গতকাল ইণ্ডিয়া টুডে গ্রুপের একটি ইনফোগ্রাফিক থেকে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল যে দিল্লিতে আন্দোলনরত চাষীর সংখ্যা বর্তমানে আনুমানিক ১৬-১৭ হাজার এবং তার মধ্যে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ৫০০-৭০০ জন চাষী ছাড়া বাকিরা সকলেই পঞ্জাব ও হরিয়ানার। যে প্রশ্ন বারে বারেই উঠে আসছে তা হল—কেন কৃষক আন্দোলন মূলতঃ পঞ্জাব-হরিয়ানা-কেন্দ্রিক। অন্যতম সম্ভাব্য উত্তর হল, সারা ভারতে যাঁরা রেশনের চাল, গম খান, তাঁরা এত কাল ধরে খেয়েছেন মূলতঃ পঞ্জাব, হরিয়ানায় উৎপাদিত অতিরিক্ত সারপ্রয়োগে বিষাক্ত চাল, গম ইত্যাদি। এই বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি কি? আজ ইণ্ডিয়া টুডে গ্রুপের আর একটি ইনফোগ্রাফিকে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী ফুড কর্পোরেশন অব ইণ্ডিয়ার মোট চাল ক্রয়ের ৬৫% ক্রয় করা হয় পঞ্জাব থেকে, ১৮% হরিয়ানায় থেকে আর বাকি ১৭% অন্যান্য সমস্ত রাজ্য থেকে। অনুরূপভাবে, FCI এর ক্রয় করা গমের ৩৩% আসে পঞ্জাব থেকে, ১৯% হরিয়ানা থেকে আর বাকি ৪৮% অন্যান্য সমস্ত রাজ্য থেকে। অর্থাৎ সরকারি কৃষিদ্রব্যক্রয়ের সিংহভাগ টাকাই যায় এই দুই রাজ্যে। তাতে অসুবিধা কিছু ছিল না, যদি এই দুই রাজ্যে উৎপাদিত কৃষিপণ্য অতিরিক্ত রাসায়নিক সারপ্রয়োগে বিষাক্ত না হত। পঞ্জাব ও হরিয়ানার তথাকথিত কেমিক্যাল-সারজনিত গ্রীন রেভলিউশন ভারতের মানুষের স্বাস্থ্য-সংহার করেছে। ভারতের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যের ওপর পঞ্জাব ও হরিয়ানায় উৎপাদিত কেমিক্যাল সারযুক্ত কৃষি দ্রব্যের কুপ্রভাব পড়েছে প্রচুর। ফুড কর্পোরেশন অব ইণ্ডিয়ার কেনা চাল, গমের অর্থ লাভ করেছে ঐ দুই রাজ্য আর নিজেদের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়ে তার খেসারত দিয়েছে ভারতীয় আমজনতা, যাঁরা রেশনের খাদ্যশষ্যের ওপর নির্ভর করে থাকেন।
১৯৬৬ সালে সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার পর গত পঞ্চাশ বছরে ভারতের একদম সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখা দিয়েছে নানা লাইফস্টাইল ডিসঅর্ডার বা মেটাবলিক সিনড্রোম যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ইত্যাদি।
কৃষিবিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথন, মূলতঃ যাঁর অবদানের কারণেই পঞ্জাব, হরিয়ানা ও হরিয়ানা-সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশ অঞ্চলে ১৯৬৬ সাল থেকে সূত্রপাত হয়েছিল সবুজ বিপ্লবের, সেই স্বামীনাথন নিজেই পরবর্তীকালে এই মত পোষণ করেছিলেন যে সবুজ বিপ্লব দীর্ঘ মেয়াদে পঞ্জাব ও হরিয়ানার জন্য সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার জন্ম দেবে। কৃষিবিজ্ঞানী স্বামীনাথনের সেই মত বর্তমানে সত্যি বলে প্রতীত হচ্ছে। পঞ্জাব ও হরিয়ানার গ্রীন রেভলিউশন যে উল্টোদিকে অপরিসীম স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়েছে, চাষীদের সহমর্মি হতে গিয়ে সে কথা এই মুহূর্তে কি কেউ ভাবছেন? যদি না ভাবেন, তবে তা অবিমৃশ্যকারিতা। যাঁরা চাষীদের ‘রাস্তা রোকো’ আন্দোলনে সমর্থন জানাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেও পঞ্জাব হরিয়ানার বিষ হয়ত এতকাল শরীরে ধারণ করেছেন এবং না জানি কোন্ কোন্ রোগ বহন করেছেন নিজেদের ও আপনজনের দেহে। বাজার এতকাল সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল বলে চাষীরা চাইলেও APMC তে না এসে নিজেরা সরাসরি অন্য কোথাও জিনিস বিক্রি করতে পারতেন না। ফলে ঐ দুই রাজ্যের চাষীরা বিষাক্ত সামগ্রী বিক্রি করেও ধনী হয়েছেন এতকাল। তাঁদের কৃষিদ্রব্য আর কেউ কিনুক বা না কিনুক FCI কিনেছে। এখন বাজার ওপেন হয়ে গেলে ঐ রাসায়নিক সারযুক্ত কৃষি পণ্য খোলা বাজারে কেউ কিনতে চাইবে না বলে মনে করছেন ওঁরা নিজেরাই। ওঁরা আশঙ্কিত যে ওপেন বাজারে ঐ উৎপাদন ওঁরা বিক্রি করতে পারবেন না। সেইজন্য ভারতসরকার অন্ততঃ যাতে তাঁদের প্রডিউস অবশ্যই কেনে সেই বন্দোবস্ত পাকা করতে চেয়ে আন্দোলন করছেন তাঁরা। তাঁদের আদত ভয় বোধ করি এই নয় যে MSP সিস্টেম উঠে যাবে। বরং তাঁদের আদত ভয় এইখানে যে মার্কেট ওপেন হয়ে গেলে ওঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আর কেউ কিনবেন না। ওঁরা বুঝতে পারছেন যে অন্যান্য সকল রাজ্যের চাষীরা আর APMC’র মাধ্যমে বিক্রি না করে অধিক লাভজনক ভাবে সরাসরি কনজিউমারকে বা ওপেন বাজারে বিক্রি করবেন, কারণ পরিবর্তিত ব্যবস্থায় চাষীদের বাজারে আসার ঝঞ্ঝাট পোহাতে হবে না, বরং বাজারই চলে যাবে চাষীদের কাছে। (চাই কি সাধারণ ক্রেতা বাড়িতে বসে সোজা ক্ষেত থেকেও হয়ত ফসল কিনতে পারবেন অনলাইনে, আরও কিছু ভবিষ্যতে। কিন্তু সে কথা আপাততঃ থাক।) ফলে সাধারণ বাজারে গুণমানে উৎকৃষ্ট কৃষিপণ্য অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যাবে। সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যশষ্যের দাম আদতেই পড়বে। তখন অনেক মানুষকেই আর রেশনের চাল, গমের অপেক্ষা করতে হবে না। অনেক মানুষ যদি রেশনের চাল না নেন, তখন APMC’র মাধ্যমে সরকারী ক্রয়ের পরিমাণও স্বাভাবিক নিয়মেই কমবে। ফলে পঞ্জাব, হরিয়ানার চাষীদের যে বিশাল পরিমাণ সুনিশ্চিত বিক্রয় (assured sales) বর্তমানে আছে, সেটা ভবিষ্যতে আর সুনিশ্চিত থাকবে না। যদি রেশন দোকানগুলো থেকে মানুষের জিনিস নেওয়ার পরিমাণ কমে, তাহলে ফুড কর্পোরেশন অব ইণ্ডিয়ার ক্রয়ের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া স্বাভাবিক। MSP বা ন্যূনতম সমর্থন মূল্যও হয়ত সেই অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে। খোলা বাজারমূল্যের ওপর নির্ভর করে বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে MSP কমতেও পারে। ভারত সরকারের গত ছ’বছরের কার্যবিধি সচেতনভাবে পর্যবেক্ষন করলে এ-ও অনুমান করা দুরূহ নয় যে ভবিষ্যতে ভারত সরকার হয়ত APMC তে খাদ্যশষ্য কেনার আগে উৎপাদিত শষ্যের কোয়ালিটি প্যারামিটারও বিচার করবে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভাবলে তা অত্যন্ত উচিত কাজ। এই কৃষি রিফর্ম আদতে ভারতবর্ষের একদম তৃণমূলের স্তরের গরীব মানুষের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটাবে। ওষুধের খরচ ধীরে ধীরে কমাবে এবং দেশ হিসেবে ভারত আরও ধনী হয়ে উঠতে পারবে কারণ ভারতের উৎপাদন দেশের বাজারের দাবী মিটিয়েও এক্সপোর্টেড হবে উত্তরোত্তর বেশি পরিমাণে। ভারতের এক্সচেকারে ফরেন রিজার্ভ ঢুকবে আরও বেশি। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের দ্বারা উৎপন্ন ফসল এক্সপোর্ট করা যাবে না। তাই সময়ের হাত ধরতে হলে অতিরিক্ত লাভের আশায় অতিরিক্ত সার ব্যবহারের নেশা পঞ্জাব, হরিয়ানার চাষীদের ছাড়তে হবে এবং বিষাক্ত জমির উর্বরতা ফিরিয়ে আনার যথাযথ প্রয়াস করতে হবে। আন্দোলন করে কালের পথ, সংস্কারের পথ রোধ করা যায় না।
এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন সরসঙ্ঘচালক শ্রী সুদর্শনজী’র একটি বক্তৃতা স্মরণীয়। উক্ত বক্তৃতার বঙ্গানুবাদ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সে বক্তৃতার অংশবিশেষ নিম্নরূপ:
“আমরা এই পৃথিবীর বুকে শস্য উৎপাদন করি। বেশি পরিমাণে শস্য উৎপাদন করার জন্য যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষ এবং জমিতে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ করা আসলে ধরিত্রীকে মাদকদ্রব্য খাওয়ানোর সমতুল্য। আসুন বিষয়টিকে সহজে এইভাবে বোঝার চেষ্টা করি। মানবদেহের ভিতরে শক্তির ভাণ্ডার আছে। কেউ যখন মদ্যপান করে, তখন মদ তার দেহের সেই আভ্যন্তরীন শক্তির ভাণ্ডার থেকে কিছুটা শক্তি নিয়ে সেই ব্যক্তিকে জোগান দেয়। তার ফলে সে উৎসাহিত বোধ করে এবং সেই উৎসাহের ফলে সে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি কাজ করে। কিছুক্ষণ পর যখন সে মদের নেশা থেকে মুক্ত হয় বা তার নেশা কমে আসে, তখন তার শরীরে আসে আলস্য, দুর্বলতা, কারণ তার শরীরের আভ্যন্তরীণ শক্তির ভাণ্ডার তখন হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু মদে আসক্ত ব্যক্তির মনে হতে থাকে যে মদের প্রভাব কমেছে বলেই সে দুর্বল বোধ করছে, ফলে আরও বেশি শক্তি সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে সে আরও মদ্যপান করে। এইভাবে মদ্যপান করতে করতে তার শরীরের আভ্যন্তরীণ শক্তির ভাণ্ডার ফুরিয়ে যেতে থাকে আর তার আয়ুও ক্রমশঃ কমতে থাকে। এইজন্যই যাঁরা অতিরিক্ত মদ্যপান করেন, সেই সব মানুষ সাধারণতঃ স্বল্পায়ু হন।
এই একই কথা পৃথিবী বা ধরিত্রীর ক্ষেত্রেও সত্যি। বিশেষতঃ যখন আমরা জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করি আর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাটির গভীর স্তর পর্যন্ত খুঁড়ে ফেলি, তখন তার ফলস্বরূপ সেই জমির উর্বরাশক্তি কমে যেতে থাকে। এই রাসায়নিক কৃষিপদ্ধতিতে স্বাভাবিকের তুলনায় প্রচুর বেশী পরিমানে শস্য আমরা পাই ঠিকই, কিন্তু তা পাই জমির উর্বরাশক্তির বিনিময়ে। ক্রমাগত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে করতে জমির উর্বরাশক্তি শেষ হয়ে জমি শেষে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে। আমেরিকাতে আজ হাজার হাজার হেক্টর জমি এভাবে বন্ধ্যা হয়ে পড়েছে। সেসব জায়গায় লেখা আছে abandoned অর্থাৎ পরিত্যক্ত।”
সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের বিনিময়ে পঞ্জাব, হরিয়ানার চাষীদের চিরকাল বড়লোক করে যাওয়ার কোনো শপথ ভারতের সাধারণ মানুষ কি কোনোদিন নিয়েছেন?
দেবযানী ভট্টাচার্য্য
Debjani Bhattacharyya