কয়েক বছর আগের কথা।ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখছিলাম।খাতা দেখা প্রায় শেষ হয়েই গেছে।আর কয়েকটি খাতা দেখলেই খাতা দেখা শেষ হয়ে যাবে।হঠাৎ একটি খাতা দেখতে গিয়ে আমার চোখটা আটকে যায়।প্রথম পাতায় এসে নামটা আরো একবার দেখলাম।ছেলেটির নাম উত্তম।
উত্তমের খাতাটা দেখতে গিয়ে আমাকে বেশ ভাবিয়ে ছিল।পরীক্ষায় লিখতে দেওয়া হয়েছিল “তোমার জীবনের লক্ষ্য।” খাতা দেখতে গিয়ে দেখেছিলাম অনেক ছেলেই তাদের জীবনের লক্ষ্যের কথা লিখেছিল।প্রথম সারির ছেলেরা কেউ লিখেছে ডাক্তার,কেউ ইঞ্জিনিয়ার,কেউ শিক্ষক,কেউ বা ক্রিকেট খেলোয়াড়ও হতে চেয়েছে।বেশ পরিচ্ছন্ন কয়েকটি লেখাও পেয়েছিলাম। তাদের কোথাও বানান ভুল নেই।কোনো অসঙ্গতি নেই।বইতে যেমন লেখা থাকে তেমনি হুবহু তুলে দিয়েছিল।ভালো লেখার জন্য সব সময়েই ভালো নাম্বার বরাদ্দ থাকেই।সেদিক থেকে তারা ভালো নাম্বার পাবে এটাই স্বাভাবিক।
উত্তমও লিখেছিল তার জীবনের লক্ষ্যের কথা।হবহু মনে থাকলেও উত্তম যেটা লিখেছিল সেটা ছিল এরকম,
আমি বড়ো হয়ে অরূপ স্যার হতে চাই।আমিও অরূপ স্যারের মতো একটা গাড়ি কিনে সেই গাড়ি করে আমার মা’কে নিয়েও হরিদ্বার যেতে চাই।
খাতাটা দেখতে গিয়ে বার বার পড়ছিলাম লেখাটা।এ লেখা কোনো বই থেকে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় হুবহু তুলে দেওয়া কোনো লেখা নয়।এ লেখাটা তার একদম নিজের লেখা।এ তার সম্পূর্ণ মনের কথা। লেখার মধ্যে অনেক বানান ভুল ছিল ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে ছিল জীবনের সত্য।
সেদিন খাতা দেখতে বসে আর কোনো খাতা দেখিনি।উত্তমের খাতাটাই ভালো করে দেখছিলাম। উত্তম পড়াশোনায় ভালো নয়।সেভাবে কিছুই হয়তো লিখতে পারে নি। কিন্তু যা লিখেছে সেটা আমার শিক্ষকতার জীবনে অনেক বড়ো প্রাপ্তি।
উত্তমের খাতাটা দেখতে গিয়ে যখন দেখলাম উত্তম অরূপ স্যার হতে চেয়েছে তখন গর্বে বুকটা ভরে উঠছিল।খাতাটা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম শিক্ষকতার জীবনে একজন ছাত্রের মনেও আমি যে দাগ কাটতে পেরেছি, এর থেকে বড়ো পাওয়া আর কি হতে পারে!
আমি ওদের ক্লাসে বাংলা পড়াতাম।মাঝে মধ্যে ছাত্ররা আবদার করে বলে, স্যার একটা গল্প বলুন।তা আমি মাঝে মধ্যেই ছাত্রদের গল্প শোনাই।সেবারে পুজোর ছুটিতে মাকে নিয়ে হরিদ্বার গিয়েছিলাম।সেই গল্পই ওদের কাছে করেছিলাম। বলেছিলাম,তোরাও ভালো করে পড়াশোনা করলে বড়ো হয়ে কত জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারবি।এখন যেমন বাবা মা তোদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়,বড়ো হয়ে তোরাও বাবা মাকে সঙ্গে করে নিয়ে ঘুরিস।নিজের গাড়ি থাকলে যেখানে মন চাইবে সেখানেই যেতে পারবি।উত্তম সেই কথাগুলো মাথায় রেখেই পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়েছিল।মূল্যায়ন করতে গিয়ে উত্তমকে হয়তো খুব একটা বেশি নম্বর দিতে পারিনি সেদিন।মনে মনে ওকে দশে দশ দিয়েছিলাম।তারপর থেকে উত্তম আমার কাছে আরো প্রিয় হয়ে গেল।পরে উত্তমকে বলেছিলাম,
–পরীক্ষার খাতায় কী লিখেছিলি যেন?অরূপ স্যার হতে চাস তাই না?
