১)
কোরোনার সংক্রমণের কারণে পৃথিবীর গতি ব্যতীত সমস্ত গতি যেন থেমে গিয়েছে।
বিমান উড়ছে না, ট্রেন চলছে না, গাড়ি দৌড়চ্ছে না, মানুষের পায়ে হেঁটে ঘোরাও যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
পৃথিবী-প্রকৃতি স্বচ্ছ এবং সুস্থ শ্বাস নিচ্ছে।
এই কয়েক দিনের মধ্যেই সমস্ত দূষণ থেমে গিয়েছে, নদীর জল পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, প্রাণী নির্ভয়ে শহরের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বায়ু এত শুদ্ধ হয়ে গিয়েছে যে, পাঞ্জাবের জলন্ধর থেকে হিমালয়ের হিমাচ্ছাদিত শিখর সরাসরি দেখা যাচ্ছে।
এগুলি কয়েক দিনের জন্য হলেও, যা অসম্ভব বলে মনে হত সেই সমস্ত কিছুই এর মধ্যে সম্ভব বলে প্রমাণিত হচ্ছে। গতি থেমে গেল কী হয়? এটা জানা দরকারও এবং বেশ আকর্ষণীয়ও।
গতি বেড়ে কী হয় সেটা বুঝলেই গতি থেমে গেলে কী হয় সেটা বোঝা সহজ হবে।
শ্রী এস.কে. চক্রবর্তী তাঁর “Rising Technology and falling ethics” প্রবন্ধে লিখেছেন :
“আধুনিক বিজ্ঞান এবং তার দ্বারা বিকশিত প্রযুক্তির বিকাশ এমন একটি সময়ে হয়েছে যখন মানব জাতি, পৃথিবী এবং প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তার ভাবনাত্মক সম্বন্ধের বন্ধন ভাঙ্গতে শুরু করছে। প্রবুদ্ধ বস্তুনিষ্ঠতার প্রচেষ্টাই ছিল মানুষ এবং প্রকৃতির সম্বন্ধগুলিকে মজবুত করার মত লক্ষণ, ক্রিয়াকলাপ এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাগুলিকে নিরর্থক প্রতিপাদন করে তাদেরকে অন্ধবিশ্বাস বলে দেগে দেওয়া। ‘ভবিষ্যতের চিন্তা কর না’– এই ভাবনার সুচিন্তিত বহিঃপ্রকাশকেই প্রগতিশীল এবং মুক্ত মানসিকতার পরিচয় বলে মনে করা শুরু হল। আসল বিচ্ছিন্নতার সূচনা এখান থেকেই। যখন কোন ঘনিষ্ঠতাই থাকল না তখন কীসের ভাল আর কীসের খারাপ। মনু্ষ্য ব্যবহার এবং প্রকৃতির মধ্যেকার নীতি-অনীতির বিচারের বিলোপের সবচেয়ে বড় স্পষ্টীকরণ এই ভাবনাতেই নিহিত আছে। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পদার্থ, বায়ু, জল, কাল, দূরত্ব প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের উপর বিজয়ের দ্বারা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাহ্য ভৌতিক জীবনের অনেক দিকে লাভ হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়ের বদলে একগুঁয়েমি, ভয় ও সম্মানের বদলে খিটখিটে ভাব, অহঙ্কারের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবৃত্তিকে অবহেলা করা যায় না। এই বিকৃতিই মানুষ ও প্রকৃতির দূরত্বের প্রমুখ কারণ। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে আত্মীয়তার এই অভাব পরিবেশের প্রতি অনাচারের প্রমুখ কারণ তো বটেই, সেই সঙ্গে অনাত্মীয়তার এই লোকাচার মানব সমাজের সমস্ত আয়ামগুলিকে অধিকার করতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্বন্ধ, সংগঠনের সঙ্গে সংগঠনের সম্বন্ধ, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ এবং এই ধরণের অন্যান্য সম্বন্ধগুলি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইঞ্জিনের শক্তির সঙ্গে মিলে ভৌতিক সমৃদ্ধির চরম লক্ষ্য প্রাপ্তির সাধন রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই কারণে আজকাল আন্তর্জাতিক প্রবন্ধন সম্মেলনগুলিতে চিন্তাভাবনার আদান-প্রদানকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সেখানে গুপ্ত রাজনৈতিক এবং ভৌতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভিতরে ভিতরে কাজ করতে থাকে। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দৌড়কে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলা। এি প্রক্রিয়ায় নৈতিকতার কোমল ভাবনাগুলি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। সেগুলি যে কেবলমাত্র প্রকৃতির একটি স্রোত, সাধন রূপেই বেঁচে থাকে তাই নয়, বরং, মানুষও অনৈতিক উপায়ে চতুরতায় ভরা দৃষ্টিভঙ্গীকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে। উপকরণ থেকে মেশিন, মেশিন থেকে অটোমেশন, অটোমেশন থেকে চিপ– এই নিরন্তর প্রগতি মানুষকে মানবতা থেকে দূরে, আরো দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এই মানসিকতার কারণেই মানুষ কেবল প্রকৃতির সঙ্গেই নয়, সমাজ এবং সঙ্গীসাথীদের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পরিণামস্বরূপ মানুষ নিজের পরিবেশ, আত্মীয়, অনাত্মীয় সকলের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিক অহঙ্কারী, ক্রূর এবং হিংস্র হয়ে পড়ছে। এবং এই ধরণের মানসিকতা সম্পন্ন সমাজই (তথাকথিত) ‘বিকশিত, আধুনিক’ সমাজ এবং মানব জাতি বলে স্বীকৃত। এই ‘প্রগতিশীল, বিকশিত’ সমাজের মূল, কুল, অপরিপক্ব জ্ঞান এবং জীবনের তুলনামূলক অল্প অভিজ্ঞতার দিকে তাকালে মনে হয় তাদের সিদ্ধান্ত ভুল, অপরিপূর্ণ এবং বিসঙ্গত।”
অপ্রত্যাশিত গতিবৃদ্ধিতে এইটি হয়েছে।
এখন গতি থেমে যাওয়ার কারণে নদীর জল শুদ্ধ হয়েছে, ব্যক্তি পরিবারে আত্মীয়দের সঙ্গে অধিক সময় যাপন করছেন, সম্পর্কগুলির উষ্ণতা সকলে অনুভব করছেন। কত কম চাহিদায় জীবন আনন্দে কাটানো যেতে পারে সেই বিষয়টি সকলে উপলব্ধি করতে পারছেন।
ভারতীয় দৃষ্টির সারমর্ম বোঝায় এমন একটি সন্দেশ আজকাল প্রসারিত হচ্ছে, “When you can not go outside, go ‘Inside’.” কিন্তু এর পরে কী? জগতের অর্থনীতির চাকা থেমে গিয়েছে, চাকরি চলে যাচ্ছে, বেতন দিতে হবে, পুরোনো দেনা মেটাতে হবে, লোক শহর ছেড়ে নিজের গ্রামে, নিজের রাজ্যে ফিরে যাচ্ছে, যারা মাঝখানে ফেঁসে গিয়েছে তাদেরকে রাজ্য সরকারের সাহায্যে গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের মত বিবিধতায় ভরা বিশাল জনসংখ্যার দেশের সামনে এটি একটি বড় প্রশ্ন। বিলী লিম্ নামক জনৈক লেখক তার ‘Dare to Fail’ নামক পুস্তকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আপনি কোন সমস্যার সম্মুখীন হন তখন নিজেকে সমস্যার থেকে দূরে রাখেন, তখন সেটি হয় পরিস্থিতি। আপনি যখন সেই পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেন তখন সেটি চ্যালেঞ্জের রূপান্তরিত হয়। এবং যদি আপনি নিজ সামর্থ্য এবং সম্পদের হিসাব করে সেই অনুসারে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হন তবে সেটি হবে সুযোগ।
((When you face a problem and take yourself away from it, it becomes a situation. When you are to analyse it, it becomes a challenge. And when you think of your resources to meet the challenge, it becomes an opportunity.—Billy Lim)
