সারা বিশ্বেই মহিলাদের তুলনায় নতুন কোন উদ্যোগ শুরু করে পুরুষেরাই। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, মহিলাদের অতিমানিতা কম এবং বিনয়ও বেশি যেটা তাঁদের ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে, নতুন কোন উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের সীমাবদ্ধতা থাকে। যদি কেবলমাত্র মহিলারা পুরুষদের মতোই দুর্বিনীত এবং অতি আত্মবিশ্বাসী হতেন! আসলে, আমাদের একেবারেই নিজস্ব ভারতীয় আদর্শ কিরণ মজুমদার-শ তাঁর উদ্যোগপতি হওয়ার পথে মন্তব্য করেছেন, “[…] আপনাকে স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে […]। আমি নিজের জন্য কিছু করছিলাম, আমি যা করছিলাম তা বেশ অভিনব, ওই সময়টায় আমি কোনদিকে দেখতে পাইনি। আমি বুঝলাম আমি একাই এটা করছি, আমি বুঝলাম আমি অন্য ধরনের কিছু করছি এবং আমি অনেকটাই সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বিষয়টি সামলালাম, ছিল একমুখিনতা এবং বোকার মতো সাহস, আমাকে বলতেই হবে।”
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শুধুমাত্র কম অতিমানিতাই যে ভারতের মহিলাদের সফল উদ্যোগপতি হতে বাধা দিচ্ছে তাই নয়। ভারতের ১৩.৫ মিলিয়ন থেকে ১৫.৭ মিলিয়নের মধ্যে মহিলা পরিচালিত সংস্থা আছে। সরকারি হস্তক্ষেপে আর্থিক সঙ্গতির বেড়েছে, শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে, ফলে গত এক দশকে মহিলা পরিচালিত সংস্থার বৃদ্ধি ঘটেছে ১৪ থেকে ২০ শতাংশ। তবে, মহিলা উদ্যোগপতিদের এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যা তাঁদের পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে পরিচিত নয়। মাস্টার কার্ডের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ব্যবসা করার পরিবেশ মহিলা উদ্যোগপতিদের জন্য অনুকূল নয়। অনেক সামাজিক, কারিগরি এবং আর্থিক বাধা আছে যা মহিলা পরিচালিত ব্যবসা বৃদ্ধির প্রতিবন্ধক। বলতে কি, কিছু সংস্থা নথিবদ্ধ হয় মহিলা পরিচালিত হিসেবে আর্থিক এবং প্রশাসনিক কারণে। কিন্তু সেগুলি আসলে পুরুষেরাই চালান। এছাড়া, মহিলা পরিচালিত সংস্থার বেশিরভাগই এক ব্যক্তি-কেন্দ্রিক, আয় হয় কম, আয়তনেও কম, পুরুষচালিত সংস্থার থেকে। বেশিরভাগ মহিলাই বাড়ির কাজের পাশাপাশি, ব্যবসার কাজ চালান। তাঁরা শিশু এবং বৃদ্ধদের যত্ন করার কাজটাও প্রাথমিকভাবে করে থাকেন। মহিলারা যে ব্যবসা করেন তার প্রকৃতি পুরুষচালিত ব্যবসার থেকে ভিন্ন। তাই, ঋণের প্রয়োজনীয়তা এবং সেই সূত্রে ঋণ চক্রটিও ভিন্ন রকমের। গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের আবার প্রায়ই তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয় বাড়ির বাইরে বেরোবার আগে এবং নিরাপত্তা ও সামাজিক কারণে কাছের ব্যাঙ্কে যেতে হলেও সঙ্গে একজন পুরুষ আত্মীয়কে রাখতে হয়।
মহিলাদের আর্থিক সঙ্গতিও সীমিত বিভিন্ন কারণে। ভারতে এবং বিশ্বেও ব্যবসা শুরু করতে, চালাতে বা বাড়াতে বেশিরভাগ মহিলাই ধার করার চেয়ে সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করেন। অনানুষ্ঠানিক ও সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তহবিল জোগাড় করা মহিলাদের পক্ষে দুষ্কর। শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলারাই তার সুযোগ নিয়ে থাকেন। ভারতে কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত কেউ অথবা ছোট উদ্যোগপতিরা পরিবারের সদস্য অথবা বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে খুব একটা আগ্রহী হন না। এর পাশাপাশি, বাড়ির আয় এবং সঞ্চয়ের ওপর মহিলাদের জোরও কম। সেইজন্য তাঁদের কাছে স্বাধীন আনুষ্ঠানিক আর্থিক উৎসই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের গ্লোবাল ফাইন্ডেক্স ডেটাবেস অনুযায়ী, ভারতের মেয়েদের থেকে পুরুষরাই বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অথবা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ধার করেন। এই লিঙ্গ বৈষম্যের অনেকগুলি কারণ আছে যেগুলি যুক্ত আর্থিক বাজার এবং পণ্যের সঙ্গে। যদিও মহিলাদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার আছে, তবুও তাঁরা সাধারণত পারিবারিক সূত্রে সম্পত্তির মালিকানা পান না। সেজন্যই আনুষ্ঠানিক আর্থিক বাজার থেকে ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পত্তি তাঁর থাকে না। আনুষ্ঠানিক আর্থিক বাজারে তাঁদের সীমাবদ্ধতার জন্যই ক্রেডিট রেটিং-এ একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর সেইজন্যই কম সুদে তাঁরা ধার করতে সক্ষম হন না। এর জন্য প্রয়োজন ঋণদানের এমন ব্যবস্থা করা যেখানে ছোটখাটো ব্যবসাও ঋণ পাবে, সুদ কম হবে, আর এমন আর্থিক কাঠামো হবে যা মহিলা পরিচালিত ব্যবসার প্রয়োজন মেটাবে।
মহিলা উদ্যোগপতিদের কাছে তথ্যের অসাম্য দূর করার লক্ষ্যে এবং সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নীতি আয়োগের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম মহিলা উদ্যোগপতি মঞ্চ (ডব্লিউইপি) একটি কার্যকরি পদক্ষেপ। ব্যবহারকারী এই পোর্টালে নিজের নাম নিবন্ধীভুক্ত করলে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য তো পাবেনই, এছাড়াও প্রয়োজনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের লোকের প্রয়োজন হলে সেই তথ্যও পাবেন। ধরা যাক, কারও ব্যবসায়িক কাজকর্মের জন্য অ্যাকাউন্টেন্টের প্রয়োজন, তখন তিনি এই পোর্টালের সাহায্য নিতে পারেন। এখনও পর্যন্ত এতে ১৩ হাজার নিবন্ধীকৃত উদ্যোগপতি রয়েছেন। উদ্যোগপতিদের অধ্যাবসায়, ধৈর্য্য এবং কঠোর পরিশ্রমকে সম্মান জানানোর জন্য তাঁরা ২০১৬ সাল থেকে উইমেন ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া পুরস্কার চালু করেছে। চতুর্থ বছরের পুরস্কার এ বছরের ৮ মার্চ ঘোষণা করা হবে। শীর্ষ স্থানীয় ৩০ জন উদ্যোগপতিদের মধ্য থেকে বিজেতার নাম বেছে নেওয়া হবে। এ বছর আনুমানিক ২ হাজার ৩০০ উদ্যোগপতি তাঁদের নাম নথিভুক্ত করেছেন, যা উপরে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জেরই প্রামাণ্য দলিল। মহিলা মালিকানাধীন এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির ৬৪ শতাংশ ব্যক্তিগত মালিকানার অথবা এক মালিকানার। অধিকাংশই ৩০ লক্ষ টাকার কম বিনিয়োগে তাঁর ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং ৮৪ শতাংশের বার্ষিক টার্নওভার ১ কোটি টাকার কম। ৮০ শতাংশ কাজ করেছে শিক্ষা, সামাজিক ও সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর শহরের উদ্যোগপতিরা মূলত শিক্ষা, উৎপাদন, হস্তশিল্প এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। কৃষি ক্ষেত্রে কাজ করেছেন তৃতীয় শ্রেণীর শহরগুলি থেকে আসা উদ্যোগপতিরা। এই সমস্ত উদ্যোগপতিদের ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রে মূলত তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এগুলি হ’ল – মূলধনের অভাব, সচেতনতার অভাব এবং উৎপাদিত বাজারজাত করার সমস্যা। সমাজ-সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ এবং লিঙ্গ বৈষম্যতাও ছিল অন্যতম প্রধান সামাজিক চ্যালেঞ্জ। তাঁদের ব্যবসা চালাতে স্বল্প ঋণ দেওয়ার জন্য বিনিয়োগকারীও সেভাবে পাওয়া যেত না।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথ্যের ক্ষেত্রে যে অসাম্য রয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা যথেষ্ট সহায়ক হবে। মহিলারা তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে লেনদেন করার জন্য ইন্টারনেট বা মোবাইল ব্যবহার করতে পারছেন। ব্যাঙ্কের শাখায় গিয়ে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে সময় নষ্ট হ’ত বা যাতায়াতের জন্য খরচ হ’ত – তাও বাঁচানো যাচ্ছে। এর ফলে, উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজকর্মে তাঁরা বেশি মনোনিবেশ করতে পারছেন এবং আর্থিক লেনদেনের খরচও সাশ্রয় হচ্ছে। এই ছোট ছোট সঞ্চয়গুলি মহিলাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগকে সহায়তা করে। কারণ, এমন অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা কাজ করেন, যেখানে তাঁদের এমনিতেই বিক্রয় কম হয়। ফলে, লাভও কম হয়। অনেক পরিবারই নিরাপত্তার কারণে তাঁদের স্ত্রী বা কন্যা ব্যবসা করতে বা ব্যাঙ্কে যাওয়ার জন্য একা একা বের হন। তাঁদের জন্য এই ডিজিটাল ব্যবস্থা অত্যন্ত সহায়ক। এছাড়াও, ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রে যে সমস্ত সামগ্রীর প্রয়োজন হয়, তার সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং বাজার থেকে কোন সামগ্রী কতটা পরিমাণে কিনতে হবে, তা নির্ধারণ করাও সুবিধাজনক হয়। ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার আরেকটি সুবিধা হ’ল ক্লায়েন্টদের সঙ্গে নিয়মিত লেনদেনের সুবিধা। এর ফলে, এই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও বৃদ্ধি পায়। ন্যূনতম ব্যালেন্স রাখার প্রয়োজনীয়তা, অন্তর্বর্তীকালীন ঋণ পাওয়ার সুবিধা এবং স্বল্প সঞ্চয়ের সুবিধা ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে দেওয়া যেতে পারে। মহিলাদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা ঢোকার ফলে তাঁরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হন এবং সেই অর্থ তাঁরা সঞ্চয় করতে পারেন বা ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করতে পারেন। হিসাব-নিকেশের রক্ষণাবেক্ষণ, কর প্রদানে সুবিধা, সরকারি প্রকল্পগুলি সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং দক্ষ পরিচালন ব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে নীতি আয়োগের ডব্লিউইপি-কে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রযুক্তির ক্ষমতা আছে মহিলাদের ব্যবসায়িক কাজকর্মের দক্ষতা বাড়ানোর, তবে তাদের কাছে এই প্রযুক্তির নাগাল পাওয়ার সুযোগ সীমাবদ্ধ। ভারতে ডিজিটাল আর্থিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক বড় বাধা হচ্ছে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ কম এবং জোরদার ডিজিটাল নেটওয়ার্কের ঘাটতি। এছাড়া, পুরুষের তুলনায় মেয়েদের কাছে মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটের সুযোগও কম। নতুন নতুন আর্থিক পণ্য এবং নয়া প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো ও স্মার্ট ফোন ব্যবহারও মহিলারা কম করে। এটাও দেখা গেছে যে সোশাল মিডিয়ার প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন থাকলেও, মেয়েরা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে সাহায্য করতে পারে এমন সব আর্থিক হাতিয়ার ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে ততটা অবহিত নয়। দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদ কমেছে অনেকখানি, কিন্তু আর্থিক সাক্ষরতায় নারী-পুরুষ বৈষম্য ব্যবসায়িক দক্ষতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্যবসায়-বাণিজ্য উদ্যোগে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর এক কার্যকর উপায় হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের কাছে আর্থিক হাতিয়ারের নাগাল পাওয়ার সুযোগ বাড়ানো। তবে, এটা সমাধানের একটি অংশ মাত্র। আরও বেশ কয়েকটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সংস্কার করা চাই। মহিলা মালিকানাধীন ব্যবসায় সাহায্য করতে সরকার, বেসরকারি ক্ষেত্র এবং লাভের দিকে লক্ষ্য না রেখে চলা সংস্হাগুলি বেশ কিছু প্রকল্প ও উদ্যোগ শুরু করেছে। মহিলা উদ্যোগীদের জন্য সার্টিফিকেশন কর্মসূচি বা দক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং মহিলা পরিচালিত অতি ছোট, ছোট ও মাঝারি সংস্হা থেকে ৩ শতাংশ পণ্য বাধ্যতামূলক কেনা এর কয়েকটি উদাহরণ। শিশু এবং বয়স্কদের জন্য নিরাপদ, সাধ্য কুলোন এবং হাতের কাছে মেলা এক নির্ভরযোগ্য পরিচর্যা-অর্থনীতি; স্বাস্হ্য এবং ব্যবসায় বিমা যোজনার মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প; এবং ঘর-গেরস্হালির কাজে ছেলে ও মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ হচ্ছে এমন কিছু সামাজিক সংস্কার যা আগামী দশকে ভারতের উন্নয়ন কাহিনীর এক অংশ হয়ে উঠতে মহিলা উদ্যোগীদের সাহায্য করবে।
- ডঃ রাজীব কুমার – উপাধ্যক্ষ, নীতি আয়োগ
- পাঙ্খুরি ডাট – জননীতি পরামর্শদাতা (ইকনমিক অ্যান্ড ফিনান্স), নীতি আয়োগ