্থানের সংস্থান এবং শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা এগুলিই ছিল প্রাচীন কালের মানুষদের প্রাথমিক ও প্রধান সমস্যা। এই প্রার্থনা ও আর্তিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। তাই ঋগ্বেদের মন্ত্রের মুনি ঋষিগণ ছিলেন প্রার্থী। তাঁর সকল জীবের মঙ্গলের জন্য অর্থাথী ছিলেন।তবে বেদ উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতির থেকে রামায়ণ গ্রন্থপ্রকৃতি স্বতন্ত্র। রামায়নে আর্তি নেই, পরিত্রানের আবেদন নেই, রামায়ণ – মহাকাব্য …সেখানে মানবকুল জীবন প্রকৃতি পরিবেশ সম্পর্কে ভাবতে শিখেছেন, প্রকৃতির প্রতি বিনয় রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্ববোধের অঙ্কুরে।
সর্বভূতা সমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনিঃ।
তাই রামায়ণে তরুলতা, বৃক্ষরাজি , নদীপর্বত সকলেই সজীব সত্তা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই তো, সীতা হরণের পর রাম সীতার সন্ধানে বৃক্ষলতা , পশুপাখির কাছে সীতার খোঁজ করেছেন, প্রশ্ন করেছেন। ঋষি বাল্মীকি অরণ্যবাসী, তিনি রামায়ণ রচনার সময় ভীষণ ভাবে অরণ্য বৃক্ষের গুরুত্বকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যে ওষধি বনস্পতির মধ্যে প্রকৃতির প্রাণের ক্রিয়া দিবানিশি ঋতুতে ঋতুতে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে ও প্রাণের লীলা অপরূপ মহিমায় প্রকাশিত হয় , তারই মাঝে প্রকৃতিতে ধ্যানপরায়ণ ঋষিরা একটি আনন্দময় রহস্যকে সুস্পষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । বাল্মীকি ছিলেন তাঁদেরই প্রতিভূ। প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সত্তার গভীর আত্মীয়তা উপলব্ধি করতে পেরে প্রাচীন মুনি ঋষিরা বলতে পেরেছিলেন –
যদিদং কিঞ্চিৎ জগৎ সর্বং প্রাণ এজতি নিঃসৃতং।
এই যাকিছু সবই পরম প্রাণ হতে নিঃসৃত হয়ে প্রাণের মধ্যে কম্পিত । সেখানে তাঁরা বাস করতেন যেখানে বিশ্বব্যাপী বিরাট জীবনের সঙ্গে তাঁদের জীবনের অবারিত যোগ ছিল। এই অরণ্য তাঁদের ছায়া দিয়েছে, ফুল ফল দিয়েছে, কুশ সমিধ্ জুগিয়েছে।তাঁদের প্রতিদিনের সমস্ত কর্ম , অবকাশ ও প্রয়োজনের সঙ্গে বনের অর্থাৎ প্রকৃতির আদান প্রদানের জীবনময় সম্বন্ধ ছিল। এই উপায়েই নিজের জীবনকে তাঁরা চারিদিকের একটি বড়ো জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন । চতুর্দিককে তাঁরা কোনোদিনই শূন্য ,নির্জীব বলে ,পৃথক বলে জানতেন না।
বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে দিয়ে আলোক, বাতাস , অন্নজল প্রভৃতি যেসব দান তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন , সেই সব দানগুলি যে মাটির দান নয় , গাছের দান নয় , শূন্য আকাশের দান নয় – একটি চৈতন্যময় অনন্ত আকাশের মধ্যেই তার মূল প্রস্রবণ, এটিই তাঁরা একটি সহজ অনুভবের দ্বারা জানতে পেরেছিলেন । সেই জন্যই তাঁরা নিঃশ্বাস , আলোক, অন্নজল সমস্তই শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। এই থেকেই বোঝা যায় বন ভারতবর্ষের চিত্তকে নিজের নিভৃত ছায়ায় নিগূঢ় প্রাণের মধ্যে কেমন করে লালন করেছেন !
রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য বনবাস নিলেন। কিন্তু রাম সীতার বনবাস কেবল বেদনার ছিল না। তা আনন্দেরও ছিল। বাল্মীকি রামায়ণে অরণ্যের আনন্দকেই বারংবার পুনরুক্তির দ্বারা কীর্তন করেছেন। বনের তরুলতা ,পশুপাখি হৃদয়কে কেবলই আনন্দ দিয়েছেন। এই আনন্দ প্রভুত্বের ছিল না , ছিল সম্মিলনের। তরুলতা সম্বন্ধের বাল্মীকি ও রামসীতা কতটা সচেতন ছিলেন জানেন ? একটি শ্লোক উল্লেখ করলাম – রাজবধূ সীতা বনে চলেছেন –
একৈকং পাদপং গুল্মং লতাং বা পুষ্পশালিনীম্
অদৃষ্টরূপা পশ্যন্তী রামং প্রপচ্ছসাবালা
রমণীয়ান্ বহুবিধান্ পাদপান্ কুসুমোৎকবান্।
সীতাবচনসংরধব আনয়ামাসঃ লক্ষণঃ।
বিচিত্র বালুকাজলাং হংসসাররসনাদিতাম্
রেমে জনকরাজস্য সুতা প্রেক্ষ্য তদা নদীম্।।
যে সকল তরুগুল্ম কিম্বা পুষ্পশালিনী লতা সীতা পূর্বে কখনো দেখেননি তাদের কথা তিনি শ্রীরামকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তাঁর অনুরোধে অনুজ লক্ষ্মণ তাঁকে পুষ্পমঞ্জরী ভরা পুষ্পবৃক্ষ শাখা চয়ন করে এনে দিলেন। বিচিত্র বালুকাজলা হংসসার মুখরিতা নদী দেখে জানকী মনে আনন্দ বোধ করলেন।
তরুলতা সম্বন্ধে নিছক কৌতুহলই নয়, অরন্য বনস্পতির সাাথের কতখানি প্রাণের সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল তার উদাহরণ সমগ্র রামায়ণ জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে। লঙ্কার রাজা রাবণ যখন সীতার গাছপালার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।
আমন্ত্রয়ে জনস্থানং কর্নিকারাংশ্চ পুষ্পিতান্।
সীতা নিবেদন করেছিলেন যাও তোমরা ক্ষিপ্রগতিতে শ্ৰীরামকে সংবাদ দাও যে রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে ।
ভগবান শ্রী রামও সীতা অন্বেষণের প্রাথমিক পর্যায়ে বনরাজিকেই প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি কদম্ব ,বিল্ব ,অর্জুন, কুুরুবক, বকুল , অশোক, তাল , জাম , কর্নিকা প্রভৃতি বৃক্ষের কাছে, পদ্মবনের কাছে সীতার খোঁজ নিয়েছেন। রামায়ণে আছে অজস্র বৃক্ষের নাম। যে কয়েকটি বিস্তৃত অরণ্য ও সুসজ্জিত উদ্যানের বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলিতে বহু গাছের নাম আমরা পেয়ে থাকি ।মুগ্ধ করে বিচিত্রসুন্দর চিত্রকূট ও পম্পাসরোবর অঞ্চল। রামায়ণে বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে কিষ্কিন্ধ্যা ,পঞ্চবটী ,লঙ্কার ভূূবৃত্তান্তের জল সম্পদের বৈচিত্রের কথা। এই বর্ণনাগুলি কে আধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞানের বাস্তব্যবিদ্যা ইকোলজির নিরিখে বিশ্লেষণ করলে আমরা তিনটি মুখ্য ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের বর্ণনা পাই।