ভারতের পরম্পরাগত শিক্ষা পদ্ধতিতে মৌলিক চিন্তা (Innovation), জিজ্ঞাসার অবসর ছিল– এর দ্বারা প্রশ্নের উত্তর নিজে নিজে খুঁজে বের করার উৎসাহ পাওয়া যেত। শিক্ষক বা আচার্য পড়াতেন যে কীভাবে শিখতে হয় (Teaching how to learn) এবং কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে সেটি নিজ আচরণের দ্বারা শিক্ষা দিতেন। বর্তমানে ভৌতিক সুখ প্রাপ্তির জন্য ধনার্জনের শিক্ষাই বিতরণ করা হচ্ছে। এর পরিণাম স্বরূপ চাকুরিপ্রার্থী, আত্মকেন্দ্রিক এবং জড়বাদী প্রজন্ম তৈরি করে চলেছি আমরা।
ভারতবর্ষে বিকাশকে মাপার মাপকাঠি এবং তার অভিমুখ নগরকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকা প্রভৃতি সমস্ত সুবিধা নগরকেন্দ্রিক হতে থেকেছে। ফলতঃ, গ্রাম থেকে শহরের দিকে, শহর থেকে মহানগরের দিকে, মহানগর থেকে মেট্রো সিটির দিকে, মেট্রো সিটি থেকে বিদেশের দিকে ভারতবর্ষের প্রতিভা এবং বুদ্ধির পলায়ন বা স্থানান্তর হয়ে চলেছে। সেই কারণে গ্রাম খালি হয়ে চলেছে, শহরে ভিড় বেড়ে চলেছে। শহুরে জীবন সুবিধাপূর্ণ, কিন্তু প্রচণ্ড গতিময়, ভূমি থেকে দূরবর্তী এবং অসার হয়ে চলেছে। কিন্তু কোন বিকল্প নজরে আসছে না।
বিশ্বায়ন (Globalisation), যেটিকে বিকাশশীল এবং অবিকশিত দেশগুলির উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার কুপরিণাম বর্তমানে চোখে পড়ছে। বিকাশশীল এবং অবিকশিত দেশগুলির শোষণের, উপনিবেশীকরণের (Colonisation) পরবর্তী অবতার হল বিশ্বায়ন। আজ সবাই এটি অনুভব করছে এবং এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজছে।
সেজন্য যখন সব থেমে গিয়েছে, সমস্ত বিশ্ব নতুন গড়নের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছে, আশঙ্কিত হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হল, তাদেরকে আশ্বাসিত করা ক্ষমতা কি ভারতের আছে এবং ভারত কি সেই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত?
এর উত্তর অবশ্যই সদর্থক। ভারত এই কাজ করতে পারে। কেবল ভারতই করতে পারে। কারণ ভারতের কাছে এমন তিনটি বিষয় আছে যেগুলি কেবল ভারতের কাছেই আছে। প্রথমতঃ, ভারতের কমপক্ষে দশ হাজার বছরের অধিক সময়ের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের অভিজ্ঞতা আছে। দ্বিতীয়তঃ, ভারতের কাছেই সৃষ্টির বিষয়ে একটি অধ্যাত্ম আধারিত সর্বাঙ্গীণ এবং একাত্ম দৃষ্টিকোণ ও তদাধারিত জীবনের ভাবনা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার কারণে বর্তমানে পৃথিবী এত কাছে চলে এসেছে যে, সাম্প্রদায়িক (religious), গোষ্ঠী-অনুসারী (ethnic) এবং ভাষাগত (linguistic) বিবিধতার সঙ্গে পরস্পরের পূরক একত্র জীবন যাপন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং সংযত ভোগ দ্বারা জীবনের উৎসব পালনের কলা ভারত জানে। জগৎও এটি জানে এবং জগতের এই বিষয়ে অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ভারতবর্ষ সমৃদ্ধির শিখরকে দেখেছে। খৃষ্টপূর্ব ১৭০০ বছর পর্যন্ত বিশ্বের বাণিজ্যে সর্বাধিক অংশীদারী ভারতের ছিল। ইতিহাস সাক্ষী