২০১৪-র পর মোদী-শাহের জুটি অপ্রতিরোধ্য ছিল, দেশের প্রায় সবকটি রাজ্যে পদ্ম ফুটছিল। কংগ্রেসের পঞ্জাব জয়ের কৃতিত্ব পুরোটা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহের ছিল, রাহুলের তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না। তিন রাজ্যে কংগ্রেসের বিজয় সম্পূর্ণ বিজেপির প্রতিষ্ঠান বিরোধী ছিল এবং ছত্তিশগড় ছাড়া মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে কংগ্রেসের ভোটের ব্যবধান খুব নগণ্য ছিল। যাই হোক খোদ মোদীজীর গড়ে গুজরাট বিধানসভায় কংগ্রেস পরাস্ত হলেও রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতীয় পর্যায়ে খুব বাহাবা কুড়িয়েছিল। কিন্তু তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সীমিত যা বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে পরিচয় দিয়েছেন। তাই কংগ্রেস বাধ্য হয়ে বোন প্রিয়াঙ্কাকে উত্তরপ্রদেশের কামান কাঁধে নিতে হয়। পুলওয়ামা হিংসায় মোদী যখন পাকিস্তানকে একের পর এক মোক্ষম জবাব দিচ্ছিলেন রাহুল এবং কংগ্রেসের ভূমিকা তখন হাস্যকর ছিল। প্রধানমন্ত্রী এবং সেনার পরাক্রমের উপর রাহুল গান্ধীর সন্দেহ পাকিস্তানের মিথ্যা দাবিগুলোকে আরও পোক্ত করছিল।রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস হয়তো ইতিমধ্যে ভুলে গেছে ১৯৭১-এ যখন ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানকে দু টুকরো করেছিলেন বিরোধী দল এবং সব দলনেতা তখন মহান সংসদে দাঁড়িয়ে শ্রীমতী গান্ধীকে ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। রাহুল গান্ধী সেই বিচক্ষণতা দেখাতে পারেননি। তাই রাহুল গান্ধী এবং বিরোধী ব্রিগেডের নেতিবাচক কার্যকলাপকে মোদী সহজে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করতে পারছেন।
কাশ্মীরে এমনিতেই টানটান উত্তেজনা চলছে, এই সুযোগে রাহুল নিজেদের ছবি আরও স্বচ্ছ করতে পারতেন, কিন্তু কংগ্রেস যে লোকসভার ইস্তেহার প্রকাশ করেছে তাতে পিডিপি এবং ন্যাশনাল কনফারেন্সের দাবিগুলো স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাদের ইস্তেহারে অন্যতম ইস্যুগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে দেশদ্রোহ আইন অর্থাৎ ১২৪ (এ) বাতিল করা, কাশ্মীর থেকে আফস্পা বাতিল ও সেনা শিথিলকরণ, সন্ত্রাসবাদী ও হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা, কাশ্মীরের ৩৭০ এবং ৩৫ (এ)-কে আরও শক্তিশালী করা, রাফাল চুক্তি বাতিলকরণ ইত্যাদি। কংগ্রেসের এই ইস্তেহারে মেহবুবা, ফারুক আব্দুল্লারা অনেক খুশি, উপত্যকায় হয়তো কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কও কিছুটা পোক্ত হবে কিন্তু সামগ্রিকভাবে পুরো দেশে গেরুয়া ব্রিগেড কংগ্রেসকে দেশদ্রোহী হিসাবে উপস্থাপনা করার সুযোগ পেয়েছে। এটা রাহুল গান্ধীর অপরিপক্কতা ছিল না কি! কিন্তু মোদী-শাহ বিজেপির ইস্তেহারে কাশ্মীর ইস্যুকে অত্যন্ত। বিচক্ষণতায় উপস্থাপন করে বিজেপিকে একমাত্র জাতীয়তাবাদী দল হিসাবে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে কাশ্মীরে ধারা ৩৭০ এবং ৩৫ (এ)-র বিলুপ্তি, সন্ত্রাসবাদে আপোশহীনতা, সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ, কাশ্মীরি হিন্দুদের প্রত্যাবর্তন প্রভৃতি দেশহিতের ইস্যু স্থান পেয়েছে। স্বভাবতই এরকম ইস্তেহারে মুফতি-ফারুকের গাত্র দহন হচ্ছে কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভোটব্যাক্সে বিজেপি লাভবান হচ্ছে। কারণ কাশ্মীরের তিনটি লোকসভা আসন বিজেপির হাতছাড়া হলেও জম্মুতে তিনটি আসন তাদের পোক্ত হচ্ছে, তৎসঙ্গে বিজেপির জাতীয়তাবাদী চেহারা পুরো দেশের নির্বাচনে প্রভাব ফেলছে।
