একটি বিষয় দীর্ঘদিন ধরেই মনকে বড্ড নাড়া দিয়ে যায় আমরা যারা নিজেদেরকে রাষ্ট্রবাদী বলে বিবেচনা করি তারাই যদি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কি ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে এবং হয়ে চলেছে সে সম্পর্কে উদাসীন থাকি তাহলে সমাজ জাগরণের কাজটি কিভাবে সম্ভব? যাত্রী পরিবহন এবং পণ্য পরিবহন দুটিকে মিলিয়ে বিবেচনা করলে ভারতীয় রেলকে বোধহয় ভারতীয় অর্থনীতির ধমনী বললে অতিশয় উক্তি হবে না। এখন এই রেল নাকি বেচে দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার!
আসুন দেখে নেয়া যাক কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা যা আমি আপনি সকলেই অনুভব করি যেগুলিকে একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই আমরা নিজেরাই বুঝতে পারব প্রকৃত সত্য কোনটি!
আমরা সকলেই এখন লোকাল ট্রেনে অন্তত চড়ি এবং প্রত্যেকেই আইসিএফ লেখা নতুন ডিজাইনের লোকাল ট্রেনের সাথে পরিচিত হয়ে গেছি এবং এই ট্রেনগুলোর গতি এবং যাত্রী স্বাচ্ছন্দ দুটি যে বিগত দিনের লোকাল ট্রেনের থেকে অনেক বেশি সেটা বোধহয় অতি বড় বিরোধীও স্বীকার করবেন। আসলে বর্তমানে লোকাল ট্রেনে যে আইসিএফ কোচ ব্যবহার করা হয় এই আইসিএফ কোচ আগে দূরপাল্লার ট্রেনের ব্যবহার করা হতো, যে ট্রেনগুলি দেখতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীল রংয়ের ছিলো। এখন সেই আইসিএফ কোচ দূরপাল্লার ট্রেনের বদলে লোকাল ট্রেনে ব্যবহার করা হচ্ছে ফলে ওই ট্রেনগুলোর ভালো ভেন্টিলেশনের জন্য যেমন অতি গরমে কষ্ট কমছে সাথে সাথে গতিও বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। এছাড়া লোকাল ট্রেন থামা এবং ছাড়ার ক্ষেত্রে আগে আমরা প্রতি স্টেশনে যে ধাক্কা অনুভব করতাম সেই ধাক্কা এই আইসিএফ কোচগুলিতে আমরা অনুভব করি না; লোকাল ট্রেনও এখন দূরপাল্লার ট্রেনের মত মসৃণ ভাবে থামে এবং দৌড়াতে শুরু করে।
এবার আসা যাক দূরপাল্লার ট্রেনের কথায় আগে আমরা কতিপয়বার হয়তো রাজধানী বা শতাব্দী এক্সপ্রেসে চড়তাম এমনকি অনেকেই দূর থেকে দেখেই রাজধানী আর শতাব্দি এক্সপ্রেসের কোচগুলির আভিজাত্য অনুভব করতাম। এই কোচগুলি বিশেষ ধরনের এই কোচগুলির নাম এল এইচ বি। ধাক্কা তো দূরে থাক বাইরে চোখ না রাখলে এই কোচগুলোতে বোঝাই যায় না ট্রেন চলছে না থেমে আছে। অন্যদিকে আইসিএফ কোচগুলো যেখানে সর্বাধিক ১১০ কিলোমিটার এর বেশি গতিতে চলতে পারত না; এল এইচ বি কোচগুলো ১৫০-৬০ কিঃমিঃ গতিবেগে চললেও যাত্রী স্বাচ্ছন্দ একটুও কমেনা। আবার কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আইসিএফ কোচ গুলো একে অপরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া সম্ভাবনা থাকে কিন্তু এল এইচ বি কোচগুলো এমন প্রযুক্তিতে তৈরি যে এগুলো খুব বেশি ছিটকে যেতে পারে কিন্তু কোন ভাবেই একে অপরের মধ্যে ঢুকে যাবে না, ফলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রাণহানি সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাবে। বর্তমানে পূর্বা এক্সপ্রেস, আজমির এক্সপ্রেস, জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস এর মত অতি সাধারণ মানের ট্রেনগুলোকেও পূর্ণাঙ্গ এলএইচবি কোচে উন্নত করা হয়েছে। ভারতবর্ষের বর্তমানে প্রায় ৯০% ট্রেনই এল এইচ বি কোচে উন্নীত করা হয়েছে। পড়ে আছে কিছু ঐতিহ্যবাহী ট্রেন এবং শর্ট ডিসটেন্স ট্রেন। বিশ্বাস না হলে একদিন সকালের পূর্বা এক্সপ্রেস নিজের মোবাইলে স্পিড মিটার অন করে হাওড়া থেকে আসানসোল পর্যন্ত যাত্রা করে দেখুন