কথায় বলে– অতি চালাকের গলায় দড়ি।
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর অবস্থা হয়েছে তাই। রাজনীতিতে অকালপক্ক নেহর – গান্ধী পরিবারের রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের পুরস্কার এই ‘পাপ্পু’ গান্ধী ভারতীয় রাজনীতি তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ময়দানের তুখোড় খেলোয়াড় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর সঙ্গে পাঙ্গা দিতে গিয়ে একেবারে ল্যাজে-গোবরে নাস্তানাবুদ হয়ে গেলেন। অবস্থা এমনই যে শুধু জেদ বজায় রাখার জন্য মাঝেমধ্যে অতি ক্ষীণ কণ্ঠে স্লোগান তুলছেন—‘চৌকিদার চোর হ্যায়’।
হ্যাঁ যত কাণ্ড ওই ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগানটিকে ঘিরেই। কংগ্রেস সভাপতি ওই স্লোগানটিকে মূলধন করেই এবারের লোকসভা ভোটে ঝাঁপিয়েছিলেন এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, স্লোগানটি বেশ জনপ্রিয়ই হয়েছিল ‘চ’ এর অনুপ্রাসের জোরে। কিন্তু ওই ‘চ’এর অনুপ্রাসে অনুপ্রাণিত স্লোগানটির জন্যই ভারতবর্ষের শীর্ষ আদালতের শীর্ষতম বিচারকের কাছেই তাকে চড় খেতে হবে, তা তিনি নিজেও বোঝেননি। এখন দু’হাত জোড় করে আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। প্রকারান্তরে ক্ষমা চাইছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছেই, কারণ রাহুল গান্ধীর আবিষ্কৃত ‘চোর চৌকিদার’ অভিযোগটি চাপানো হয়েছিল সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদীজীর ওপরই।
ঘটনাটা একটু খুলেই বলা যাক। এবার লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের মোক্ষম অস্ত্র হলো রাফাল যুদ্ধবিমান দুর্নীতি। রাহুল গান্ধী অভিযোগ তুলেছিলেন, রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে রীতিমতো বড়ো মাপের দুর্নীতি হয়েছে এবং কোটি কোটি টাকার এই দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই রাহুল গান্ধী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার হাল হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন এই রাফাল দুর্নীতিকে এবং এটিকেই পাখির চোখ করে তিনি নরেন্দ্র মোদীকে ‘চোর’ প্রতিপন্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কারণ মোদীজীর পাঁচ বছরের প্রশাসনে ভারতবর্ষে যে ‘নয়া প্রশাসনের অভিজ্ঞতা মানুষ সঞ্চয় করেছে, তার সঙ্গে লড়তে গেলে সত্যি বা মিথ্যে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা এবং বাজার গরম করা ছাড়া যে নান্য পন্থা অয়নায় — তা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি।
কিন্তু বিধি বাম। যে দুর্নীতি হয়ইনি, তাকে প্রমাণ করবেন কীভাবে? অতএব সুপ্রিম কোর্টের প্রাথমিক নিরীক্ষণেই প্রমাণ হয়ে গেল, রাহুল গান্ধীর অভিযোগ নিতান্তই নিম্নমানের একটি রাজনীতি। রাহুল গান্ধীর কাছে এটা ছিল একটা বড়ো ধাক্কা। কিন্তু প্রায় হারিয়ে ফেলা তুরুপের তাসটি রাহুলজীর হাতে ফিরে এল যখন বিভিন্ন নথি সহ একটি বহুল প্রকাশিত সংবাদপত্র প্রকাশ করল যে রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে।
অতএব খুব স্বাভাবিক নিয়মেই সুপ্রিম কোর্ট পুনরায় রাফাল মামলাটি চালু করল এই কারণে যে তারা সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যাদি যাচাই করে দেখতে চান।
সুপ্রিম কোর্টের এই ঘোষণার পরেই রাহুল গান্ধী হাতে চাঁদ ফিরে পেলেন এবং পুনশক্তিতে বলীয়ান কংগ্রেস সভাপতি জোর গলায় ঘোষণা করেছিলেন— তিনি যা বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টও তাই বলেছে— চৌকিদার চোর হ্যায়।