দেশের এই জাতীয় নির্বাচনে প্রত্যেক প্রার্থী স্বতন্ত্র, স্বাভাবিকভাবে যেকোনো আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই পারেন। সেই অনুসারে রাহুল গান্ধী এবার আমেথির সঙ্গে কেরলের ওয়ানাড আসন থেকে লড়ছেন। যেকোনো প্রার্থী একটি, দুটি কিংবা তিনটা আসন থেকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, সেখানে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। যেমন দলের শক্তিশালী প্রার্থী কোন কেন্দ্র থেকে লড়লে আশেপাশের এলাকাগুলো প্রভাবিত হয়, প্রার্থীর রিস্ক ফ্যাক্টর কমে যায়। অর্থাৎ একটিতে হারলেও অন্যটিতে সম্ভাবনা থাকে ইত্যাদি। রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে আমেথির জেলা কংগ্রেস তাকে সতর্ক করে দেয় যে এলাকার জমি এবার কংগ্রেসের জন্য তেমন উর্বর নয়। বলতে গেলে আমেথি, রায়বেরেলি কংগ্রেসের পারিবারিক আসন, সেই সুবাদে মায়া- অখিলেশের গঠবন্ধন কংগ্রেসিদের দুটি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। দিল্লি জয় করতে রাজনৈতিক মহারথীরা উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনকে লক্ষ্য রেখে সেখানে নিজের ভাগ্য পরখ করতে আসেন। রাহুল আমেথিতে ২০০৪ থেকে অনবরত ৩ বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এর আগেও মা সোনিয়া গান্ধীর রণভূমি ছিল আমেথি। বিজেপি ১৯৯৮-এর পর সেখানে আর জিততে পারেনি। এরপরেও রাহুল গান্ধীর অন্য রাজ্য প্রস্থানের কারণ স্মৃতি ইরানির রণহুংকার নয়, স্মৃতি ২০১৪-র লোকসভায় রাহুলের কাছে মাত্র এক লাখ সাত হাজার ভোটে পরাজিত হন, সেখানে ২০০৯-এ রাহুল গান্ধী ৩ লাখ সত্তর হাজার উপর ভোটে জয়ী হয়েছিল।
সুতরাং স্মৃতির এই হারকে বিজেপি নেতৃত্ব নৈতিক জয় হিসাবে মেনে নিয়েছিল। সম্ভবত সেই কারণে আমেথিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ সব সময় স্মৃতি ইরানির সমর্থনে জনসংযোগ করেছিলেন। স্মৃতি ইরানির রাজনৈতিক জমি পোক্ত করতে শুধু এই লোকসভা অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ৫৩৮ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। অতীতে কংগ্রেসের বিভিন্ন দুঃসময়ে ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী পৃথক পৃথক আসন থেকে নির্বাচনে লড়ছিলেন কিন্তু কাউকে কেরলে যেতে হয়নি। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের যুক্তি ওয়ানাড কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুর মধ্যবর্তী এলাকা, ফলে তিন রাজ্যের ভোটাররা যথেষ্ট প্রভাবিত হবেন এবং ওয়ানডের স্থানীয় নেতৃত্বের চাহিদাও রাহুলের প্রতি। কিন্তু যুক্তিগুলো খুব একটা সঙ্গত নয়, কেননা কর্ণাটকে এমনিতেই কংগ্রেস-জেডিএসের জোট সরকার চলছে, তামিলনাড়ুর স্টালিনদের সঙ্গে রাহুলের সুসম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া কেরলের ওয়ানডে ছোটো গান্ধীর নির্বাচনে লড়া মানে বামদের সঙ্গে ঝামেলা পাকানো যারা কিনা মোদী বিরোধী জোটে রাহুল গান্ধীর সঙ্গ দিয়ে আসছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৪-এর জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস ওয়ানডে মাত্র ২০,০০০ ভোটে জয়ী হয়েছিল, যেটা খুবই দুর্বল। প্রার্থক্য। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে। কংগ্রেসের যুবরাজকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ রণভূমিতে পাঠানোর উদ্দেশ্য কী! ওয়ানাড লোকসভা কেন্দ্রে ৪৯% মুসলমান, ৪৯% হিন্দু, বাকিরা খ্রিস্টান। মানা যাচ্ছে সংখ্যালঘু । ভোটে অধিক বিশ্বস্ততা এবং পুরো দেশে। ধর্ম নিরেপক্ষতার ছবি আরও স্পষ্ট করা কংগ্রেসের ওয়ানডের মুখ্য উদ্দেশ্য।