রাম অরণ্যে গমন করে চিত্রকূট পর্বতে আশ্রয় নিলেন –
সুরম্যমাসদ্য তু চিত্রকূটং নদীং চ তাং মাল্যবতীং সুতীর্থাং।
ননন্দ হৃষ্টো মৃগপক্ষীজুষ্টাং জহ্নৌ চং দুঃখং পুরবিপ্রবাসাৎ।।
সেই সুরম্য চিত্রকূট ,সেই সুরম্য সুতীর্থা মাল্যবতী নদী, সেই মৃগপক্ষীসেবিত বনভূমিকে প্রাপ্ত হয়ে পূরবিপ্রবাস ত্যাগ করে হৃষ্ট মনে রাম আনন্দ করতে লাগলেন।
দীর্ঘকালোষিতস্তমিন গিরৌঃ গিরিবনপ্রিয়ঃ।।
গিরিবন প্রিয় রাম দীর্ঘকাল সেই গিরিতে বাস করে একদিন সীতাকে চিত্রকূট
পর্বতের শিখর দেখিয়ে বলছেন –
ন রাজ্যভ্ৰংশনং ভত্রে ন সুহৃদর্ভিধিনাভবঃ।
মনো মে বাধতে দৃষ্টা রমনীয়মিমং গিরিম্।।
চিত্রকূট হতে রাম দণ্ডকারণ্য গেলেন । গগনে সূর্য্য মন্ডলের মত দুর্দশ প্রদীপ্ত তাপসাশ্রমন্ডল দেখতে গেলেন। এই আশ্রম শরণং সর্বভূতাম্ । তা ব্রাহ্মী লক্ষ্মী দ্বারা সমাবৃত।
রামায়ণ হতে পরোক্ষভাবে যে সব বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা আলোচনা করার আগে অরণ্য বলতে কী বোঝায় সে প্রসঙ্গে কিয়দ্ ব্যাখ্যার প্রয়োজন। আধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞানের নিরিখে অরণ্য বা বন বলতে একই বিষয়ে বোঝায় না। বন হল সেই অঞ্চল যেখানে একটি বিশেষ ধরনের ইকোসিস্টেমই প্রধান বা তার শতকরা নব্বই ভাগ বা তার বেশি অঞ্চল জুড়ে আছে। অরণ্য বলতে বোঝায় সেই অঞ্চল যেখানে একসঙ্গে একাধিক ইকোসিস্টেম পাশাপাশি অবস্থান করে । সুন্দরবনকে বন বলা হয় কারণ সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম মূলত লবণাক্ত জলে ম্যানগ্রোভ সুন্দরী গরান গেওয়া হোগলা ইত্যাদি বৃক্ষ নিয়ে গঠিত । এদেরকে লবণাম্বু উদ্ভিদ বলা হয়। কিন্তু দণ্ডকারণ্য , আমাজনের অববাহিকার বৃষ্টি অরণ্যকে অরণ্য আখ্যা হয় কারণ সেখানে একাধিক ভিন্ন প্রকৃতিরইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র পাশাপাশি বর্তমান।
রামায়ণ ইত্যাদি প্রাচীন গ্রন্থে অরণ্য এবং বন অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও বন বলতে বোঝাত স্তম্ভ বা ঝোপঝাড়, যেখানে সমশ্রেণীয় এবং সমজাতীয় উদ্ভিদ লতাগুল্মের সমাবেশ ঘটেছে অর্থাৎ পুরোপুরি অরণ্য নয়, উপঅরণ্য বা জঙ্গল । ব্যুৎপত্তিগত অর্থে অরণ্য হল বিজনময়তা , চাষবাস ইত্যাদি বর্জিত দূরজন বর্জিত অঞ্চল । অরণ্যের ভয়াল নির্জনতা সম্পর্কে রাম সীতাকে সতর্ক করেছিলেন ; শ্বাপদ সংকুল অরণ্যে দ্বীপী , সর্প, তরক্ষু, ব্যাঘ্র ,বৃশ্চিকের উপস্থিতি , কণ্টকময় বৃক্ষলতা এবং অরণ্য বাতাসের বিষয় রাম সীতাকে বিশেষভাবে সাবধান করেছিলেন।
রামায়নে বর্ণিত অরণ্যকে চরিত্র অনুযায়ী চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে – যথা : শান্ত , মধুর, রুদ্র ও বীভৎস । নির্দিষ্ট কোনো অরণ্যের সামগ্রিক পরিবেশের মানসিক অবস্থা বা সেন্টিমেন্টকে চিন্তা করে এবং শাস্ত্রীয় চারিরসের কথা মনে রেখেই এই শ্রেণী বিভাগ।
