জিষ্ণু বসু
বাঙালি ভারতের নবজাগরণের কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করেছে। জীবন্ত জাগ্রত ভারতাত্মার পূজাবেদি ছিল বাংলা। ১৮৮২ সালে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন আনন্দমঠ উপন্যাস। বাঁধা হল ‘বন্দেমাতরম’ গান। দেশমাতৃকাকে দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করলেন সাহিত্যসম্রাট।
কলকাতার বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে শিকাগোর বিশ্ব ধর্মমহাসভায় ভারতবর্ষের বিজয়ধ্বজা স্থাপন করেছিলেন। ১৯০৫ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম ভারতমাতার চিত্র আঁকলেন। গৈরিকবসনা চতুর্ভুজা সন্ন্যাসিনী দেবী, হাতে ধান, বস্ত্র, বেদ আর জপমালা। ভগিনী নিবেদিতা সেই চিত্র নিয়ে আসমুদ্রহিমাচলে জনজাগরণের কথা ভেবেছিলেন। ঋষি অরবিন্দ ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিকে জাতীয় মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন। বন্দেমাতরম মৃতপ্রায় পরাধীন জাতির সঞ্জীবনী মন্ত্র হয়ে উঠল। ভারত জেগে উঠল। আজও যদি আন্দামানের সেলুলার জেলের দেওয়ালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম দেখা যায়, তার বেশিরভাগই বাঙালি। এই বাঙালির অস্তিত্বই আজ বিপন্ন।
বছর সাতেক আগের একটা ঘটনা। ২০০৪ সালে বিবিসি ‘গ্রেটেস্ট বেঙ্গলি অফ অল টাইম’ খোঁজার চেষ্টা করেছিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে উঠে এল শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় আর সতেরোতম স্থানে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। প্রথম ২০ জনের মধ্যে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, শ্রীঅরবিন্দ, মাস্টারদা সূর্য সেন, বিপিনচন্দ্র পাল বা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কারও নাম নেই। এই সমীক্ষা আরও একবার প্রমাণ করেছে যে, কেবলমাত্র বাংলাভাষাতে কথা বললেই বাঙালি ঐতিহ্যকে বোঝা যায় না। নিয়তি এই ঐতিহ্য রক্ষার দায়ভার পশ্চিমবঙ্গের মানুষের হাতেই সঁপেছে।
হয়তো আজকের কথা ভেবেই ১৯৪৭ সালে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার বা স্যার যদুনাথ সরকারের মতো ক্রান্তদর্শীরা পশ্চিমবঙ্গের ভূমিটুকুকে আগলে রেখেছিলেন। তাঁরা ভারতবর্ষে থাকতে চেয়েছিলেন। বাঙালির সুরক্ষার জন্য চেয়েছিলেন ‘বেঙ্গলি হিন্দু হোমল্যান্ড’। তা না-হলে কলকাতাসহ সমগ্র বাংলাটাই পাকিস্তানে চলে যেত, নয়তো ভারতবর্ষের বাইরে আর একটা রাষ্ট্র হতো।
পশ্চিমবঙ্গ নিজের ভূমিকা যথার্থভাবে পালন করেছে। মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রামের হিন্দু, বিপিনচন্দ্র পালের সিলেটের হিন্দু, উল্লাসকর দত্তের ব্রাহ্মণবেড়িয়ার হিন্দু, বাঘাযতীনের কুষ্টিয়ার হিন্দু, পুলিনবিহারী দাসের ঢাকার হিন্দু, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ফরিদপুরের হিন্দু বহু নির্যাতন সহ্য করে এই পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এসেছেন। গত সত্তর বছর ধরে কেউ সেইসব হতভাগ্য মানুষের ভারতবর্ষের পূর্ণ নাগরিকত্বের জন্য যত্নবান হননি। এই প্রথম, ২০১৯ সালে এল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। যাঁদের পূর্বপুরুষের আত্মত্যাগে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের নাগরিকত্ব দেবে ভারত সরকার। কিছু রাজনৈতিক শক্তি এখনও চান না উদ্বাস্তু হিন্দুরা তাঁদের প্রাপ্য নাগরিকত্ব পান। গত ডিসেম্বরে রাজ্যজুড়ে যে সিএএ তথা হিন্দু উদ্বাস্তু বিরোধী তাণ্ডব হয়েছে তার অপরাধীরা কেউ শাস্তি পায়নি। তাই ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের উপরেই নির্ভর করে আছে পূর্ববঙ্গের অত্যাচারিত ছিন্নমূল মানুষের সম্মানজনক নাগরিকত্ব।
