সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদকামী এই দলটির নাম শোনেননি এমন ইতিহাসপাঠক বিরল।
এই সমিতি হিন্দুত্বের ভিত্তিতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘অনুশীলন তত্ত্ব’-এর আদর্শে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ বিরোধী দল। আজ আপনাদের জানাবো অনুশীলন সমিতি সম্পর্কিত বিশেষ কিছু তথ্য।
অনুশীলন সমিতির কিছু নেতাদের নাম এইখানে দেওয়া হলো।
কলিকাতা: প্রমথ মিত্র , যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ( নিরালম্ব স্বামী ), অরবিন্দ ঘােষ, বিপিনচন্দ্র পাল, সুবােধচন্দ্র মল্লিক, তারকনাথ দাস, যােগেন্দ্র বিদ্যাভূষণ, সতীশচন্দ্র বসু, সখারাম গণেশ দেউস্কর, বারীন্দ্রকুমার ঘােষ, ব্ৰহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ হালদার, ভূপতি মজুমদার, নরেন্দ্র ভট্টাচাৰ্য, হরিকুমার চক্রবর্তী, যাদুগােপাল মুখার্জি প্রমুখ।
ঢাকা: আনন্দচন্দ্র পাকড়াশী, ললিতমােহন রায়, পি. সি. সেন, পুলিন বিহারী দাস, ভূপেশচন্দ্র নাগ, উপেন্দ্রচন্দ্র নাগ, শ্ৰীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, মনােরঞ্জন ব্যানার্জী, ডাঃ মােহিনীমােহন দাস, বীরেন্দ্র মজুমদার, হরেন্দ্র চক্রবর্তী, আশুতােষ দাশগুপ্ত, নরেন্দ্রমােহন সেন, মাখনলাল সেন, প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী, বীরেন্দ্রচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মদনমােহন ভৌমিক, নলিনীকিশাের গুহ, অমৃতলাল হাজরা, শচীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,শান্তিপদ মুখার্জি, মতি সেন, জ্যোতির্ময় রায়, রাধিকাভূষণ রায়, রজনীকান্ত বসাক মােক্তার, কেদারেশ্বর সেনগুপ্ত, নলিনীকান্ত ঘােষ, তরণী সােম প্রমুখ।
ময়মনসিংহ: জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র মজুমদার,
রবীন্দ্রমােহন সেন, রমেশচন্দ্র আচার্য, ত্রৈলােক্যনাথ চক্রবর্তী, চন্দ্রকুমার ঘােষ, অমর ঘােষ মােক্তার, প্রিয়নাথ রায়, অমৃত সরকার, যােগেন্দ্র ভট্টাচার্য, পূর্ণ চক্রবর্তী, যােগেন্দ্র ভট্টাচার্য, রমেশচন্দ্র চৌধুরী, সতীশচন্দ্র রায় প্রমুখ।
বরিশাল: দেবেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, যতীন্দ্র রায় (ফেগু), গােপাল মুখার্জি, চণ্ডী বসু, কবিরাজ নরেন সেন, নিবারণ কর, প্রবােধ গুহঠাকুরতা, রােহিণী গুহ, সুশীল ঘােষ, রমণীমােহন দাস, চণ্ডী কর, প্রবােধ দাশগুপ্ত ( গৈলা) প্রমুখ।
ফরিদপুর: আশুতােষ কাহালী, যদুনাথ পাল, সতীশ দাসগুপ্ত (স্বামী সত্যানন্দ ), গিরীন্দ্র ভট্টাচাৰ্য, শিশিরকুমার গুহরায়, জীবন ঠাকুরতা প্রমুখ
নােয়াখালি: সারদাচরণ গুহ, খগেন্দ্র কাহালী, নলিনী মিত্র, অনুকুল চক্রবর্তী, দীনেশ চন্দ্র বিশ্বাস প্রমুখ।
কুমিল্লা: রমেশচন্দ্র ব্যানার্জি, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, পুলিন গুপ্ত, যােগেশচন্দ্র চ্যাটার্জি, ক্ষেত্ৰ সিং, অতীন্দ্রমােহন রায় প্রমুখ।
চট্টগ্রাম: চন্দ্রশেখর দে, চারুবিকাশ দত্ত, প্রতাপ রক্ষিত, গিরিজা চৌধুরী, মােহিনী ভট্টাচার্য প্রমুখ।
শ্রীহট্ট: নগেন্দ্র দত্ত ( গিরিজা)