অতি উৎসাহী এবং অনভিজ্ঞ রাজনীতির ফল এটাই। বিজেপি সাংসদ মীনাক্ষী লেখি ছুটলেন আদালতে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ নিয়ে। কারণ সুপ্রিম কোর্ট রাফাল মামলার তথ্য যাচাই করবে বলে ঘোষণা করলেও, শীর্ষ আদালতে কখনই বলেননি, চৌকিদার চোর হ্যায়। অতএব আইনি জালে ফেঁসে গেলেন রাহুল গান্ধী। এবং সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার নোটিশ জারি করলেন রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে। বিপাকে রাহুল। হাতজোড় করে তাকে শীর্ষ আদালতে জানাতেই হলো— “উত্তেজনার বশে বলে ফেলেছিলাম। ভেবেচিন্তে নয়। সুপ্রিম কোর্টকে কোনোভাবেই রাজনীতির মধ্যে আনতে চাই না। এর পরেও ন্যায় বিচারের স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট যা রায় দেবে, তা মাথা পেতে নেব।”
সেই সঙ্গে আরও বলেছেন, “আদালতে কোনও মামলায় নিজেদের সওয়ালের সপক্ষে রায় বা নির্দেশ হলে যে কোনো সাধারণ লোক যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেন, আমিও তাই দিয়েছিলাম ইচ্ছাকৃত বা ভেবেচিন্তে বলিনি। দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব হওয়ার পাশাপাশি ১৩০ বছরের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হওয়ার সুবাদে আমার মন্তব্যের রাজনৈতিক ও আইনি কী ব্যাখ্যা হতে পারে, সর্বোচ্চ আদালত তা শুধরে দেওয়ায় কৃতজ্ঞ। আদালতের এই অবস্থান মাথা নত করে আমি স্বীকার করছি।”
হ্যাঁ মাথা নত করেছেন রাহুল গান্ধী। শুধু সুপ্রিম কোর্টের কাছেই নয়। এ নতিস্বীকার মোদীজীর কাছে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সর্বোপরি দেশের জনগণের কাছে, কারণ রাহুল গান্ধী মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলেন সেই মানুষটি সম্পর্কে যিনি ২০১৪ সালের ক্ষমতার তখতে বসেই প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন যে তার চুরি করার দরকার নেই, কারণ তার কোনও পরিবার নেই। বলেছিলেন, “I am a detached person. I have no attachment.”
শেষ পর্যন্ত দেশের শীর্ষ আদালত কী পদক্ষেপ নেয় তার জন্য অপেক্ষমাণ দেশবাসী। কারণ শ্রীমতী মীনাক্ষী লোখি শীর্ষ আদালতের কাছে আবেদন করেছেন, রাহুল গান্ধী যা করেছেন তা জেনে শুনে ভেবেচিন্তেই করেছেন। আদালতের নির্দেশ
পড়ে এভাবে মন্তব্য করা দায়িত্বহীনতার পরিচয়। সুতরাং শীর্ষ আদালত এ ব্যাপারে যেন কড়া পদক্ষেপ নেন যাতে ভবিষ্যতে কোনো রাজনীতিবিদই এভাবে কোনো আদালতকেই অপমান করতে না পারে।
কিন্তু লজ্জার বিষয়, এত ঘটনার পরও রাহুল গান্ধী চিৎকার করে যাচ্ছেন রাফাল দুর্নীতির অভিযোগ তিনি তুলে নিচ্ছেন না। কারণ দুর্নীতি তিনি প্রমাণ করবেনই। আসল ঘটনা হলো, এই একটি ইস্যুকেই তিনি মূলধন করেছেন এবারের নির্বাচনে। সেটা হাতছাড়া করলে তো পুরো নির্বাচনটাই জলে যাবে! অতএবশীর্ষ আদালতের কাছেমুণ্ডিতমস্তকে ক্ষমা চাইলেও তিনি ফের বেলতলায় যেতে রাজি। কারণ শাস্ত্রেই বলেছে— মরণকালে মানুষের বুদ্ধিনাশ হয়। রাহুল গান্ধীর তাই হয়েছে। গোটা দেশ যখন মোদী আবেগে ভাসছে, তখন কংগ্রেসের কাণ্ডারি হয়ে তিনি শুধু নিজেই ডুবছেন না, ডোবাচ্ছেন দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসকে। পরিবারতন্ত্রের বিপদ যে কী ভয়ানক এবার আশা করি তাবড় কংগ্রেস নেতৃত্ব তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
ইতিমধ্যে বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মনিয়ম স্বামী তো ঘোষণা করেই দিয়েছেন, রাহুল গান্ধী এবং সোনিয়া গান্ধীকে তিনি জেলে ঢুকিয়েই ছাড়বেন। কারণ তারা দুজনেই খ্রিস্টান এবং তারা দুজনেই একাধিক পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তাঁর নথিসহ অভিযোগ, রাহুল গান্ধীর আসল নাম রল ভিঞ্চি (Raul Vinci) এবং সোনিয়া গান্ধীর আসল নাম আন্তোনিয়া মিয়ানো। শুধু তাই নয়, রল ভিঞ্চি নামে বিদেশি কালজে পড়াশুনা করার সময় রাহুল গান্ধী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং নীতিনির্ধারণ বিষয়ে ফেল করেছিলেন। ফলে তিনি এম ফিল ডিগ্রিটি আর হস্তগত করতে পারেনি।
এহেন ভয়ংকর অভিযোগের মুখে দাঁড়িয়ে রাহুল গান্ধী এখনও নির্বাচনী সমাবেশে মোদীজীকে লাস্য করে বলে চলেছেন—“চৌকিদার চোর হ্যায়।এর থেকে ঘৃণ্য নির্লজ্জতা আর কী হতে পারে?