আপনার স্পিডোমিটার এই দূরত্বের মধ্যেই অবশ্যই ১৪০-১৪৫ গতি দেখাবে এবং আমরা সকলেই জানি আজ থেকে 10 বছর আগে এই একই দূরত্বের মধ্যে রাজধানী এক্সপ্রেস কখনো ১৩০ এর বেশি গতি তুলতে পারত না। আজ থেকে ১০ বছর আগের অভিজ্ঞতা ছিল দক্ষিণ ভারতের ট্রেনগুলি দ্রুতগামী এবং সময় চলে আর উত্তর ভারতের ট্রেনগুলো সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো। কিন্তু বর্তমানে উত্তর ভারতের ট্রেনগুলির রানিং টাইম কমিয়ে দেয়া হয়েছে তারপরেও অ্যাডভান্স চলছে, উদাহরণ হিসাবে কালকা মেলের কথাই ধরতে পারেন। যেখানে পঞ্চাশের ওপর অ্যাভারেজ স্পিড থাকলেই সেই ট্রেনকে সুপারফাস্ট বলা হতো সেখানে বর্তমানে মুম্বাই দিল্লি রাজধানী সহ ভারতের বেশকিছু ট্রেন 85 কিলোমিটার অ্যাভারেজ স্পিডে ১৫০০ কিলোমিটার এর লং ডিসটেন্স বিলম্ববিহীনভাবে নিয়মিত যাত্রা করছে। বেশ কিছু স্টেশনের মধ্যে এই ট্রেনগুলোর অ্যাভারেজ স্পিড বর্তমানে ১০০ এর উপরে যেখানে আগে ভারতীয় রেলকে একবার ১০০ টাচ করতেই হিমশিম খেতে দেখতাম। এই ট্রেনগুলোর কোচ বর্তমানে আর সাধারণ এল এইচ বি নেই এগুলিকে বিশেষ ধরনের তেজস স্মার্ট কোচে উন্নত করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস আইসিএফ এর আপগ্রেডেড ট্রেন সেট 18 কোচে নিয়মিতভাবে দিল্লি-লখনৌ এবং দিল্লি-কাটরার মধ্যে সর্বাধিক ১৬০ কিলোমিটার গতিতে যাতায়াত করছে। এই পরীক্ষামূলক জার্নি গত দুবছর ধরে সফল হয়েছে এবং অর্থমন্ত্রীর পেশ করা বাজেট এবং রেলমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী এ বছর মোট 75 টি বন্দে ভারত এক্সপ্রেস বা ট্রেন সেট ১৮ রেল ট্রাকে দৌড়ানো শুরু করবে, যেগুলো সেকেন্ড জেনারেশন ট্রেন সেট ১৮ এবং এর গতিবেগ হবে ঘন্টায় 180 কিলোমিটার। অন্তত দুটি সেকেন্ড জেনারেশন ট্রেন সেট ১৮ ট্রেন আমরা আগামী আগস্ট মাসেই অর্থাৎ আর এক মাসের মধ্যেই দেখতে পাবো। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছরের পরে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা আরো ৪০০ টি থার্ড জেনারেশন ট্রেন সেট ১৮ রেলওয়ে ট্রাকে দৌড়াতে দেখবো যার গতিবেগ হবে ঘন্টায় ২২০ কিলোমিটার। বিশেষভাবে মনে করাতে চাই এই প্রজেক্টগুলো কোন বুলেট ট্রেন প্রজেক্ট নয় এগুলো সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় প্রযুক্তিতে তৈরি পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় প্রজেক্ট। এছাড়া সমস্ত রাজধানী গুলোকেই তেজস রাজধানী স্মার্ট কোচের রূপান্তরিত করা হবে। ১৯৬৯ সালে প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস হিসেবে দৌড় শুরু করা “দা কিং”, হাওড়া রাজধানী এভারেজ ১০০ কিমি গতিতে তেজস স্মার্টকোচ সহ আগামী কিছু মাসের মধ্যেই হাওড়া দিল্লি রুটে দৌড়ানো শুরু করবে, ১৫০০ কিমি দূরত্ব ট্রেনে ১০০ কিমির অ্যাভারেজ গতি ভারতের মতো দেশে যেখানে রেলওয়ে ট্রাক এলিভেটেড ও নয় দুদিক দিয়ে ঢাকা ও নয় সেখানে যে কতটা মারাত্মক সেটা বোধহয় অতি বড় বিরোধীরও বোঝা উচিত।
বুলেট ট্রেন প্রজেক্ট, ট্রেন গুলির ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশন, টয়লেটের উন্নয়ন ইত্যাদি দীর্ঘ পরিধি এবং ধৈর্যচ্যুতি এর কথা এই লেখাতে বাদই রাখলাম ।
এবার ভাবুন যে রাজধানী সাধারণ এলএইচবি কোচে চলত সেই ট্রেনগুলোকে তেজস স্মার্ট করে দেয়া হচ্ছে, যে দূরপাল্লার ট্রেনগুলো আইসিএফ করছে চলতো সেগুলোকে এলএইচবি করে দেয়া হচ্ছে, লোকাল ট্রেনের জন্য আইসিএফ কোচ তৈরি হচ্ছে। এখন সারা ভারতে ছড়িয়ে থাকা পুরানো দূরপাল্লার আইসিএফ কোচ গুলোর কি হবে?