যে, হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের মানুষ বাণিজ্যের জন্য সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। কিন্তু অধ্যাত্ম ভিত্তিক হওয়ার কারণে জীবনের সর্বাঙ্গীণ এবং একাত্ম দৃষ্টির কারণে বিকশিত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ এর ভাবনার কারণে ভারতীয়রা কখনও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেনি। কখনও কারও শোষণ করেনি। কখনও কাউকে পদানত করেনি। বরং, নিজ আচরণের দ্বারা সকলকে সংস্কৃতি এবং জীবন যাপনের সুন্দরতর পদ্ধতি শিখিয়েছে; সকলকে সম্পন্ন, সমৃদ্ধ করেছে। (we created wealth there)
সুতরাং, ভারতের (India) কাছে দৃষ্টিকোণ (vision), দক্ষতা (expertise) এবং অভিজ্ঞতা (experience) তিনটিই আছে। ভারত দিশা দেখাতে পারে। এখন কীভাবে এগোতে হবে তার বিচার করা প্রয়োজন।
(২)
এখন সমাজ এবং রাষ্ট্র হিসাবে এগোনোর উপায়টি সম্পর্কে চিন্তা করা যেতে পারে।
ভারতবর্ষ কখনওই নিজের বিষয়ে চিন্তা করেনি। সবসময়ই নিজের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের কল্যাণের কথা ভারত সর্বদাই ভেবেছে। ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ এটিই ভারতবর্ষের চিরকালীন বিচার এবং আচরণ।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ নামক প্রবন্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “আমাদের বুদ্ধি, আমাদের হৃদয়, আমাদের রুচি যে প্রতিদিন জলের দরে বিকাইয়া যাইতেছে তাহা প্রতিরোধ করিবার একমাত্র উপায়– আমরা নিজে যাহা তাহাই সজ্ঞানভাবে, সরলভাবে, সচলভাবে সম্পূর্ণভাবে হইয়া উঠা।” এই ‘আমরা’-এর বৈশিষ্ট্য আমাদের অধ্যাত্ম ভিত্তিক এবং অধ্যাত্ম ভিত্তিকতার কারণে একাত্ম ও সর্বাঙ্গীণ জীবনদৃষ্টিতে ওতপ্রোত হয়ে আছে। হিমালয় থেকে আন্দামান পর্যন্ত বিস্তৃত এই ভূমিতে বসবাসকারী বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন জাতির নামে পরিচিত, অনেক উপাস্য দেবতার উপাসনাকারী, বহু শতাব্দী যাবৎ এখানে বসবাসকারী, প্রত্যেক সমাজ এই ‘আমরা’-র বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে রেখেছে, এই বৈশিষ্ট্যকে নিজেদের বলে মনে করে এসেছে। এই বৈশিষ্ট্য লোকে জানে, একে অনেক নামে জানে। আমাদের বৈশিষ্ট্য হল– ‘একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’, ‘প্রতি ব্যক্তি ঈশ্বরেরই অংশ’। সর্বোপরি, ‘সেই’ ঈশ্বরতত্ত্বের সহিত যুক্ত হওয়ার পথ সকলের নিজ রুচি, প্রকৃতি এবং যোগ্যতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কেবল ‘তাঁর’ সঙ্গে মিলিত হওয়ার, ‘তাঁকে’ কাছ থেকে জানার পথে সর্বদা চলতে থাকতে হবে। এই চারটি প্রমুখ বিষয়ের উপরে আমাদের এই ‘বৈশিষ্ট্য’ প্রতিষ্ঠিত। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য অভিব্যক্ত হওয়া প্রয়োজন। এটিই হল ‘আমরা নিজে যাহা তাহাই… সম্পূর্ণভাবে হইয়া উঠা’-এর মর্ম।
আজও ৭০ শতাংশ ভারতবর্ষ গ্রামে বসবাস করে। কিন্ত এই গ্রাম আগে কেমন ছিল? গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা ছিল না, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ভাল ব্যবস্থা ছিল না, জীবিকার অবকাশ ছিল না, গ্রামে বসবাস পশ্চাৎপদতার লক্ষণ বলে গণ্য হত। এই কারণে বিদ্যার্জন, বিদ্যার্জনের পরে জীবিকার উদ্দেশ্যে শিক্ষিত শ্রেণী, প্রতিভা-মেধা গ্রাম থেকে পলায়ন করত। কিন্তু এখন অবস্থা বদলে গিয়েছে, বদলাচ্ছে এবং আরও বদলানোর সম্ভাবনা আছে। এই পরিবর্তন প্রয়োজনীয়ও বটে। এখন গ্রামে রাস্তা হয়েছে, বিদ্যুৎ, ইণ্টারনেট, মোবাইল, যাতায়াতের জন্য যানবাহন সুলভ। আরও সুলভ হবে। গ্রামেই স্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে লোক গ্রামে থাকতেই পছন্দ করবে। শহরকেন্দ্রিক অর্থনীতির পরিবর্তে বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি, শিল্প প্রভৃতির সম্ভাবনা বাড়ছে। কোরোনার কারণে শহর থেকে লোক নিজের গ্রামে, নিজের লোকের কাছে– যেখানে তাদের শিকড় মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত– সেখানে পৌঁছচ্ছে। এর মধ্যে শিক্ষিত শ্রেণীও রয়েছে। যদি তাদেরকে গ্রামেই রেখে দিয়ে গ্রামের উন্নতির কার্যক্রমে যুক্ত করা যায়, সেখানেই জীবিকার ব্যবস্থা করা যায়, তবে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের মধ্যে ৪০শতাংশ মানুষকে আমরা সেখানেই স্থায়ীভাবে কর্মরত অবস্থায় রাখতে পারব।
আজকের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে ‘Innovation’-এর, যে মৌলিক চিন্তার ঘাটতি রয়ে গিয়েছে– অনলাইন প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষিত শ্রেণীকে ‘Innovation’-এর জন্য প্রশিক্ষিত করা সম্ভব। গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষিভিত্তিক অনেক নতুন শিল্প গ্রাম থেকে শুরু করা যেতে পারে। গ্রামসমূহের (Clusters) মাধ্যমে পরস্পরেরে পরিপূরক শিল্পের শৃঙ্খলার বিকাশ করা যেতে পারে। গ্রামে উৎপাদিত বস্তুসমূহকে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সরাসরি ক্রেতার কাছে অথবা স্থানীয় খুচরো বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। এই কাজে অনেক যুবকের কর্মসংস্থান হবে। আজ উবের, ওলা প্রভৃতির মাধ্যমে সুন্দর সুবিধাযুক্ত পরিষেবা আমাদের দরজায়, একটি কলের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। গাড়িটি কতক্ষণে আসবে, কতক্ষণে পৌঁছবে ইত্যাদি সমস্ত তথ্য তৎক্ষণাৎ সরবরাহ করা হয়। সরাসরি অর্থ প্রদানের ব্যবস্থাও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্ভব। মানুষ এগুলি জানছে এবং তার ব্যবহারও করছে। এই কারণে বহু যুবকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে।
আজ রাসায়নিক সারের ভয়ে জগৎ সন্ত্রস্ত। জৈবিক কৃষির গুরুত্ব এবং মূল্য মানুষ বুঝতে পারছে। কিছু বেশি দাম দিয়ে হলেও লোক নির্ভেজাল খাদ্য চাইছে। চাহিদা ও সরবরাহের এই শৃঙ্খলাকে পরস্পরের উপযোগী, সন্তুলিত অর্থব্যবস্থা রূপে যদি বিকশিত করা যায়, সরাসরি ক্রেতার কাছে যদি এই পণ্য পৌঁছে দেওয়া যায় তবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমেও প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে। দেশীয় প্রজাতির গোরুর দুধ, তার থেকে উৎপন্ন দুগ্ধজাত সামগ্রীর চাহিদা বাড়তে পারে। এই সমস্ত যোজনা গ্রামকেন্দ্রিক এবং গ্রামসমূহ কেন্দ্রিক হতে পারে, হওয়া উচিত।
