অধ্যাপক হরিপদ ভারতী : যাঁকে মনে রাখলে হয়তো আমাদেরই লাভ হতো

অধ্যাপক হরিপদ ভারতী : যাঁকে মনে রাখলে হয়তো আমাদেরই লাভ হতো।

সম্ভবত ১৯৮০ সাল। সম্ভবত বললাম কারণ এতোদিন পরে ঠিক মনে নেই। মানুষের ঘরে তখনো টেলিভিশন পৌছায় নি। তখনো খবর পড়তে খবরের কাগজ আর খবর শুনতে রেডিওই ভরসা । জনতা পার্টি পরিচালিত সরকারের পতনের পর লোকসভার অন্তর্বর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। সেই প্রথম Oআকাশবাণী কর্তৃপক্ষ সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকে প্রচার করার সুযোগ দেন। প্রতিটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের একজন প্রতিনিধি আসন্ন নির্বাচনে দলের নীতি এবং কর্মসূচি বিষয়ে বলার সুযোগ পেতেন। তখন বয়েস অল্প। কিন্তু রাজনীতি একেবারে বুঝতাম না তা নয়। কারণ বাড়িতে রাজনীতির চর্চা ছিল। বাবাকে দেখতাম সন্ধ্যেবেলা রাজনৈতিক নেতাদের এই বক্তব্যগুলো মন দিয়ে শুনতে। সন্ধ্যেবেলা পড়াশোনা ফেলে রেডিওতে গান শুনলে বাবা রাগ করতো বটে কিন্তু খবর বা এই ধরনের অনুষ্ঠান শুনলে আপত্তি তো করতোই না বরং উৎসাহ দিতো। বলতো “এগুলো শোন, অনেক কিছু জানতে পারবি “। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে আকাশবাণীতে অধ্যাপক হরিপদ ভারতীর একটি ছোট্ট ভাষণ শুনেছিলাম। সত্যিই অসাধারণ ছিল সেই বক্তব্য। বিভিন্ন দিনে অন্য দলের প্রতিনিধিরাও তাঁদের বক্তব্য রেখেছিলেন। অনেকেই যথেষ্ট ভালো বলেছিলেন। কিন্তু হরিপদ ভারতী সত্যিই ছিলেন ‘অসাধারণ’। এমন শব্দচয়ন, এমন বাচনভঙ্গি খুব কম মানুষের মধ্যেই পাওয়া যায়। বাবা বরাবরের কংগ্রেস সমর্থক হলেও দুজন জনসংঘ নেতাকে খুবই পছন্দ করতেন। একজন অবশ্যই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আর একজন অধ্যাপক হরিপদ ভারতী। একসময় অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় ভারতীয় জনসংঘের খুবই ভালো প্রভাব ছিল। ১৯৫২ সালের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিম বাংলা বিধানসভার ২৩৮ টি আসনের মধ্যে জনসংঘ পেয়েছিল ৯ টি আসন যার মধ্যে ৮ টিই পেয়েছিল মেদিনীপুর জেলা থেকে। সেই সময় মেদিনীপুরে জনসংঘের নেতারা প্রায়ই যেতেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বা হরিপদ ভারতীর মতো বাগ্মীর বক্তব্য শোনার সুযোগ ওখানকার মানুষদের হয়েছিল। বাবার মুখে শুনেছি তখন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি বক্তব্য রাখতে এলে দলমত নির্বিশেষে সকলেই তা শুনতে যেতেন। যে দল জিতবে সে অপরের ঘরদোর ভেঙে দেবে, তার ঘটিবাটি চাঁটি করে ছেড়ে দেবে, তার জীবন জীবিকা শেষ করে দেবে এই সংস্কৃতি তখনো চালু হয় নি। বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সকলের শ্রদ্ধা পেতেন। সদ্য স্বাধীন দেশে সবার সাথে হাত মিলিয়ে দেশ গঠনই ছিল প্রধান লক্ষ্য। আর রাজনৈতিক নেতাদের একটা বড় অংশই নিজের গুণে সব মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতেন। এখন মনে হয় এসব সত্যযুগে ঘটেছিল।
যারা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলার রাজনীতির খবর রাখেন তাঁরা সকলেই একমত হবেন যে অধ্যাপক হরিপদ ভারতী একজন অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। তিনি হাওড়ার একটি বিখ্যাত কলেজের অধ্যাপক এবং পরে অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। তবে এতেই বোধহয় তাঁর সব পরিচয় দেওয়া হয় না। রাজনীতিতে যোগ না দিলেও হয়তো ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকতা, বইলেখা এই সব নিয়ে সময় কাটাতে পারতেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিকসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন, এরপর প্রথমে যশোরের মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজে অল্প কিছুদিন অধ্যাপনা করার পর হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে প্রথমে অধ্যাপক পরে একই কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করা — শিক্ষাজগতে এই ধরনের মানুষের সংখ্যা অল্প হলেও বিরল নয়। কিন্তু দেশ বা জাতির সংকটের সময় বহু মানুষই তার নিশ্চিত চাকরি বা নিরাপদ গৃহকোণে আবদ্ধ থাকে না। হরিপদ ভারতীও থাকেন নি। ছাত্রজীবনেই ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সান্নিধ্যে আসেন, যোগ দেন হিন্দু মহাসভায়। পরবর্তীকালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জনসংঘে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন সেই দলের পশ্চিম বাংলা শাখার সভাপতি এবং সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জরুরী অবস্থার সময় অনেক কংগ্রেস বিরোধী নেতার মতো তাঁকেও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা আইন বা মিসা আইনে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ২০ মাস প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন হরিপদ ভারতী। জেলের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বইও লিখেছিলেন – “জেলে মিসা বাইরে মিসা”। জরুরী অবস্থার পর জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে অনেকগুলি দল নিয়ে গঠিত হয় জনতা পার্টি যার মধ্যে জনসংঘও ছিল। জনতা পার্টির টিকিটে তিনি ১৯৭৭ সালে কলকাতার জোড়াবাগান কেন্দ্র থেকে পশ্চিম বাংলা বিধানসভায় নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ — ১৯৮২ সময়কালে কলকাতার চৌরঙ্গী কেন্দ্র থেকে জনতা দলের প্রতীকে পশ্চিম বাংলা বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন অধ্যাপক সন্দীপ দাস। বেশ কয়েক বছর হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া কলেজে একসঙ্গে চাকরি করেছি। প্রয়াত অধ্যাপক সন্দীপ দাস রাজনৈতিক বিশ্বাসে সমাজবাদী ছিলেন। কিন্তু জরুরী অবস্থার সময় ইন্দিরা সরকার সমাজবাদী কিংবা জনসংঘী কাউকে ছাড়ে নি। ফলে সন্দীপ দাস কিংবা হরিপদ ভারতী সবাইকেই জেলে যেতে হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে সন্দীপদার মুখে তাঁদের জেল জীবনের গল্প শুনেছি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সময়কালে বিরোধী দলে ছিলেন সন্দীপ দাস, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী, হরিপদ ভারতীর মতো অত্যন্ত বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গ। সন্দীপদার মুখে শুনেছি বিধানসভাতে হরিপদ ভারতী যখন বক্তব্য রাখতেন শাসক বিরোধী নির্বিশেষে সকলেই মন দিয়ে শুনতেন। ১৯৮০ সালে জনতা পার্টি ভেঙে যায়। প্রাক্তন জনসংঘীরা গড়ে তোলেন ভারতীয় জনতা পার্টি, যার প্রথম সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক হরিপদ ভারতী, দলের ভেতরে এবং বাইরে যিনি পরিচিত ছিলেন “মাস্টারমশাই” হিসেবে।
গত ২৮ শে জুন অধ্যাপক হরিপদ ভারতীর ১০১ তম জন্মদিন চলে গেল ( তাঁর জন্ম ২৮ শে জুন ১৯২০)। হরিপদ ভারতী মারা যান অল্প বয়সে। ১৯৮২ সালের ১৯ শে মার্চ মাত্র ৬১ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। যে দলের তিনি প্রথম সভাপতি ছিলেন সেই ভারতীয় জনতা পার্টির কর্মী সমর্থকেরা হরিপদ ভারতীকে তাঁর জন্মদিনে স্মরণ করলেও বাংলার রাজনৈতিক সমাজ কিন্তু আস্তে আস্তে ভুলেই যাচ্ছে এই ধরনের মানুষদের। কারণ বাংলার রাজনীতির চরিত্র, তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধরনও গত ৫০ বছরে বদলে গেছে অনেকটাই। ভারতের এই অংশে প্রথম ব্রিটিশ শাসন বিস্তার, পশ্চিমী শিক্ষার প্রসার প্রভৃতির ফল হিসেবে যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে সমাজ এবং রাজনীতিতে। এই শ্রেণীই ছিল সমাজ এবং রাজনীতিতে নেতৃত্বের ভূমিকায়। বাংলার রাজনীতিতে এদের প্রভাব স্বাধীনতার পরেও বেশ কিছু দশক বজায় ছিল। কিন্তু ৬০-এর দশকের শেষের দিক থেকেই এ রাজ্যের রাজনীতিতে বদল আসে। রাজনীতিতে যত পেশীশক্তির প্রভাব বাড়তে থাকে ততই “একটু অন্য ধরনের” মানুষেরা ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকে পড়তে থাকে। আজ বাংলার রাজনীতিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণী এক “নেগলিজিবল মাইনোরিটি”। এখন ‘যিসকা লাঠি উসকা ভঁইস’-এর যুগ। বৃহত্তর সমাজে এই সংস্কৃতিই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। আজকের রাজনীতিতে হরিপদ ভারতীরা আর প্রাসঙ্গিক নন।
প্রসঙ্গত বলে রাখি অধ্যাপক হরিপদ ভারতী যে কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষ ছিলেন সেই সেই হাওড়ার বেলিলিয়াস রোডের নরসিংহ দত্ত কলেজে একটি লিয়েন ভেকেন্সীতে অধ্যাপনা করেছিলাম ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত। ওটা ছিল জীবনের প্রথম চাকরি। তখন ওই কলেজের অনেক অধ্যাপককে নিজেদের মধ্যে গল্প করার সময় মাঝে মাঝেই হরিপদ ভারতীর কথা বলতে শুনতাম। উনি নাকি খুব ভোজনরসিক ছিলেন। যাই হোক সে আজ তিন দশক আগের কথা। সময় হিসেবে তিন দশক অনেকটাই।

অধ্যাপক Bimal Sankar Nandaর দেওয়াল থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.