এজন্যই বর্তমানে ভারত গৌরব প্রজেক্ট এর মাধ্যমে প্রাইভেট ট্রেন চালানোর কথা ভাবা হয়েছে এই আইসিএফ কোচগুলোকে টেন্ডার করে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে এবং শর্ত দেয়া হচ্ছে এক্কেবারে নতুন কোন রুটে সম্ভব হলে তীর্থস্থান গুলিকে সংযুক্ত করে এই ভারত গৌরব ট্রেন চালাতে হবে। ট্রেনের ইন্টিরিয়ার ডেকোরেশন থেকে খাওয়া-দাওয়া এমনকি সিকিউরিটির একটি অংশ ওই বেসরকারি কোম্পানিকেই বহন করতে হবে। কোনভাবেই চালু কোন রুটে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে ট্রেন চালাতে দেয়া হচ্ছে না।
ভারতবর্ষের চিরকাল যে অংশগুলো বেসরকারিকরণ করা হয়েছে বেসরকারি সংস্থাকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দেয়া হয়েছে, বেসরকারি সংস্থাগুলো উন্নত তর বা উন্নততম প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে এবং সরকারি সংস্থাগুলি মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি নিয়েই পড়ে থেকেছে। এই প্রথমবার বেসরকারি সংস্থাকে এমন ব্যবসায় আনা হচ্ছে যেখানে তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে ফেলে দেয়া সরকারি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে শুধু তাই নয় লাভ-ক্ষতি তাদের নিজেদের ব্যাপার ভারতীয় রেল ট্রেনের কোচ বিক্রি করে বা নিজে দিয়ে যেমন টাকা পাচ্ছে তেমন ওই ট্রেনগুলো প্রতি একবার দৌড়ালে ভারতীয় রেলের ঘরে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেটি ওই ট্রেনের লাভ বা ক্ষতি যাই হোক। শুধু তাই নয়, এতদিন পর্যন্ত সরকারি সংস্থা যেমন ধরুন বিএসএনএল তারা অলাভজনক প্রত্যন্ত প্রান্তে পরিষেবা দিত আর লাভজনক প্রান্ত গুলো তুলে দেয়া হতো বেসরকারি সংস্থার হাতে অথচ এখানে ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক প্রান্ত গুলোতে ভারতীয় রেলই পরিষেবা দেবে বেসরকারি সংস্থাকে খুঁজতে হবে এমন কোন রুট যেখানে সরকার পরিষেবা দিতে সমর্থ্য হয়নি।
এরপরেও আপনি বলতে পারেন “রেল বেচে দিচ্ছে” ভারতীয় সংস্কৃতিতে এটা হয়তো আপনার অধিকার কারণ আমরা সকলের মতই সহ্য করি কিন্তু দয়া করে একবার ভেবে দেখবেন ১৯৬৯ সালে প্রথম রাজধানী দৌড়ানোর পর ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেই রাজধানী এক্সপ্রেসই ভারতের সবথেকে আভিজাত্যপূর্ণ প্রিমিয়ার ট্রেন ছিল। অথচ ১৯৬৯ সালে ভারতবর্ষের প্রতিটি গ্রামে একটি রেডিও ছিল না, তারপর রেডিও থেকে সাদাকালো টিভি, সাদা কালো টিভি থেকে কালার টিভি, কালার টিভি থেকে কেবল টিভি, কেবল টিভি থেকে বর্তমানের স্মার্ট টিভি। এটি একটি ক্ষেত্রেই নয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ৪৫ বছরে আমরা অন্তত পাঁচটি প্রযুক্তিগত জেনারেশন এগিয়ে এসেছি, কিন্তু ভারতীয় রেলকে রাজনীতিগতভাবে ব্যবহার করে একটি প্রযুক্তিগত জামানার পঙ্কিল জলে আটকে রাখা হয়েছিল মানুষের স্বার্থে নাকি আপনাদের ভোট রাজনীতির স্বার্থে সেটা এই জুলাই মাসে বিকাল চারটার সময় নিউ দিল্লি স্টেশনে দাঁড়ালেই বুঝতে পারা যায় একই সময় 6-7 নম্বর প্লাটফর্ম থেকে শিয়ালদা ও হাওড়া গামী রাজধানী ছাড়ে যাতে একটি সিটও ফাঁকা থাকে না; আর ওই একই সময়ে এক নম্বর প্লাটফর্ম থেকে পূর্বা এক্সপ্রেসের বিশেষ করে স্লিপার ক্লাসগুলি ফাঁকা অবস্থায় জুলাই-আগষ্ট মাসে রাজধানীর আধঘন্টা আগে যাত্রা শুরু করে। আর যারা বিমানে যাত্রা করেন সেটাও বিজনেস ক্লাসে এবং অবশ্যই সরকারি খরচে তারা স্লিপার ক্লাসের ভাড়া বৃদ্ধির জন্য সংসদে আন্দোলন করেন মানুষকে এটা বুঝতে দেয়া হয় না তারা কোন ধরনের পরিষেবা পেতে চান।