অন্য এক শ্রেণীবিভাগে প্রাচীন ভারতের তিন প্রকারের বা আকারের বনের উল্লেখ পাওয়া যায় । যথা – ক) মহাবন বা অরণ্য খ ) তপোবন এবং গ) শ্রীবন ।
ক ) মহাবন : মহাবন হল গভীর , গহীন , স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ঘন গাছপালাময় স্থান। এই মহাবন বা ঘন অরণ্য পাহাড়-পর্বত এমনকি নাবাল ভূমি জুড়ে থাকে। এতে মনুষ্য বসবাস নেই। জৈব্যবৈচিত্র ও ভেষজবৃক্ষের সম্পদে এই অরণ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
খ) তপোবন : নাম থেকে স্পষ্ট তপবন হলো সেই বনাঞ্চল যেখানে মুনি-ঋষিরা তপস্যা করেন । এখানে ঋষিদের আশ্রম থাকতো । সেখানে আশ্রমবাসী শিষ্যরা গুরুগৃহে থেকে গুরুর কাছে থেকে শিক্ষা লাভ করতেন । শহর , লোকালয় বা জনবসতি থেকে অনেক দূরে বনের মধ্যে অবস্থিত হত এই সব আশ্রম। সেখানে লোকালয়ের মতো ঘন জনবসতি থাকত না। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানবার জন্য সাধারণ মানুষ সেখানে যেতে পারতেন । এই সকল আশ্রম ফুল ও ফলের বিভিন্ন বৃক্ষলতা ও ভেষজ উদ্ভিদে পূর্ণ থাকত। ছায়া সুনিবিড় এসব আশ্রমেই উপনিষদ , আরণ্যক রচিত হয়েছিল। তপোবনে বন্যপ্রাণী অনেক থাকলেও সেখানে প্রাণী হত্যা ছিল নিষিদ্ধ। উদ্ভিদ সম্পদ , বিশেষ করে কোন বিশেষ উদ্ভিদ ও লতা যা প্রয়োজনীয় ও উপকারী – তা একেবারে বিলুপ্ত না হয়ে যায় তার জন্য আশ্রমিকদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল। । যেমন , শকুন্তলার বনতোষিনীর পরিচর্যা।
গ ) শ্রীবন : শ্রীবন ছিল গ্রাম বা শহরাশ্রিত বন। এগুলি মনুষ্য বসতি শূন্য ছিল না । বরং বলা যেতে পারে মনুষ্য বসতি এর অন্তর্গত ছিল এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল রাজকর্মচারী বা পঞ্চায়েতের উপর । মানুষ তার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন – জ্বালানি, ফল, ফুল ইত্যাদি এখান থেকে প্রাপ্ত হতেন। এই সকল বৃক্ষলতাময় শ্ৰীবনে মানুষের প্রবেশাধিকার থাকলেও তাদের অবশ্য কর্তব্য ছিল শ্রীবনের বৃক্ষের সংরক্ষণ , প্রতিপালন- যে সকল বৃক্ষলতাদি কাটা হয়েছে সেখানে নতুন করে বৃক্ষরোপণ এবং বনসৃজন করা।
ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু , অন্যান্য পরিবেশ শর্ত এবং স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী শ্ৰীবনের বিভিন্ন প্রকারের গাছপালা থাকত। এর মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য হল তুলসী গাছ। পূজা তুলসী ব্যতীত হয়না। ভেষজগুণ ও ভূমিকে উর্বর করার ক্ষমতার জন্য সর্বত্র তুলসী গাছ রোপন করা হতো।শ্রীবনে আরো নানা রকম ফলবাগিচা থাকত। অধিকাংশ গাছপালার স্বাভাবিক হলেও কিছু কিছু ছিল স্বাভাবিকৃত। যে সামাজিক বনসৃজন এর কথা আজ আমরা বলি, তার বীজ ভাবনা প্রাচীন ভারতের শ্রীবনের প্রস্তাবনার মধ্যেই আমরা পাই।
শ্ৰীবনের গাছের মধ্যে পাঁচ রকমের গাছ থাকা আবশ্যক ছিল। সেগুলি হল বট ,অশ্বথ বা পিপুল , অশোক , বেল এবং হরিতকী । এসব বৃক্ষরাজির জন্য বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। বটকে ভাবা হয় দীর্ঘ আয়ু ও উর্বরতার প্রতীক রূপে। পিপুল বা অশ্বথ কে ভারতে পবিত্র বলে পূজা করা হয়।
গীতায়, শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “আমি গাছের মধ্যে পিপুল, ঋষিদের মধ্যে নারদ, গান্ধারদের মধ্যে চিত্ররথ এবং সিদ্ধপুরুষদের মধ্যে ঋষি কপিল।” অনেক শাস্ত্র মতে এই বৃক্ষে শিব পার্বতী অধিষ্ঠান থাকেন মনে করা হয়। তবে এটি এমন একটি বৃক্ষ কুড়ি ঘন্টা মত সময় অক্সিজেনের যোগান দেয় । পিপুলের প্রতিটি অংশের ভেষজগুণ আছে ।
অশোক বৃক্ষ বেদনানাশক এবং ছায়াময়। সীতা রাবণের অশোক কাননেই বন্দিনী ছিলেন । বৃক্ষটি বেদনানাশক, সেই কারণেই হয়ত বঙ্গের ও তার পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলিতে পুরনারীগণের মধ্যে চৈত্র মাসে লৌকিক ব্রত হিসাবে অশোকা ব্রত পালন করা হয়।
বেলবৃক্ষ পৃথিবীর পবিত্রতম বৃক্ষ। মহামায়া মহাকালীর দেহ থেকে বেল বৃক্ষের উৎপত্তি। বেল গাছের প্রতি তিনটি পত্র স্বয়ং ব্রম্ভা , বিষ্ণু , মহেশ্বর। বেল ফলে নানান ভেষজ গুণ আছে । শিবপূজা এবং বিবিধ পূজা ও যজ্ঞ বিল্বপত্র ব্যতীত সম্পন্ন হয় না। পঞ্চম হল হরীতকী বৃক্ষ। বিবিধ ভেষজগুণ এবং ব্যাধিনিবারক ধর্মের জন্য সকল ঔষধি বৃক্ষের মধ্যে হরীতকী একটি স্থান অধিকার করে আছে ।
পঞ্চবটি হল পাঁচটি বৃক্ষের সমাহার। শ্রীবনের অন্তর্গত না হলেও প্রতিটি উদ্যান, গ্রাম, নগরে একটি করে পঞ্চবটি অবশ্যই থাকত।
রামায়ণের যে সকল ভূপ্রকৃতির কথা , উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল, জলধারা বৈচিত্র্য ও জলবায়ুর বর্ণনা আছে তা থেকে আমরা তিন ধরনের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমের ইঙ্গিত পাই।
১) ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্য
২) আলপাইন অঞ্চলের সঙ্গে তুলনীয় হিমালয় সন্নিহিত অরণ্য, ওষধি পর্বত , গন্ধমাদন।
৩)লঙ্কার চিরহরিৎ অরণ্য
পরবর্তী পর্বগুলিতে উক্ত অরণ্য , পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রাদি নিয়ে বিশদে আলোচনা করব।
ক্রমশ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. শ্রীমদ বাল্মীকি রামায়ণ
২. বাল্মীকি রামায়ণ : উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
৩. প্রাচীন ভারতের পরিবেশ চিন্তা