এইমুহূর্তে কংগ্রেস তথা দেশের আপামর। কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দের সামনে সবচেয়ে বড়ো বিপদ দলীয় সভাপতি স্বয়ং। যদি সত্যি প্রমাণ হয়, রাহুল গান্ধী নাম ভাড়িয়ে বিদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, যদি সত্যিই প্রকাশ্যে আসে যে তিনি জাল পাসপোর্টের এবং জাল শিক্ষাগত সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরছেন, সেদিন তো গাটা দলটাই তাসের ঘরের মতো উড়ে যাবে জনরোষের ঝড়ে।
শুধু রাহুল গান্ধীই নয়, সুব্রহ্মনিয়ম স্বামী ইতিমধ্যেইমামলা দায়ের করেছেন কংগ্রেসের সদস্যা প্রাক্তন সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধেও। তার অভিযোগ ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেশ করার সময় তিনি তার সম্পত্তির বিষয়ে মিথ্যা তথ্য পেশ করেছিলেন। এমনকী টাইমস অব ইন্ডিয়াতেও একবার প্রকাশিত হয়েছিল, ইতালিতে তাদের ২৩,২০,১১০ টাকার সম্পত্তি আছে এবং দিল্লির দারামন্দি গ্রামে সোনিয়া গান্ধীর যে জমি আছে তার আর্থিক মূল্য ৭,২৯,৬১,৭৯৩ টাকা।
কংগ্রেস বরাবর পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি করে এসেছে। দল নয়, কংগ্রেসের কাছে সবচেয়ে বড়ো নেহরু-গান্ধী পরিবার। তার ফল এসব অভিযোগ। তার ফল দলের এই সব অধঃপতনের লক্ষণ সমূহ।
এখন রীতিমতো ঝড়ের মুখে কংগ্রেস। একদিকে মোদী ঝড়। অন্যদিকে কংগ্রেসের ভুলের ঝড়। গোটা দলটাই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবার মুখে। ঠিক এইভাবেই ভারতবর্ষের একদা বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠনটির সাংসদ-শক্তি ২০১৪-তে এসে ঠেকেছিল ৪৪-এ। এবার হয়তো আরও কমবে। কমতেই থাকবে যতদিন না কংগ্রেস নেহরু- গান্ধী পরিবার-প্রীতি থেকে মুক্ত হচ্ছে। যতদিন না কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর আইকন তথা ব্র্যান্ড লোগো থেকে মুক্ত হচ্ছে। যতদিন না কংগ্রেস বুঝতে পারছে, ভারতীয় রাজনীতিতে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিবর্তন আসছে। বস্তাপচা পারস্পরিক অভিযোগের অঙ্ক নিয়ে বিরোধী রাজনীতির পালে হাওয়া পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে আগে প্রয়োজন দলটির নিজেদের সংশোধন। তা না হলে অভিযোগকে মূলধন করে এগোতে গেলে পালটা অভিযোগের পাহাড় ভেঙে পড়বে কংগ্রেসের ওপরই। কারণ ৭২ বছরের পাপ— তার বোঝা তো কম নয়!
রাহুল গান্ধীজী— একটু ভাবুন। একটু বুঝুন। মাঝে মাঝে তো আপনি নিখোঁজ হয়ে যান। একবার হিমালয়ে যান। নিশ্চিন্তে ধ্যান করুন। মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা করুন। দেখবেন, আর বলতেই ইচ্ছে করবে না— চৌকিদার চোর হ্যায়। বলতে ইচ্ছে করবে— চৌকিদার ভগবান হ্যায়।
সনাতন রায়
2019-05-02