নিউ দিল্লী: অনেকেই জানেন না যে জম্মু কাশ্মীরের একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক দল হল প্রজা পরিষদ পার্টি, যারা শ্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের কাশ্মীর নীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। ধারা ৩৭০ -এর সংশোধন এবং ধারা ৩৫(এ) অপসারণের মাধ্যমে পুরো ভুখন্ডের ( এখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল) রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পটপরিবর্তনের জন্য দায়ী। তবে আজ নয়,এই পালাবদলের সূচনা হয়েছে ১৯৫২সালের ১৪ই নভেম্বর। এই তারিখেই প্রজা পরিষদ পার্টির সদস্যরা জম্মু কাশ্মীরে প্রথম ‘সত্যাগ্ৰহ’ সূচনা করেন। এমনকি ভারতীয় জন সংঘ(বিজেএস) যা পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নামে পরিচিতি লাভ করেছে, তাদেরও অনেক আগে থেকেই ধারা৩৭ তুলে নেওয়ার জন্য প্রায় ১১ বছর ধরে প্রজা পরিষদ পার্টি লড়াই চালিয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের উৎপত্তি: ১৯৪৭ সালের ১৭ই নভেম্বর জম্মুতে প্রজা পরিষদ পার্টি স্থাপিত হয়। প্রথম সভাপতি ছিলেন হরি ভাজির এবং হংসরাজ পঙ্গোত্রা ছিলেন প্রথম সাধারণ সম্পাদক। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দুই সদস্য বলরাজ মাধোক এবং প্রেমনাথ ডোগরা ছিলেন পরবর্তী আন্দোলনের উত্তরসূরী এবং পার্টি স্থাপনের মূল হোতা।
১৯৫২সালের ১৪ই নভেম্বর ভারতের সাথে জম্মু কাশ্মীরের সম্পূর্ণ সংহতকরনের দাবিতে প্রথম আনুষ্ঠানিক ‘সত্যাগ্ৰহ’ চালু করে এই দলের হাত ধরেই। এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, জম্মু কাশ্মীরের কোনো বিশেষ সাংবিধানিক সুবিধা এবং পৃথক পতাকা থাকবে না। প্রজা পরিষদের দাবিগুলো এতোটাই জনপ্রিয়তার লাভ করেছিল যে ক্রমে এটা তাদের যুদ্ধের আওয়াজের রূপ নিয়েছিল: “এক দেশ মে দো বিধান,দোষ প্রধান,দো নিশান, নেহি চলেগি,নেহি চলেগি”।
এই আন্দোলনের প্রথম সাফল্য এসেছিল ঐ বছরেরই ১৭ই নভেম্বর মহারাজা হরি সিং-এর পুত্র করন সিং-এর হাত ধরে। তিনি সদর-ই-রায়াসত( প্রেসিডেন্ট অফ স্টেট) হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
সরকারের তরফ থেকেজম্মুতে পৃথক পতাকা উত্তোলনের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ভেস্তে দিয়েছিল প্রজা পরিষদ।
১৯৫২ সালের ২৬শে নভেম্বর, জম্মুতে একটি জনসভা আয়োজন করার অপরাধে ৬৮বছর বয়সে প্রথমবার প্রেমনাথ ডোগরা গ্ৰেপ্তার হন। শুধুমাত্র তাঁকে গ্ৰেপ্তার করেই পুলিশ ক্ষান্ত হয়নি, সাধারণ মানুষেরা উপর লাটি চালানোর পাশাপাশি জম্মুর বিভাগের সভাপতি ওমপ্রকাশ মেনঙ্গেসহ ৭জনকে গ্ৰেপ্তার করা হয়। এই আন্দোলন খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে কাঠুয়া, সাম্বা, ও উধমপুরসহ রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও।
আন্দোলনের ইতিবৃত্ত: ১৯৫২সালের ২রা ডিসেম্বর উধমপুরে রাজ্য পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে কমপক্ষে ৩০০জন আহত এবং ৫০জনেরও বেশি মানুষকে গ্ৰপ্তার করা হয়। যদিও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