আজ কর্মসংস্থানের সর্বাধিক ক্ষমতা রয়েছে কুটীর শিল্প এবং ক্ষুদ্র শিল্পে। বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য মৌলিক পরিষেবাগুলি গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গ্রামেই ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের জন্য উৎসাহ এবং কিছু সহায়তার ব্যবস্থা করা দরকার। শিল্প স্থাপন যাতে সহজ এবং সুলভ হয় সেই ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। প্রারম্ভিক অবস্থায় গ্রামীণ ক্ষেত্রে শিল্প স্থাপনের জন্য অল্প সুদে ঋণ এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। পৃথিবীতে আমাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রী করার জন্য পণ্যের ডিজাইনের উপরেও নজর দিতে হবে। কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশগুলিতে ডিজাইনের উপরে অনেক আগে থেকে নজর দেওয়া হয়েছে। সেজন্য সমগ্র বিশ্বে সেখানকার পণ্যের বিপুল চাহিদা। ভারতেও ডিজাইনিংয়ের অনলাইন কোর্স, কর্মশালা শুরু করা দরকার।
ভারতের অর্থনীতিতে চীনের বিপুল প্রভাব ছিল। কোরোনা মহামারীর সময়ে চীন প্রচণ্ড বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে। এখন ভারত যদি চীনে উৎপন্ন পণ্য বহিষ্কার করে তবে সমাজে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের পরিপূর্ণ সম্ভাবনা বর্তমান। কিন্তু তার আগে যে সমস্ত পণ্য কেবল দামে শস্তা হয় বলে চীন থেকে আমদানি করা হয় সেই সমস্ত পণ্যের স্বদেশী বিকল্প ভারতে প্রস্তুত করতে হবে। এটি এক প্রকার অর্থনৈতিক যুদ্ধই বটে। সেজন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এই ব্যবস্থা করতে পারলে বহু যুবের কর্মসংস্থানের প্রচুর সুযোগ তৈরি হবে।
অনেক দেশই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করার কথা ভাবছে বলে মিডিয়াতে প্রচারিত হচ্ছে। যদি আমরা চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের উত্তম এবং শস্তা স্বদেশী বিকল্প প্রচুর মাত্রায় উৎপাদন করতে পারি তবে পৃথিবীর বহু দেশ চীনের বদলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে উৎসাহী হবে। এতে ভারতের যুবসমাজের সামনে জীবিকার নতুন সুযোগ আসবে। এটি যদি হয় তবে ভারতের রপ্তানি বাড়বে। ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় হবে। সরকার রপ্তানিকে সহজ এবং শস্তা করার ব্যবস্থা করুক। বাকি সমস্ত ঝুঁকি সমাজ নিতে প্রস্তুত হবে।
স্থানীয় স্তরের কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে মাথায় রেখেই সমস্ত পরিকল্পনা করতে হবে। প্রত্যেক দেশের জন্যই স্বদেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং অনিবার্য বিষয়। বিশ্বায়নের ‘one size fits all’ এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। পরস্পরের সম্মতিতে, পরস্পরের পরিপূরক আর্থিক সহযোগিতা এবং বাণিজ্যিক সম্বন্ধ দুইটি দেশের মধ্যে হলে সেটি উভয়ের পক্ষে কল্যাণকর হবে।
এই সমস্ত শিল্পই গ্রামসমূহকেন্দ্রিক হলে উৎপন্ন পণ্যের মূল্যও তুলনামূলক কম হবে, কারণ গ্রামে জীবন যাপনের মূল্য (cost of living) শহরের তুলনায় কম এবং জীবনের গুণমান (quality of life) শহরের তুলনায় অনেক ভাল হবে। মানুষ আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে থাকবে, নিজ ভূমির সঙ্গে জুড়ে থাকবে, গ্রামের সমাজিক জীবনেও নিজের অবদান রাখার সুযোগ পাবে, শহরে থাকার অভিজ্ঞতার সাহায্যে গ্রামেই অনেক ক্রিয়াকলাপের সূচনা করতে পারবে।
এই সমস্ত কিছু কেবল সরকারের উপর নির্ভর করে করা সম্ভব নয়। সমাজের উদ্যম এবং সরকারী সাহায্য– এই দুইয়ের মিলনেই এগুলি সম্ভব। একটি সর্বাঙ্গীণ (total) এবং একাত্ম (integrated) পরিকল্পনা করতে হবে। ধীরে ধীরে সরকারের উপরে নির্ভরতা কমিয়ে, সমাজ স্বাবলম্বী হয়ে এই সমস্ত কার্যকলাপ চালাতে সক্ষম হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বদেশী সমাজ’-এর কল্পনা এমনই ছিল। তিনি বলতেন, যে সমাজ যত কম সরকারের উপর নির্ভরশীল সেই সমাজ তত স্বদেশী।
ভারতে নব শিক্ষা নীতির প্রস্তুতি চলছে। পূর্ণ বিচার বিশ্লেষণের পরে শীঘ্রই সেই শিক্ষানীতি চালু হবে। যদি তা হয় তবে ভারতীয় মূলের সঙ্গে জুড়ে, ভারতীয় মূল্যবোধের উপর আধারিত জীবন যাপনের লক্ষ্যে অটল প্রজন্ম তৈরি হবে। সব রকম ভাবে ঐহিক সমৃদ্ধি এবং সম্পন্নতার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরে ‘ঈশ্বরতত্ত্বকে’ উপলব্ধি করা এবং তাকে আত্মসাৎ করার প্রয়াস বজায় রাখা– এই দুইটিকে একসঙ্গে বজায় রাখার সাধনাকেই হাজার হাজার বছর ধরে ভারতে জীবনের পূর্ণতা বলে স্বীকার করা হয়েছে। ‘যতোঽভ্যুদয়নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ’– ভারতের এই প্রাচীন বচনটির তাৎপর্য এটিই। ভারতীয় আধ্যাত্মিক বিচারধারার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজের নির্মাণ করলে সমাজকে সমৃদ্ধ এবং সম্পন্ন করার ইচ্ছায় এবং কর্তব্যবোধে প্রেরিত হয়ে সমাজকে কিছু দেওয়ার প্রবৃত্তি বাড়বে। সমাজের নিকট একত্রিত এই সামাজিক পুঁজির দ্বারা সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পন্ন এবং সমৃদ্ধ হবে।
বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা বলতেন, যে সমাজে মানুষ নিজের পরিশ্রমের পারিশ্রমিক নিজের কাছে না রেখে সমাজকেই ফিরিয়ে দেয়, সেই সমাজে এই সংগঠিত সামাজিক পুঁজির সাহায্যে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পন্ন এবং সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু যে সমাজে লোক নিজের পরিশ্রমের পারিশ্রমিক সমাজকে না দিয়ে নিজের কাছেই জমিয়ে রাখে সেই সমাজে মুষ্টিমেয় লোকই বড়লোক হয়। আমাদের দেশে সমাজকে নিজের মনে করে দেওয়াকেই ‘ধর্ম’ বলা হয়েছে। শক্ত সরকারের উপরে নির্ভরশীল নয়, ধর্মের শক্তিতে শক্তিশালী সমাজই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, সম্পন্ন এবং সমৃদ্ধ হয়েছে।
শ্রেষ্ঠ মানুষকে দেখে অন্যরাও তাকে অনুসরণ করবে–
যদ্ যদ্ আচরতি শ্রেষ্ঠস্তৎ তদ্ এবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদ্ অনুবর্ততে॥
এই সমস্ত সম্ভাবনাগুলিকে মনে রেখে ভবিষ্যতের ভারত, তার ব্যবস্থা সমূহের বৃহৎ নীল নকশা তৈরি করা দরকার, একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা দরকার। এটিই ‘কোরোনা কাল’-এর শিক্ষা।
ড. মনমোহন বৈদ্য
সহ সরকার্যবাহ
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