রাজসাহী: –প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী, জিতেশচন্দ্র লাহিড়ী, হরেন্দ্র মৈত্র(কালী ), পাটুল হাপানিয়া, নরেন্দ্র ভট্টাচাৰ্য, নকুল, সরস্বতী, পুটিয়া ; শ্রীশচন্দ্র চক্রবর্তী ( উকিল, নাটোর), জ্ঞান সান্ন্যাল, প্রবােধ ভট্টাচাৰ্য প্রমুখ।
নালদহ: হংসগােপাল আগরওয়ালা,মহেন্দ্র দে, দক্ষিণা লাহিড়ী প্রমুখ।
দিনাজপুর-অশ্বিনী ভট্টাচাৰ্য, প্রফুল্ল বিশ্বাস, প্রবােধ বিশ্বাস প্রমুখ।
পাবনা—বঙ্কিমচন্দ্র রায় সুধীর মজুমদার (লাহিড়ী মােহনপুর ), অমূল্য লাহিড়ী, মণি লাহিড়ী (জলপেশ ) প্রমুখ।
কুড়িগ্রাম, রংপুর: খর্গ বর্মণ, সুশীল দেব, যতীন্দ্র দেব প্রমুখ।
অনুশীলন সমিতির প্রধান কেন্দ্রের অধীনে জিলা-সমিতি, মহকুমা সমিতি, পরগণা সমিতি ও গ্রাম্য সমিতি ছিল। প্রত্যেক সমিতির একজন সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদক থাকতো। স্থানীয় একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অধ্যক্ষ করা হতো। সমিতির সভ্যদের প্রতিদিন বিকেলের লাঠি খেলা, ছােরা খেলা ও ড্রিল শিক্ষা করতে হত। খেলার মাঠে নামডাকা হতো এবং অনুপস্থিত সভ্যদিগকে কারণ দেখাতে হতো। যে সকল সভ্য বহুদিন অনুপস্থিত থাকতো এবং সমিতির কাজে যাদের কোনো নিষ্ঠা থাকতো না, তাদের নাম কেটে দেওয়া হতো, সমিতির সাধারণ সভ্যদের মধ্যে যাদের কর্মঠ, চরিত্রবান, সাহসী ও দেশপ্রেমিক বলে মনে করা হতো তাদের ‘আদ্য প্রতিজ্ঞা’ করানো হতো।
আদ্য প্রতিজ্ঞা: “আমি এই সমিতি হইতে কখনও বিচ্ছিন্ন হইব না, আমি আমার চরিত্র সর্বদা নির্ম্মল ও পবিত্র রাখিব। আমি সকল সময়ই সমিতির বিধি-নিষেধ মানিয়া চলিব। আমি সমিতির কর্তৃপক্ষের আদেশ বিনা বাক্যব্যয়ে প্রতিপালন করিব। আমি আমার নেতার নিকট কোন বিষয় গােপন করিব না এবং মিথ্যা বলিব না।”
এই সব সভ্যদের থেকে আবার বাছাই করে যাদের বিপ্লবী দলের উপযুক্ত বলে মনে হতো, তাদের ‘মধ্য প্রতিজ্ঞা’ করানো হতো।
মধ্য প্রতিজ্ঞা:- “আমি সমিতির আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে অযথা আলােচনা বা কাহারও নিকট প্রকাশ করিব না। আমি পরিচালকের নির্দেশ ব্যতীত একস্থান হইতে অন্য স্থানে যাইব না। যদি কোন সময় সমিতির বিরুদ্ধে কোন প্রকার ষড়যন্ত্রের বিষয় জ্ঞাত হই, তাহা হইলে অবিলম্বে পরিচালককে জানাইব এবং তাহার প্রতিকারের চেষ্টা করিব। আমি যে কোন অবস্থায়, যে কোন সময়ে পরিচালকের নির্দেশ পালন করিব।”
আবার এঁদের মধ্যে থেকে বাছাই করে ‘অন্ত্য প্রতিজ্ঞা’ করানো হতো।
অন্ত্য প্রতিজ্ঞা:- “আমি সমিতির উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত ইহার বেষ্টনী পরিত্যাগ করিয়া যাইব না। আমি পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগিনীর স্নেহ, গৃহের মােহ সমস্ত ত্যাগ করিব।”
প্রতিজ্ঞা করণের সময় সাধারণত কোনো দেবী মন্দিরে গিয়ে দেবীর সম্মুখে দীক্ষা দেওয়া হতো।
দীক্ষাগ্রহণ-প্রণালী: আগের দিন একবেলা হবিষ্যান্ন ভোজন করে, সংযমী হয়ে, পরদিন ভোরে স্নান করে দীক্ষা গ্রহণ করতে হতো।
দেবীর সম্মুখে ধূপ-দীপ, নৈবেদ্য সাজিয়ে, বৈদিকমন্ত্র পাঠ করে যজ্ঞ করতে হতো। পরে প্রত্যালীঢ় আসনে ( বাম হাঁটু গেড়ে শিকারােদ্যত সিংহের প্রতীকে) বসে মাথায় গীতা স্থাপন করা হতো। গুরু শিষ্যের মাথায় তলোয়ার রেখে ডান দিকে দাঁড়াতেন। শিষ্য যজ্ঞাগ্নির সামনে দুই হাতে প্রতিজ্ঞা-পত্র ধরে প্রতিজ্ঞা পাঠ করতেন।
দীক্ষা গ্রহণের পর প্রত্যেক সভ্যকে দুধ, ঘি, চিনি মিশ্রিত এক গ্লাস সরবৎ দেওয়া হতো। আদ্য প্রতিজ্ঞার সভ্যগণ প্রাথমিক সভ্য এবং বিশেষ প্রতিজ্ঞার সভ্যগণ পূর্ণ সভ্য (full-fledged member ) হিসেবে গণ্য হতেন।
কেউ ইচ্ছা করলেই যখন খুশী অনুশীলন সমিতির সভ্য হতে পারতেন না । আবার যখন ইচ্ছা দল ছেড়ে যেতে পারতেন না। অনুশীলন সমিতির নিয়মাবলীতে ছিল, কেউ দলত্যাগ করলে সমিতির সম্পর্কে তার জ্ঞান নষ্ট করতে হবে, অর্থাৎ দলত্যাগ করে পাছে সে দলের অনিষ্ট করে বা গুপ্ত খবর প্রকাশ করে এজন্য তাকে একেবারে সরিয়ে দিতে হবে। অবশ্যই অনুমতি নিয়ে গৃহী সভ্য হিসেবে থাকতে পারা যেতো।
অনুশীলন সমিতির সদস্যরা বর্বর আরব আক্রমণের হাত থেকে হিন্দুদের রক্ষা করায় এক মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। এইরকম একটি ঘটনার কথা জেনে নেওয়া যাক অনুশীলন সমিতির এককালীন সভ্য শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজের জবানীতেই।
“সাটিরপাড়ার নিকট চিনিশপুর কালীবাড়ী অবস্থিত। ইহা প্রসিদ্ধ পীঠস্থান। সম্ভবতঃ বৈশাখ মাসে, কোন এক তিথিতে ( অমাবস্যা ), সেখানে হাজার হাজার লােক পূজা দিতে আসে। এই পূজায় চার-পাঁচশ পাঠা এবং পাঁচ-সাতটা মহিষ বলি পড়ে। একবার গুজব রটিল যে, এই পূজার দিন মুসলম।নেরা কালীবাড়ীটি আক্রমন করিবে। আমি মফঃস্বল সমিতির সম্পাদকগণকে সংবাদ দিলাম, সেইদিন প্রাতে লাঠিসহ সকলকে উপস্থিত থাকিতে হইবে ।
প্রায় পাঁচশত স্বেচ্ছাসেবক ঐ দিন উপস্থিত হইল। প্রথমে তাহাদিগকে ‘কুচকাওয়াজ’ করাইলাম, পরে যাত্রীদের সুবিধার জন্য তাহাদের নানা কাজে বিভক্ত করিয়া দিলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম, কোন দুর্ঘটনা ঘটে নাই এবং যাত্রীরা সকলে বিদায় হইলে আমরাও প্রত্যাবর্তন করিলাম।”
ঢাকা অনুশীলন সমিতির সভ্যদের রমনা কালী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির এবং বুড়াশিবের মন্দিরে দীক্ষা দেওয়া হতো।
১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ রমনা কালীমন্দিরের পবিত্র ভূমি প।কিস্ত।নি সেনারা বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরি সহ সেখানে উপস্থিত প্রায় ১০০ জন নারী ও পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাক সেনারা। শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম দাউ দাউ করে জ্বলেছিল। রমনা কালীমন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট, যা বহুদূর থেকে দেখা যেত। সেটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় ওই বর্বর সেনারা।
পরে মুজিবুর রহম।নও এই রমনা কালীমন্দিরের ২৬ কাঠা জমি জবরদখল করেন।
তথ্যসূত্র:
১) ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’- শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ)
২) ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’- ডাঃ কালিদাস বৈদ্য
৩) ‘States, parties, and social movements’- Jack A. Goldstone
Forwarded