গত লোকসভা নির্বাচনে হারের পর কংগ্রেসের এন্টোনি কমিটির এক রিপোর্টে বলা হয় কংগ্রেস সংখ্যালঘুদের পার্টি হওয়ার তকমায় ভোটে বিপর্যয় ঘটেছিল। তারপর আমরা অবশ্যই দেখেছি সোমনাথ মন্দির সহ। একাধিক মন্দিরে রাহুল গান্ধীর বিচরণ, পৈতাধারী ব্রাহ্মণ হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করা ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে দলের সংখ্যালঘু নেতাদের কাছে কিছুটা অপ্রিয় হলেও হিন্দি ও হিন্দু অধ্যুষিত রাজ্যে। কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক যথেষ্ট ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। তাহলে ওয়ানডে দাঁড়ানো কি এই সমস্ত হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে।
ওয়ানডে রাহুল গান্ধীর মনোয়ন দাখিল মোটেই সুখকর হয়নি। নিঃসন্দেহে অনুষ্ঠানটিতে অনেক জনসমাবেশ হয়েছিল সত্যি, কিন্তু ভিড়ে কংগ্রেসের তেরঙা চাঁদ-তারা পতাকায় পাকিস্তানের সবুজ রাষ্ট্র পতাকার ন্যায় তারা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পাকিস্তানের করাচিতে কোনও রোড শো চলছে। কিন্তু বাস্তবে এটা পাকিস্তানের পতাকা ছিল না। পতাকাটি কংগ্রেসের সহযেগী দল ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের দলীয় পতাকা ছিল। এই ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের সঙ্গে পাকিস্তানের মহম্মদ আলি জিন্নার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগে পুরো দেশে জিন্নার অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ পার্টি ছিল। ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের পরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ দলের সব নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় যে পাকিস্তান নির্মাণ করা দলটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। সুতরাং দলটির উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাওয়াতে বৈঠকটিতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগকে ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু বিষবৃক্ষে ফল ধরতে শুরু করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানে দলটির নতুন নামকরণ হয় মুসলিম লিগ, বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ এবং ভারতে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ। ওরাই আজ কেরলে রাহুলদের জোটসঙ্গী। জিন্নার সবুজ পতাকায় চাঁদ-তারা, মাধখানে আর ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের সবুজ পতাকায় চঁাদ-তারা এককোণে। রাহুল গান্ধীর কী এমন বাধ্যবাধকতা ছিল জিন্নার আদর্শিত কেরলের এই মুসলিম লিগের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে নির্বাচনে লড়ার; এটা তাঁর অপরিপক্ক বুদ্ধি নয়তো আর কী!
রাহুল গান্ধী প্রত্যেকটি জনসভায় ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ চিৎকারে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ছবি খারাপ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ উলটা জবাবে বিরোধীরা অনেক আগেই কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাহুল সম্প্রতি সকল সীমা অতিক্রম করে ফেলেন। তিনি বক্তৃতায় বলেন সুপ্রিম কোর্টও মেনে নিয়েছে নাকি চৌকিদার চোর। রাহুলের এই মিথ্যা বয়ানের সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টীকরণ চায়, রাহুল জবাবে জানান এটা নাকি তিনি আবেগের বশীভূত হয়ে বলেছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতে তাঁকে দু-দুবার ক্ষমা চাইতে হয়েছে। রাহুল দেশের সবচেয়ে। পুরনো দলের অধ্যক্ষ কিন্তু তার শিশুসুলভ আচরণ এবং সিদ্ধান্তে কংগ্রেস দেশের জনগণের মধ্যে ক্রমশ গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে।
রঞ্জন কুমার দে
2019-05-17