আন্দোলন শুরুর ঠিক একমাস পরে প্রথম দূর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। চাম্ব তহসিল সদর দপ্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অপরাধে মেলা রাম নামে একজন সত্যাগ্ৰহীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। তার অন্ত্যাষ্টিক্রিয়ায় ৩০হাজারেরও বেশি মানুষের উপস্থিতি আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাবকে ইঙ্গিত করে। এই ঘটনার দুসপ্তাহ পর পুঞ্চ জেলার সুন্দরবানি তহসিলটিতে আবারও তেরঙ্গা উত্তোলনের চেষ্টা করতে গেলে তিনজন সত্যাগ্ৰহীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর প্রজা পরিষদের কর্মীরা সারা দেশব্যাপী এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৮ এবং ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও জাতীয় সম্মেলনের নেতা শেখ আবদুল্লাহর উপস্থিতিতে হায়দ্রাবাদ কংগ্রেস পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে পুস্তিকা পৌঁছে দেওয়া এবং বিতরণ কর্মসূচী পালন করা হয়। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নবগঠিত ভারতীয় জন সংঘের সাথেও প্রজা পরিষদের নেতৃবৃন্দ যোগাযোগ করেছিলেন।
এদিকে,১৯৫৩ সালের ৪ঠা জানুয়ারি করন সিংহ প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে লিখেছিলেন: “এই আন্দোলন শুরু হওয়ার দেড়মাস কেটে গেছে তবুও এটা খুব বেদনাদায়ক যে সরকার এখনও পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্ৰহন করেননি”
আরও আন্দোলন, আরও মৃত্যু
১৯৫৩ সালের ১১ই জানুয়ারী লোহরি উৎসবের দুদিন আগে পুলিশ একটি মিছিলের উপর গুলি চালায়, যেখানে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। বিক্ষোভকারীরা হীরানগরে সফররত জম্মু কাশ্মীরের তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী গোলাম বকসী মহম্মদের কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই মিছিলে ২০০ রাউন্ডেরও বেশী গুলি চালানো হয়েছিল। এই ঘটনায় ২জন নিহত ও ৭০জন আহত হয়েছিল।
১৯৫৩ সালের ১৬ই জানুয়ারী, প্রজা পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। ৩০শে জানুয়ারী জোডিয়ান গ্ৰামে ৩০০০জন প্রতিবাদকারীদের জমায়েত হয়েছিল। পুলিশ তাদের উপর গুলি চালালে ৬জনের মৃত্যু হয় এবং ১২৫জন আহত হয়। বহু মানুষ নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
১৯৫৩সালের ১লা মার্চ রামওয়ান কোর্ট কমপ্লেক্সে ৩জন বিক্ষোভকারী তেরঙ্গা তোলার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের গুলি করে মেরে ফেলে।
ইতিমধ্যে ভারতীয় জনসংঘ, হিন্দু মহাসভা এবং আকালি দল ১৯৫৩ সালের ৫ই মার্চ প্রজা পরিষদের সমর্থনে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে।
১৯৫৩ সালের ৮ই মে বিজেএস সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিউ দিল্লী থেকে একটি ট্রেনে জম্মু কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১১ই মে জম্মু কাশ্মীরে ঢুকতে গেলে তাঁকে বাধা প্রদান করে গ্ৰেপ্তার করা হয়। তিনি একমাসেরও বেশী সময় ধরে শ্রীনগরে আটক ছিলেন এবং সেখানে ১৯৫৩ সালের ২৩শে জুন রহস্যজনকভাবে মারা যান।
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলন বন্ধ করার জন্য প্রজা পরিষদের কাছে আবেদন জানান। ১৯৫৩ সালের ৭ই জুলাই বাধ্য হয়ে আইন অমান্য আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়। তবে ১৯৬৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ভারতীয় জনসংঘের সাথে সংযুক্তিকরনের আগে পর্যন্ত এক পতাকা এবং এক সংবিধানের উদ্দেশ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
পরে বিজেএস এবং তারপর ১৯৮০ সাল থেকে বিজেপি এই আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল।