প্রিয়া সাহা সংখ্যালঘু কারা ?

প্রিয়া সাহা, অধুনা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে আপনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছেন। আপনার অভিযোগ যে সত্য, একথা অস্বীকার করিনা, তবুও আপনার কাছে আমার প্রশ্ন : আপনি কি উপমহাদেশের ইতিহাসের আলোকে জানেন কারা, কোথায় প্রকৃত সংখ্যালঘু ? আমি আপনাকে বলি, আপনি শুনুন :
এপার ওপার দুই পাড়ের সেকুলাঙ্গার বাঙালি প্রচার করে যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা নাকি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের থেকে ভাল আছে। শুধু এটুকুই বলে না আরও বলে বাংলাদেশে নাকি হিন্দুদের উপর কখনও নির্যাতন করা হয় না বা সামান্য কিছু নির্যাতন ছাড়া আর কখনও হয়নি।

১৯৭১ সাল থেকেই হিন্দুদেরর উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে টার্গেট করে জাতিগত নির্মূলীকরণ এর খেলায় নেমেছিল পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের পোষা বাংলাদেশী দোসর আলবদর, রাজাকার আর আল শামস নামক বাহিনী। পাক ভারত যুদ্ধে পরাজয়ের শোধ তুলতে পাকি জান্তারা বাংলাদেশের হিন্দু দের সম্পত্তি কে শত্রু সম্পত্তি বলে ঘোষণা করে।এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ হিন্দুদের উত্তরাধিকারের বঞ্চিত হয়। সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের নামে প্রভাবশালি মুসলিম ও রাজনীতিবিদেরা সে গুলো দখল করে। শেখ মুজিবুর রহামান ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্যে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করা এবং পাকি কারাগার থেকে নিজের নিশ্চিত মৃত্যু থেকে পরিত্রান পাওয়া স্বত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রু সম্পত্তি নামক আইনটি নিষিদ্ধ না করে তার নাম ‘অর্পিত সম্পত্তি’ দিয়ে হিন্দুদের সম্পদ বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার পথ উন্মুক্ত রাখেন।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের গবেষণা গ্রন্থ ‘এ্যান ইনকোয়ারি ইন টু কজেস এন্ড কনসিকোয়েন্সেস অফ ডিপ্রাইভেশন অফ হিন্দু মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশ থ্রু দ্য ভেস্টেড প্রপার্টি এ্যাক্ট (প্রিপ ট্রাস্ট, ২০০০ সাল)’ বইয়ে দেখা যাচ্ছে ১৯৬৪ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছর ১৯৬, ২৯৬ জন হিন্দু হারিয়ে যাচ্ছেন এদেশ থেকে। প্রতিদিন হারাচ্ছেন ৫৩৮ জন মানুষ। শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তির আওতায় এপর্যন্ত ৯২৫,০৫০ হিন্দু পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ৭৪৮,৮৫০ পরিবার হারিয়েছেন কৃষি জমি, ২৫১,০৮৫ পরিবার হারিয়েছেন বসতভিটা, ৪৮,৪৫৫ পরিবার হারিয়েছেন উদ্যান জমি, ২২,০২৫ পরিবার হারিয়েছেন বাড়ির পাশের পতিত জমি, ৭৯,২৯০ পরিবার হারিয়েছেন পুকুর, ৪,৪০৫ পরিবার হারিয়েছেন বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন জমি এবং ১১৪,৫৩০ পরিবার হারিয়েছেন আরো নানা শ্রেণীভুক্ত জমি। আবুল বারকাত কি বলেছেন? শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইনের আওতায় এপর্যন্ত ১.৬৪ মিলিয়ন একর জমি হারিয়েছে হিন্দুরা। এটা ১৯৯৫ সালের হিসাব। এরপর পদ্মা-মেঘনায় আরো জল গড়িয়েছে। আরো অনেক সহায়-সম্বলহারা হয়েছে হিন্দুরা। এপর্যন্ত ১.৩৪ মিলিয়ন কৃষি জমি (মোট বেদখল হওয়া জমির ৮১.৭ ভাগ), ১৫৬ হাজার একর বা¯ত্তজমি (মোট বেদখল হওয়া জমির ১০% ভাগ), ২৯ হাজার একর উদ্যান জমি (মোট বেদখলকৃত জমির ১.৭৪% ভাগ), ১১ হাজার একর পতিত জমি (০.৬৮% ভাগ), ৩২৯ একর বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত জমি এবং ৫৬ হাজার একর অন্যান্য জমি (৩.৪% ভাগ)-র অর্থমূল্য ২০০০ সালের বাজারদরে গড় দামে হিসাব করলে (প্রতি ডেসিমাল ৫৭৬০ টাকা), শুধুমাত্র শত্র“ সম্পত্তি আইনের আওতায় হিন্দু পরিবারগুলো যত জমি হারিয়েছে, তার মোট আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৯৪৪,৬৪০ মিলিয়ন টাকা যা বাংলাদেশের জিডিপি-র শতকরা ৫৫ ভাগ এবং ২০০০-২০০১-এ বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি।