ও বলেছিল,
–স্যার আপনার মতো হতে চাই।
তারপর থেকে কয়েক বছর কেটে গেছে।উত্তম স্কুল ছেড়ে চলে গেছে।ক্লাস টেনে উঠে কয়েকদিন অবশ্য স্কুলে এসেছিল।তারপর আর স্কুলে আসেনি।মাধ্যমিক পরীক্ষাটা না দিয়েই পড়া ছেড়ে দিয়েছিল।আমি অন্য ছাত্রদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছিলাম উত্তম কেন আর স্কুলে আসছে না।শুনে ছিলাম, উত্তম পড়া ছেড়ে দিয়েছে।ও আর পড়বে না।আমি ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।ও আসেনি আর।তারপর থেকে উত্তম মনের মধ্যেই রয়ে গেল আমার।
কিছুদিন আগে কলকাতা গিয়েছিলাম একটা দরকারে।সকালে ট্রেন ধরার জন্য আমার ছেলে বাইকে চাপিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল।বিকেলে যখন ফিরলাম তখন প্রায় সাড়ে চারটে হবে।ছেলেকে বাইক নিয়ে আসতে বলার দরকার নেই বলেই মনে করলাম।ভাবলাম টোটো করেই চলে যাই।স্টেশন চত্বর থেকেই বেরিয়ে এসে টোটোতে উঠতে যাব দেখি আমার ছাত্র উত্তম।উত্তম আমাকে দেখেই,
–স্যার ভালো আছেন?
–আরে তুই।
–হ্যাঁ স্যার।দুবছর হয়ে গেল টোটো চালাচ্ছি।
–আগে দেখিনি তো কখনো?
–আপনি হয়তো খেয়াল করেন নি।আমি আপনাকে প্রায় দেখি।
কথা গুলো বলতে বলতে আরো তিনজন প্যাসেঞ্জার চলে এলো।উত্তম বললো,
–স্যার আপনি সামনে চলে আসুন।
আমি সামনে গিয়ে উত্তমের পাশেই বসলাম।পিছনে চারজন প্যাসেঞ্জার হয়ে যেতেই ও টোটো চালাতে শুরু করলো।তারপর নানান কথা।বিভিন্ন স্যারদের কথা জানতে চাইলো।নিজে থেকেই বললো,
–স্যার স্কুল ছেড়েছি এগারো বারো বছর হয়ে গেল।আপনি স্যার আগের মতোই রয়ে গেছেন।
আমি বললাম,
–আমার কথা ছাড়।তোর আর খবর বল।অনেক দিন পর তোকে দেখছি।
–আমার তো আলাদা কোনো খবর নেই।এই তো টোটো চালাই।এতেই যা হয় আপনাদের আশীর্বাদে চলে যায়।এক বছর হলো বিয়ে করেছি।বাবা তো ছোটো বেলাতেই মারা গিয়েছিল।আর মাও চলে গেল বছর তিনেক আগেই।
উত্তম কথাগুলো আমাকে বলছে পিছন থেকে একজন বলে উঠলো, এই টোটো থামো।দেখলাম টোটো থেকে নেমে দুজন ভাড়া দিল আর একজন ভাড়া না দিয়েই চলে গেল।উত্তমকে জিজ্ঞেস করলাম,
–কী ব্যাপার উনি ভাড়া দিলেন না?
–স্যার আমি বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকে ভাড়া নিই না।সেটা উনি জানেন।জানেন স্যার,খুব ইচ্ছে ছিল মাকে নিয়ে হরিদ্বার যাব।সে সুযোগ আমাকে ভগবান দেয় নি।কিন্তু এই বয়স্ক মানুষজনদের দেখলে আমার বাবা মা’র কথা মনে পড়ে।তাই এদের দিয়েই কিছুটা পূরণ করি।এই টোটোটাই হচ্ছে আমার গরীব রথ।দেখবেন আমার টোটোর সামনে লেখা আছে।
কিছু ক্ষণের জন্য আমাকে থামিয়ে দিয়ে ছিল উত্তম।সেদিন জীবনের লক্ষ্য শুধু পরীক্ষার খাতায় লেখেনি জীবনের খাতাতেও লিখে ফেলেছিল।লিখেছিল এক নির্ভেজাল সত্যি।টোটো থেকে নামি।আমি ভাড়াটা বের করার আগেই আমাকে বলে দিল,
–আপনার থেকে ভাড়া নেব না স্যার।এই গরীবের রথে আপনাকে যে বসাতে পেরেছি এর থেকে বড়ো কিছু পাওয়া আমার নেই।আপনারা শিক্ষক।যতটুকু আপনাদের থেকে শিখেছি তার ঋণ কি কোনো ভাবেই পরিমাপ করা যায়?ভালো থাকবেন স্যার।
-:সমাপ্ত:-
সরজিৎ ঘোষ