আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে
সুয্যি ডুবে গেছে মাঠের শেষে,
বাগ্দি-বুড়ি চুবড়ি ভরে নিয়ে
শাক তুলেছে পুকুর-ধারে এসে

বঙ্গ সমাজে ‘শাক’ বস্তুটি বরাবরই আদর ও গুরুত্ব পেয়ে এসেছে, যার অন্যতম নমুনা রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’ কবিতার এই পংক্তি। সাহিত্যে ধরা পড়ে সময়, সমাজ, মনন। বাংলা, বিশেষত গ্রামবাংলার সঙ্গে শাকের সম্বন্ধ অনেক গভীরে। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, অনাহারে এই শাকেই পরিত্রাণ খুঁজে পেয়েছে সর্বহারা, নিম্নবিত্ত মানুষ। খেয়ে এবং বেচে। তখনও বাগদি-বুড়িরা গ্রাম থেকে শহরে আসত রকমারি শাকের পসরা নিয়ে, এখনও আসে। শহরের বড়ো-ছোটো বাজারে, রেল স্টেশনে, রাস্তার ধারে এখনও শাক বেচতে দেখা যায় তাঁদের। শহরবাসীর জন্য তাঁরা প্রত্যেকেই যেন এক টুকরো শস্য-শ্যামলা পল্লি বাংলা – যোগাযোগের সেতু। পাতে শাক খাওয়া, বাঙালির এই চিরাচরিত অভ্যাসকে সযত্নে লালন করছেন তাঁরা। আজও বাঙালিকে তাঁরা জোগান দিয়ে যাচ্ছেন বেতো, কলমী, হিঞ্চে, নটে, পুঁই, পাট, সরষে, মুলো, গিমে, সজনে, থানকুনি, ব্রাক্ষ্মী, কচুলতি, ঢেঁকি, তেলাকুচা, কুমড়ো, লাউ, পালং, টক পালং, মেথি, পুদিনা, পলতা, কুলেখড়া, পিড়িং, আমরুলী, পুনর্ণবা, আপাং, লুনে, খেসারি, ইন্দ্রমারিস, আতাড়ি-পাতাড়ি, দুলপী, শুষনি শাক।

আমাদের পূর্বপুরুষরা তো বহু ধরনের শাক খেতেন, বেশিরভাগের নামই আমরা জানি না। মা-ঠাকুমারা শাক দিয়ে নানারকম রান্না আবিষ্কার করেছিলেন। বাটে-মাঠে-ঘাটে এইসব শাক পাওয়া যেত। গরিব মানুষ পেট ভরানোর খাদ্য হিসেবে শুধু নয়, তার শরীরের অত্যাবশ্যক পুষ্টির জোগানও আসত এইসব শাক থেকে। নানা ওষুধগুণে ভরা এইসব শাক, ওষুধ হিসেবেও ব্যবহারের ফলে ডাক্তার-বদ্যির কাছে খুব প্রয়োজন না হলে ছুটতে হত না। পরিবেশ দূষণ ও বাজারি অর্থনীতির চাপে কী খাব-কী খাব না, কী চাষ করবো-না করবো তা নির্ধারণ করছে বাজার। ফলে ফসল বৈচিত্র কমছে। কমছে শাক বৈচিত্র, শাক খাওয়ার অভ্যাস। যারা মাঠঘাট থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের শাক নিয়মিত খেতেন, দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে এসব শাক যে আদৌ খাওয়া যায়, সেই কথাটাই তাঁরা ভুলতে বসেছেন। ফলে অপুষ্টি বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রামের মহিলা ও শিশুরা এই অবস্থার শিকার হচ্ছে সব থেকে বেশি।

