বাংলার গর্ব স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত)

আধ্যাত্মিকতার লীলাভূমি হলো আমাদের এই ভারতবর্ষ! আর হিন্দু ধর্ম এই দেশের শিকড় স্বরূপ। ইতিহাসে দেখা গেছে যখনই এই শিকড়ে টান পড়েছে কোনো না কোনো ভাবে‚ তখনই ঠিক কোনো না কোনো ধর্মগুরু এগিয়ে এসেছেন ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে।
আদি শঙ্কর‚ মাধব বিদ্যারণ্য‚ রামদাস‚ চৈতন্যদেব‚ গুরু গোবিন্দ সিংহ সহ এমন অসংখ্য মহাপুরুষদের সারিতেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে দ্বিধাগ্রস্ত‚ পরাধীন‚ হীনমন্য হিন্দুজাতিকে বাঁচাতে জন্ম নেন আরো একজন মহাপুরুষ! শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাষায় সপ্তর্ষির এক ঋষি‚ স্বামী বিবেকানন্দ।

স্বামী বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ সালে, উত্তর কলকাতার শিমুলিয়া গ্রামের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে | পিতৃদত্ত নাম ছিলো নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের স্বনামধন্য আইনজীবি বিশ্বনাথ দত্ত ও মা ছিলেন ভুবনেশ্বরী দেবী।

ছোটবেলা থেকেই স্বামীজির মনে আধ্যাত্মিকতার ভাব ছিলো প্রবল। আর এর পেছনে সর্বাধিক ভূমিকা ছিলো তাঁর মায়ের। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা ছিলেন। একজন আদর্শ ভারতীয় নারীর মতোই হিন্দুশাস্ত্র, রামায়ণ ও মহাভারতের বিষয়ে তাঁর পান্ডিত্ব ছিলো প্রচুর। এছাড়াও ইংরাজী ভাষাটাও তিনি ভালোই বুঝতে ও একটু আধটু বলতেও পারতেন |

বিবেকানন্দ ১৮৭১ সালে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে সর্বপ্রথম ভর্তি হন। পরবর্তীতে তার পরিবার ছত্তিশগড়ের রায়পুরে স্থানান্তরিত হলে তিনিও তাদের সাথে ছত্তিসগড়ে চলে যান।

রায়পুর থেকে আবার ১৮৭৯ সালে ফিরে এসে, প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করে তিনি ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। আর সেইবছর কলেজের একমাত্র ছাত্র হিসাবে সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

এরপর প্রেসিডেন্সি থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভর্তি হন কলেজ স্কটিশ চার্চ কলেজে। সেখানে তিনি পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৮৮৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

কলেজে পড়ার পাশাপাশি তিনি পাশ্চাত্য দর্শন ,ইউরপের ইতিহাস নিয়েও পড়াশোনা করেন। বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ন প্রভৃতি পাঠে তার যথেষ্ট ঝোঁক ছিল। তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত এর তালিম নিতেন। হেগে্ল্‌, মিল, ডারউইন এর রচনাবলী পাঠ করতেন। এই সময়ে থেকেই তার মনে ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল।তার এই মানসিক ধ্যান ধারনাই তাকে ব্রামহসমাজ যুক্ত হতে সাহায্য করে।এই সময়ে কেশব চন্দ্র সেনের নেতৃত্বে গঠিত ব্রামহসমাজ আন্দোলনে তিনি যোগ দেন।

আর তার কিছু সময় পরে এই আধ্যাত্মিক প্রশ্নের সূত্র ধরেই তাঁর সাথে যোগাযোগ ঘটে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের। যে ছোট্ট ঘটনাই পরবর্তীতে পাল্টে দেবে ভারতবর্ষের ধর্ম – দর্শন এমনকি রাজনীতি চর্চার অভিমুখকেও। রামকৃষ্ণের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বর ফলে নরেন্দ্রনাথ তাঁর পরম ভক্ত হয়ে যান এবং রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের।

১৮৮৫ সালে যখন রামকৃষ্ণ পরমহংসের মৃত্যুর পর অবশেষে ১৮৮৬ সালে ১৬ই অগাস্ট স্বামীজির নেতৃত্বে রামকৃষ্ণের ১২ জন শিষ্য কোলকাতার নিকটবর্তী বরাহনগর অঞ্চলে রামকৃষ্ণ মঠের  প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে তাঁরা গুরুর কাছ থেকে শেখা সমস্ত আধ্যাত্মিক সাধনাগুলোর অনুশীলন করতে থাকেন।

১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে হুগলী জেলার আঁটপুর গ্রামে বড়দিনের আগের সন্ধ্যায়ে তিনি সন্ন্যাস গ্রহন করেন। এখানেই নরেন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বপরিচয় ত্যাগ করে স্বামী বিবেকানন্দ নাম গ্রহন করেন।

এইসময় বিবেকানন্দ সমগ্র ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন | যাতে তিনি ভারতবর্ষের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারেন। ১৮৮৮ সালে তিনি পরিব্রাজকরূপে বেরিয়ে পড়েন ভারত ভ্রমনে।পাঁচ বছর ধরে তিনি ভারতের সর্বত্র ভ্রমণ করেন এবং বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সুপরিচিত হন |

সারা ভারত ঘুরে তিনি দেখেছিলেন নিদারুন দারিদ্র্য‚ হিন্দুদের দুর্বলতা‚ সংগঠনহীনতা‚ পরাধীনতা ও ধর্মের নামে জাতপাতের অত্যাচার! এসব থেকে ভারতকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি ১৮৯৩ সালে
আমেরিকায় আয়োজিত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন।

এই ধর্ম সন্মেলনেই তিনি বিশ্বের বুকে হিন্দুধর্ম ও ভারতবর্ষকে পুণরায় সবার উপরে তুলে ধরেন। ফলে ঔপনিবেশিক ও মিশনারি প্রচারে বিভ্রান্ত পশ্চিমা সভ্যতা ভারত সম্পর্কে আসল তথ্য জানতে পারে। পরিচিত হতে পারে ভারতের সুমহান সভ্যতা ও গভীর দর্শনের সাথে।

ভগিনী নিবেদিতা‚ সোভিয়ার দম্পতি সহ অসংখ্য ইউরোপীয় ও আমেরিকান বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহন করে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হিন্দুধর্মের বীজ বপন হয় ইউরোপের মাটিতে।

অবশেষে ১৮৯৭ সালে ১ লা মে তারিখে বিবেকানন্দ কোলকাতায় ফিরে এসে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা করেন | এই মিশন তৈরীর পিছনে তাঁর উদেশ্য ছিলো নতুন ভারতের নির্মান। মানুষের সেবাই ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

এরপর ১৮৯৮ সালে স্বামীজি প্রতিষ্ঠা করেন বেলুড় মঠ। এই বেলুর মঠ আজ পর্যন্ত ভারতবাসীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক তৃষ্ণা মিটিয়ে চলেছে।

১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই এ সকাল বেলা  বেলুর মঠে ধ্যান করার পর ছাত্রদের শিক্ষা দান করেন।তারপর সকাল ৭ টায়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে ৯.৩০ এ  মস্তিস্কের রক্তনালি ফেটে তাঁর মৃত্যু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.