২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বড়ো যে ইস্যুটি হতে চলেছে তা অবশ্যই দেশপ্রেম। বলা বাহুল্য, বিগত পাঁচ বছর ধরেই এই ইস্যু আস্তে আস্তে তৈরি হয়েছে। এই শতাব্দীর বুকে দাঁড়িয়ে ভাত জোটানোই যেখানে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ, সেখানে দেশপ্রেমের কূট তর্ক তুলে লাভ কী— এমন প্রশ্ন আকছার শুনতে হয়। দেশপ্রেমের সংজ্ঞা নির্ধারণেও নানান ধোঁয়াশা, অনেক ধরনের প্রশ্ন ওঠে— দেশ বলতে ভৌগোলিক সীমানাই কেবল বোঝায় কিনা, দেশপ্রেম মানে সীমান্ত প্রেম কিনা ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে মারাত্মক প্রশ্নটি হলো—বিজেপিই দেশেপ্রেমের একমাত্র হকদার কিনা, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা করলেই তাকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া যায় কিনা— এহেন বিভিন্ন প্রশ্ন বিগত কয়েকবছরে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু যাঁরা এই প্রশ্নগুলি তোলেন, মুখোশের আড়ালে তাদের প্রকৃত মুখমণ্ডলের ছবি দেশবাসী এতদিনে নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছেন। একথা স্বীকার করে নিতে কোনও দ্বিধা নেই যে, কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির চরম বিরোধী হলেই কেউ দেশদ্রোহী হয়ে যায় না। কিন্তু মোদী বিরোধিতার রাজনৈতিক স্বার্থ ও তাগিদ যখন তীব্রতর হয়ে ওঠে তখন বিরোধীরা খেয়ালও করে দেখেন না, সেটা কখন যেন দেশ বিরোধিতায় রপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। বালাকোটে সেনা অভিযানের সাফল্য অবশ্যই বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের নয়, সমগ্র দেশবাসীরই তাতে গর্ব হওয়া উচিত। কিন্তু বিরোধীরা প্রশ্ন তুললেন ‘মানুষ’ (‘জঙ্গি’ নয়) মরেছে, নাকি খালি গাছপালাই ধ্বংস হয়েছে।
রয়টার্সের একটা রিপোর্টকে তারা হাতিয়ার করলেন, যেখানে বলা হয়েছে, বালাকোটে কেউ নিহত হয়নি। একজন সামান্য আহত। প্রশ্ন হলো, রয়টার্সের প্রতিনিধি জানলেন কী করে। তাদের প্রতিনিধির সরেজমিন অনুসন্ধান যে আদতে ভাঁওতাবাজি তা বোঝা যায় যখন দেখি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কোনো প্রতিনিধিকেই বালাকোটে ঢুকতে দিচ্ছে না পাকিস্তান, জঙ্গি-মৃতদেহগুলি পাছে তারা দেখতে পান। এদেশের বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা এসব জানেন না তা নয়, তবু বালাকোট তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। তারা বরং প্রশ্ন তোলেন পুলওয়ামার ঘটনা জেনেশুনে বিজেপি সরকার ঘটায়নি তো, উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলতে!
সোশ্যাল মিডিয়ায় এর চমৎকার জবাব পাওয়া গিয়েছে— ১৯৮৪ সালে রাজীব কি ইচ্ছাকৃতভাবে মা ইন্দিরাকে হত্যা করেছিলেন ভোটে ফয়দা তুলতে, নাকি ১৯৯১ সালে কংগ্রেস চক্রান্ত করে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করে ভোটে ফয়দা তুলেছিল? আসলে গত পাঁচ বছরে বিরোধীদের কার্যকলাপ মোটামুটিভাবে জে এন ইউতে আফজল গুরুর জন্মদিন পালন দিয়ে শুরু, মাঝে উরি ঘুরে সাম্প্রতিকতম পুলওয়ামা, বালাকোট বিরোধীদের চেহারা সর্বসমক্ষে উন্মোচন করে দিয়েছে। সেনাকর্তারা বলে দিচ্ছেন মনমোহন সরকার বায়ুসেনাকে নিয়ন্ত্রণরেখা টপকানোর অবাধ হস্ত দেননি, মোদী দিয়েছেন, তাই এই সাফল্য।
বিরোধীদের মেন্টরদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। ইন্টেলেকচুয়াল শক্তি জোগান ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার, শঙ্খ ঘোষ, অমর্ত্য সেন, রজতকান্ত রায়ের মতো লোকেরা, তারা কোন মতাদর্শের তা জানতে কারো বাকি নেই। আর রাজনৈতিক আইনি শক্তি জোগাচ্ছেন কপিল সিবাল, সলমন খুরশিদ, দ্বিগ্বিজয় সিংহের মতো আদ্যন্ত দেশবিরোধীরা যাদের দেশদ্রোহিতার অনন্য সব নজির রয়েছে। বিরোধীদের মোদী বিরোধিতায় তাই দেশ-বিরোধী চিৎকার থাকবেই। মুসলমানদের সন্তুষ্টি বিধানে এঁদের অকৃত্রিম প্রয়াস যেমন মুসলমান তোষণ ও হিন্দু বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল, গত পাঁচ বছরে এই বিষয়গুলিই আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে ভারত-বিরোধিতা, পাকিস্তান-প্রেম, সর্বোপরি আর এস এস বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে। এই রাজনৈতিক বাস্তবতাই আজ সন্ত্রাসবাদ পরিপোষণেও এদের উৎসাহিত করেছে। দেশপ্রেমের নিন্দায় এঁরা কেবল নিজেদের ‘দ্বেষপ্রেমী’ই করে তোলেননি, দেশদ্রোহীতেও পরিণত হয়েছেন।
বিশ্বামিত্র