এই প্রসঙ্গে কতকগুলি জরুরি বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন। বেশির ভাগ শাক চাষ করা খুবই সহজ। বহু শাক আছে যেগুলো বছরের একটা বিশেষ সময়ে বিশেষ পরিবেশে নিজে থেকেই জন্মায়। এই মুহূর্তে আমরা খাদ্যের পরিমাণ এবং পুষ্টির মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছি, অথচ পুকুর পাড়ে, পতিত জমিতে, আলের ধারে অবহেলায় জন্মানো এই শাকগুলি কিন্তু এই উভয় চাহিদাই মেটাতে পারে। এই বিষয়ে শুধু চাই আমাদের চেতনা। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় যেসব শাক বাঁচতে পারছে না, তাদের জন্মানোর উপযুক্ত পরিবেশ রক্ষা করার দায়িত্ব আমার-আপনার সকলের।

ভুললে চলবে না বিভিন্ন শাকের স্বাদ আলাদা, রান্নার পদ্ধতিও আলাদা। কিন্তু শাক খাবার অভ্যাসকে যদি ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে শুধু শাক লাগিয়ে বা যত্ন করে কোনও লাভ হবে না। শাক খাওয়ার এলাকাগত অভ্যাসও আলাদা। অনেক সময়ই রান্না করতে গিয়ে আমরা শাকটির উপকারিতা হারিয়ে ফেলি।

স্থায়ী কৃষির সার্বিক সম্প্রসারণের কাজে শাকসবজির বৈচিত্র আবার, ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কিছু কিছু সম্পদ প্রায় নিঃশেষিত হওয়ার আগেই এই পুনরুদ্ধারের কাজটি শুরু করা প্রয়োজন। এই কাজ ব্যাপক ভাবে শুরু করার আগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এইসব সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তাও প্রাসঙ্গিক। যে কাজটি করে চলেছে ডিআরসিএসসি (DRCSC – Development Research Communication and Services Centre)। ১৯৮২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের নানা জায়গায় উন্নয়নমূলক কাজ করে চলেছে এই সংগঠন। তাঁদের লক্ষ্য, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-ভূমিহীন কৃষকের খাদ্য ও কাজের জোগান সুনশ্চিত করা। যে লক্ষ্যের পথ হবে সামাজিক ন্যায়-নির্ভর, সহভাগী, পরিবেশ-বান্ধব ও অর্থনৈতিক ভাবে উপযুক্ত। ডিআরসিএসসি-এর প্রকাশনা বিভাগও আছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যৎসামান্য মূল্যের বেশ কিছু চটি বই এখান থেকে প্রকাশ হয়েছে। ‘বাংলার শাক – খাদ্য ও ওষুধ হিসেবে শাকের ব্যবহার’ বইটি সেগুলিরই একটি। বইটির জন্য উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মালদা ইত্যাদি জেলা থেকে তাঁরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। বই থেকে জানা যাবে, বাংলায় উপলব্ধ যাবতীয় শাকের নাম, সেগুলোর বিজ্ঞানসম্মত নাম, কোন কোন অঞ্চলে পাওয়া যায়, শাক চাষের ক্ষেত্রে, রান্না ও খাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে, ব্যবহারিক গুণ অনুযায়ী ঔষধি শাকের তালিকা। আর একটা কথা ভুললে চলবে না বিভিন্ন শাকের স্বাদ আলাদা, রান্নার পদ্ধতিও আলাদা। কিন্তু শাক খাবার অভ্যাসকে যদি ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে শুধু শাক লাগিয়ে বা যত্ন করে কোনও লাভ হবে না। শাক খাওয়ার এলাকাগত অভ্যাসও আলাদা। অনেক সময়ই রান্না করতে গিয়ে আমরা শাকটির উপকারিতা হারিয়ে ফেলি। আবার, কখনও বা নিজেদের একঘেয়ে রান্নার জন্য শাকগুলি মুখরোচক করতে গিয়ে এর আসল উপকারিতাই নষ্ট হয়ে যায়। এসব কথা মাথায় রেখে শাক খাওয়ার খুব সহজ কিছু নিয়মকানুন বা পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ডিআরসিএসসি-র বইটিতে। যেমন-

বাজার থেকে শাক কিনে এনে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। একটু নুন জলেও ধোয়া যেতে পারে।