আজ আবার এরাজ্যে নতুন করে প্রাদেশিকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে কেউ এলেই একদল ‘বহিরাগত, বহিরাগত’ বলে চিৎকার করছেন। ভারতবর্ষের উত্থানে বাঙালির অবদানকে সে-যুগে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়েছিল সারা দেশ। দেশের মানুষ ভালোবাসতেন বাংলাকে। তাই সামাজিক বা রাজনৈতিক কাজে ভারতের অন্য প্রান্তের মানুষ বাংলাতে এলে তাঁকে ‘বহিরাগত’ বলার অসৌজন্য ছিল না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গুজরাতের গান্ধীজিকে ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত করলেন। শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন ‘গান্ধী পুণ্যাহ’। সেটাই ছিল আমাদের সংস্কৃতি। ভারতবর্ষকে বাদ দিলে বাঙালির না-থাকে শ্রী, না-থাকে সামর্থ্য।
২০১৪ সালে যখন খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ হল তখন দেখা গেল পশ্চিমবঙ্গ জেহাদি শক্তির বড় আস্তানায় পরিণত হয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে তৈরি হয়েছে ‘স্লিপার সেল’। গত বছরের মার্চ মাসে বসিরহাট থেকে লস্কর-ই-তোইবার এক সক্রিয় সদস্য ধরা পড়ে। ধৃত মহিলার সঙ্গে আইএসআইএসের বড় চক্রের যোগাযোগ প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তানের মোবাইল সিম ব্যবহার করে জঙ্গি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি হয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনায়। এসবের অবসানের জন্য এক দেশভক্ত রাজনৈতিক শক্তি দরকার পশ্চিমবঙ্গে।
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের অপরাধ চক্রের বিষয়ে ‘চিদাম্বরম কমিটি’ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সীমান্তের ১০ কিমির মধ্যে যেন গো-হাট না বসে, সে বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় আইন পাশ হয়েছে বহুদিন আগেই। ১৪ বছরের কম বয়সের গোরুকে ‘ফিট ফর স্লটার’ শংসাপত্র দেওয়া পশ্চিমবঙ্গে আইনত নিষিদ্ধ। এই সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে রমরমিয়ে গো-পাচার চলছে। কুখ্যাত গো-তস্করেরা রাজনৈতিক ক্ষমতার খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। সীমান্ত এলাকায় তারাই নীতি নির্ধারণ করছে।
এই চক্রের বাড়বাড়ন্ত দু’টি কারণে দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। প্রথমত, দুষ্কৃতীদের কাছে অপরিমিত নগদ টাকা থাকছে, যা দিয়ে চাইলেই যে-কোনও রকমের বড় হিংসা তৈরি করা যায়। ২০১৭ সালের বসিরহাটের দাঙ্গা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। বিএসএফ মোতায়েন না-হওয়া পর্যন্ত জেলা প্রশাসন দাঙ্গা থামাতেই পারেনি। দ্বিতীয়ত, সীমান্ত এলাকায় জনবিন্যাসের দ্রুত পরিবর্তন ঘটানো। এতে সব থেকে বেশি অত্যাচারিত হচ্ছেন হিন্দু তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের
ঘরের মেয়েরা উৎপীড়িত হচ্ছেন, প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে উঠলেই তফসিলি যুবকদের হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। সন্দেশখালি থেকে বাসন্তী সর্বত্র একই অবস্থা। এই গভীর দুর্নীতি চক্র ভাঙতে কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। বহুদিন থেকেই এরাজ্যে জেহাদি মৌলবাদের সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তি এক প্রকারের সমঝোতা করেই পথ চলছে। তসলিমা নাসরিনের জন্য তিনদিন ধরে কলকাতার একটা বড় অংশ জুড়ে দাঙ্গা চলল। ২০০৭ সালের ২১ নভেম্বর সিপিএমের দু’টি পার্টি অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল দাঙ্গাবাজেরা। বামফ্রন্ট নেতৃত্ব কাঁপতে কাঁপতে তসলিমাকে রাজ্য ছেড়ে যেতে বললেন।
সেই শুরু। তারপর থেকে মৌলবাদ রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে স্থান করে নিয়েছে। সরকারকে বাধ্য করেছে দশ হাজার খারিজি মাদ্রাসাকে কোনওরকম অনুসন্ধান ছাড়াই অনুমোদন দিতে। সেই সুযোগেই তৈরি হয়েছিল সিমুলিয়ার মাদ্রাসার মতো ভয়ানক সব আখড়া। গত ১ নভেম্বর আল কায়দার সঙ্গে যোগ থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন মুর্শিদাবাদের রাইপুরের এক মাদ্রাসার শিক্ষক। এই মৌলবাদী দৌরাত্ম্য থেকে বের হতেই হবে, তাই এরাজ্যে সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই।
‘উর্দু নয় বাংলা’—পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলনের মূলেই ছিল এই দাবি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল এপার বাংলায়। ২০১৮ সালে দাড়িভিটে বাংলা ভাষার শিক্ষকের দাবিতেই প্রাণ দিলেন দুই ছাত্র রাজেশ আর তাপস। স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে আদেশনামা, সর্বত্র ধীরে ধীরে কমে আসছে বর্ণপরিচয়-সহজপাঠে শেখানো বাংলার ব্যবহার। ‘রামধনু’ হয়ে গিয়েছে ‘রংধনু’। কলকাতা শহরেই এমন বিস্তীর্ণ এলাকা আছে, যেখানে রাস্তার নামফলকে বাংলা উধাও হয়ে গিয়েছে। বাঙালি আবহমানকাল থেকে স্কুলে স্কুলে সরস্বতী পুজো করে এসেছে। তাতে হিন্দু-মুসলমান সব ছাত্রছাত্রীই অংশ নিত। স্কুলে সরস্বতী পুজো বন্ধ করার জন্য বহু জায়গায় ফতোয়া জারি হয়েছে। সরস্বতী পুজো করার দাবিতে পথ অবরোধ করেছে ছাত্রছাত্রীরা, রক্তাক্ত ছাত্রীর ছবি খবরের কাগজে এসেছে।
কালিয়াচকের থানা লুট, খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ, ধুলাগড়ের দাঙ্গা বা সিমুলিয়ার মাদ্রাসার মতো জেহাদি মৌলবাদ যেমন ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, তেমনই কপালে নতুন করে ভাঁজ ফেলেছে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের পরেই বাংলাদেশের সঙ্গে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ শুরু করেছে চীন।
২০১১ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের নতুন সরকার ভারত-বাংলাদেশের মধ্যেকার তিস্তা চুক্তিতে আপত্তি জানিয়েছে। এর পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে চীন। ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তিস্তা উপত্যকা উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়েছে। এই ঋণ দেওয়ার সুবাদে চীন শিলিগুড়ির ১০ কিমির মধ্যে ঢুকে পড়ার সুযোগ পাবে। শরীরের যে অঙ্গ দিয়েই বিষ ঢুকুক না কেন, তা গোটা মানুষটাকেই শেষ করে দেবে। সেদিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই ২০২১ সালে পাখির চোখ পশ্চিমবঙ্গ।