প্রতি বছর দুর্গা পূজা নামক হিন্দু উৎসবের জন্য মুখিয়ে থাকে শান্তির ধর্মের অনুসারীরা। বাংলাদেশে এমন কোন দুর্গা পূজা হয়নি যেখানে মুসলিমরা প্রতিমা ভাংচুর করেনি। মন্দির ভাঙ্গায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় শান্তির ধর্মের অনুসারীগণ। সে সময়ের বাংলাদেশের ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টার এর একটি প্রতিবেদনের অনুবাদ ছিল এমন যা থেকে আমরা সে সময়ের বাংলাদেশের হিন্দুরা কি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল তার কিছু ধারনা পেতে পারি , “1992 বাংলাদেশ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে ইসলামবাদীদের বাংলাদেশে অ মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালান হয়। সহিংসতার ঘটনা ডিসেম্বর 1992 সালে শুরু হয় এবং মার্চ 1993 পর্যন্ত চলতে থাকে। এতে 28,000 হিন্দু ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে, 2,700 ব্যবসা এবং 3,600 মন্দির ও পূজার অন্যান্য স্থানে ধ্বংস করা হয়েছে। মোট ক্ষতির হিসেব 2 বিলিয়ন টাকা থেকে বেশি।”

৭ই ডিসেম্বর, জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরীতে আক্রমণ করা হয়। ঢাকায় ভোলানাথ গিরি আশ্রম আক্রমন ও লুট করা হয়। হিন্দু মালিকানাধীন গহনা দোকান পুরনো ঢাকায় লুট হয়। রায়েরবাজারে হিন্দু ঘরে আগুন দেয়া হয়েছিল। সার্ক চার জাতির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট দাঙ্গার কারণে আক্রান্ত হয়। ৭ই ডিসেম্বর, লোহার রড এবং বাঁশের লাঠি দিয়ে সশস্ত্র ৫০০০ মুসলমানদের বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার ম্যাচ চলাকালীন সময় ঢাকা ন্যাশনাল স্টেডিয়াম মধ্যে আক্রমন করার চেষ্টা করে। পুলিশ আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে । কিন্তু ম্যাচ ৮.১ ওভারে পর পরিত্যক্ত হয়। উদ্যোক্তারা ১১ই ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার ও ফাইনাল ম্যাচ পুন নির্ধারণ করে কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হয়।

আরেকটি বড়ধরনের হিন্দু নির্যাতন শুরু হয় ২০১৩ সালে। মুক্তিযুদ্ধের মানবাতা বিরোধী অপরাধে মিরপুরের কসাই খ্যাত কাদের মোল্লার প্রত্যাশিত ফাঁসির রায় না পেয়ে বাংলাদেশের লক্ষ তরুন তখন জমায়েত রাজধানী ঢাকার শাহবাগে।ফলে প্রচণ্ড চাপে থাকা ইসলামি দল জামাত এবং প্রধান বিরধি দল বি এন পি মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিতে আর ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে আবারও বেছে নেয় সংখ্যা লঘুদের উপর হামলা।পুরো দেশ ব্যপি একের পর এক মন্দির হিন্দু বাড়ি ঘর এবং বিশেষ করে হিন্দু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চালানো হয় হামলা।কয়েকদিনের ভিতর কয়েক হাজার মন্দির আর বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়।এই সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে তৎকালীন শাসক দল আওয়ামীলীগএর নেতারাও হিন্দুদেরকে অত্যাচার করে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের পর আবার শুরু হয় সংখ্যা লঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন যেখানে কিছু জায়গাতে শাসকদল আওয়ামীলীগের লোকজনও যে জড়িত ছিল তার স্পষ্ট প্রমান রয়েছে। এখানেও ঘটে সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের ঘটনা।

ভারত(পশ্চিম বাংলা) কে সংখ্যালঘু?:

➤৪ই ফেব্রুয়ারী ২০১৪, পশ্চিম বাংলার হাওড়া, মুসলিমদের বিশ্ব নবি দিবস উপলক্ষে এক ধর্মীয় শোভা যাত্রা বার হয়, কিন্তু কিছু পরে এই যাত্রা থেকে এক হিন্দু মেয়েকে টোন টিটকিরি কাটা হয়, তাতে হিন্দুরা প্রতিবাদ করলে মুসলিমরা এই এলাকায় ৫০ টির বেশি হিন্দু বাড়ি ও দোকান ভাংচুর করে । হিন্দুরা আজও এই এলাকা থেকে পলাতক ।।
➤৬ই সেপ্টেমবার ২০১০, পশ্চিম বাংলার দেগাঙ্গা, প্রতি বছরের মত হিন্দু দুর্গা পুজা অনুষ্ঠানের জন্য প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ এলাকার মুসলিমরা হিন্দুদের প্যান্ডেল করতে বাধা দেয়, তারা দাবি করে যে ওই স্থানটি মুসলিম কবরস্থান তাই পুজা করা যাবে না । কিন্তু বিগত বছরগুলিতে ওই স্থানেই হিন্দু রা পুজা করে এসেছে, কিন্ত মুসলিমরা এইবার নিজেদের গায়ের জোরে পুজা প্যান্ডেল ভেঙে ফেলে দেয় । তারপর ৫০০ টির বেশি হিন্দু বাড়ি, দোকান, মন্দির ধ্বংস করে । অনেক হিন্দু মহিলা কে ধর্ষণ করে ।
উক্ত ঘটনাগুলো, একটাও আমার নিজের বানানো কথা নয়, প্রিন্ট মিডিয়া ঘাঁটলে নিজেরাই খুঁজে পাবেন।

প্রিয়া সাহা ভারতীয় উপমহাদেশে ভূখণ্ড বিভাজনের পরে, কারা কোথায় ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে প্রকৃত সংখ্যালঘু ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.