শাক পরিষ্কার করে ধোয়ার পর তবেই কাটা উচিত। 

ছাঁকনিতে বা কাপড়ে বেঁধে ৫০-৬০ ডিগ্রি সে. ফুটন্ত জলে ৩ থেকে ৪ বার চুবিয়ে নিলে শাকে থাকা জীবানু নষ্ট হয়, শাকটি সহজপাচ্য হয় এবং শাকের ভিতরের ভিটামিন, খনিজ ইত্যাদির গুণগুলি বজায় থাকে। ভাপিয়ে নিলেও চলে।

খুব বেশি তেলে ভেজে খেলে শাকের অনেক গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের শাক খাওয়া দরকার। দু-তিনটে শাক একসঙ্গে মিশিয়েও খাওয়া যায়।

 ডিআরসিএসসি সম্পাদকমণ্ডলীর কথায়, “আমরা অনেকেই এসব শাকের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার জানি না। সেগুলিকে আবার সামনে আনার চেষ্টাও এই সংকলনটির একটি প্রধান উদ্দেশ্য। এই কাজে কবিরাজ প্রয়াত শম্ভুনাথ দে মহাশয় আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন। এই সংকলনটির দ্বিতীয় পর্বে তিনি কিছু শাকের ওষুধ হিসেবে উপকারিতার কথা বলেছেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে তিনি সংকলনটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। এর জন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।”

নানা ধরনের শাক খাওয়া এবং বাড়িতে শাক চাষের অভ্যাসটি যতটা সম্ভব টিকিয়ে রাখতে হবে গ্রামের সঙ্গে সঙ্গে শহরবাসীদেরও। বাজার থেকে শাক তো কিনবেনই এ ছাড়া, বাড়ির উঠোনে বা ছাদেও অনায়াসে করা যায়, শাকের চাষ। কিছু কিছু শাক আজ বিরল হয়ে গেছে। গ্রামেগঞ্জে যদিও বা চোখে পড়ে, শহরের মানুষ সেসব চেনে না বললেই চলে। যেমন- দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ডায়মন্ডহারবার, পূর্ব মেদিনীপুর, কাঁথি, নলতলার দিকে পিড়িং শাক জন্মায়। কিন্তু, এখন আর সেভাবে পাওয়া যায় না। শাকটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। মেহ রোগ, বেশি ঘাম হলে কাজে দেয়।

 পিড়িং শাক

আর একটি শাকের নাম আমরুলী। এই শাকটি গ্রাম-মফস্সলের মাঠে-ঘাটে এমনকী শহরের আনাচে-কানাচেও দেখা যায়। কিন্তু, অনেকেই জানেন না এটি শাক হিসেবে দিব্যি খাওয়া যায় এবং ঔষধি গুণও আছে। বুকে কফ বসে গেলে, সর্দিতে, হজমের জন্য, খিদে বাড়াতে, অম্বলের সমস্যা দূর করতে এই শাক খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকরা। স্বাদে টক। চাটনি হিসেবে বেটে খাওয়া যায়, রান্নাও করা যায়। সেদ্ধ করে ভাতে মেখে খেলে খিদে বাড়ায়। হজম করায়।

আমরুলী শাক

এ ছাড়া, বাজারে যেসব শাকগুলি সহজলভ্য যেমন, পাংক, মুলো, কলমী, নটে, পুঁই প্রত্যেকটিই খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ। তবে, কোন রোগে কোন শাক কাজে দেবে, সে ব্যাপারে একটু পড়াশোনা বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। আজকাল লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেও আজ অসুখ সারানো যায় না। এর জন্যে দায়ী বোধহয় আমাদের জীবনযাপন। খাঁটি ও ভেজালের পার্থক্য অনুধাবন না করতে পারার অসাড়তা আমাদের পেয়ে বসেছে। অথচ, মনে রাখা দরকার বনেবাদাড়ে জন্মায় বলে শাকপাতা মোটেই অবহেলার বস্তু নয়, সঠিক পদ্ধতিতে খেলে এটিই হয়ে উঠতে পারে সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি। নিমিত্ত মাত্র খরচে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.