তিনি বাংলার ‘আয়রন ম্যান’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এই জাতীয় বিশেষণ হয়তো নতুন কিছু নয় বর্তমান প্রজন্মের কাছে। কিন্তু ‘আইরন ম্যান’ হয়ে ওঠার লড়াইটা খুব সহজ ছিল না। বিশেষত সেই যুগের বাংলায়। নীলমণি দাশ, (Nilmani Das) যিনি অধিক পরিচিত আইরন ম্যান বা লৌহ মানুষ হিসাবে। কিন্তু তাঁর আরও একটি পরিচয় হল তিনি ‘মাতৃজাতির শরীরচর্চা’ (মেয়েদের জন্য শারীরিক প্রশিক্ষণ) শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যা পৌঁছে গিয়েছিল তৎকালীন মেয়েদের ঘরে ঘরে। যদিও এই লেখা তিনি লিখছেন অনেক পরে। আসলে গল্প শুরুরও একটা গল্প থাকে।
ছোটো থেকেই ছিল ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। প্রায় একশো বছর আগের কথা। বাগমারির (Bagmari) কাছে একটা মাঠ ছিল, যেখানে নিয়মিত ফুটবল (Football) খেলা হত৷ সবাই বলত মল্লিক লজের মাঠ। একদিন দুই দলে ফুটবল খেলা হচ্ছে। একদলে আছেন ক্যাপ্টেন নিলু৷ অন্যদলের খেলোয়াড়দের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু। নিলুদের দল বেশি মার খায়। সবাই পালিয়ে গেলে মাঠে একা পড়ে যায় নিলু। প্রাণের ভয়ে নিলু চিৎকার করতে থাকে। মাঠের পাশেই ছিল কুস্তি শেখার আখড়া। একদিন এক কুস্তিগির নিলুর চিৎকার শুনে ছুটে এলেন। অপর পক্ষের দলকে বেশ উচিত শিক্ষা দিলেন। রোগা নিলুকে দেখে বললেন, “এই রোগা পটকা শরীর নিয়ে ফুটবল খেলতে এসেছ? আগে শরীর মজবুত করো। ব্যায়াম করে, কুস্তি করে শরীরটা তৈরি করো, তবে তো লড়তে পারবে। দুই খেলে দশ দেবে।” (বারিদবরণ ঘোষের একটি প্রবন্ধ থেকে প্রাপ্ত)।
কথাটা মনে লেগে যায় নিলু অর্থাৎ নীলমণি দাশের। ভর্তি হলেন সিমলা ব্যায়াম সমিতিতে। নীলমণির মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় শিক্ষক সুবল বিশ্বাস ছাত্রকে স্মরণ করে লিখেছিলেন, “১৯২৭ সালের শেষভাগে একটি ১৬-১৭ বৎসরের কালো রঙের সুশ্রী ও রোগা যুবক আমার নিকট আসিয়া প্রণাম করিয়া ব্যায়াম শিক্ষা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল।… নীলমণির নিয়মনিষ্ঠা ও আগ্রহ দেখিয়া তাহার উপর মনোযোগ দিই৷ নীলমণি আমার প্রিয় ছাত্র ও শেষ ছাত্র। ও একজন প্রথম সারির ব্যায়ামবিদ।”
সকাল এগারোটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত বঙ্গবাসীর ছাত্রদের ব্যায়াম শিক্ষা দিতেন। সন্ধেতে আবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে ব্যায়াম শিক্ষা দিতেন।
এমন ছাত্র পেয়ে যেকোনো শিক্ষকই গর্ব অনুভব করবেন বৈকি!
১৯৩৫ সালে বিপ্লবী পুলীনবিহারী দাসের আহ্বানে এক বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেহ সৌষ্ঠবের খেলা দেখানোর জন্য মালদায় (Malda) গেলেন নীলমণি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ। অনুষ্ঠান শুরু হয় পুলীনবিহারী দাসের পরিচালনায় লাঠি খেলার মধ্যে দিয়ে। এইসব খেলার মাঝে মাঝে নীলমণি দেহ সৌষ্ঠব প্রদর্শন, লোহা ব্যাঁকানো এইসব দুঃসাহসিক কসরত প্রদর্শন করেন। প্রদর্শনী সমাপ্ত হলে সভাপতি বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ নীলমণিকে ‘আয়রন ম্যান’ উপাধি দিতে চান। তার প্রস্তাবে উদ্যোক্তারা সম্মত হন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার সভাপতি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্মেলনের পক্ষ থেকে নীলমণিকে ‘আয়রন ম্যান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
নীলমণি দাশ তাঁর ছাত্রদের ট্রেনিং করাচ্ছেন
বঙ্গবাসী কলেজে মাসিক পঁয়তাল্লিশ টাকা বেতনে শরীর শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। সকাল এগারোটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত বঙ্গবাসীর ছাত্রদের ব্যায়াম শিক্ষা দিতেন। সন্ধেতে আবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে (Calcutta University Institute) ব্যায়াম শিক্ষা দিতেন। এছাড়াও বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজে পার্টটাইম ব্যায়াম শিক্ষকতাও করতেন।
এবার আসা যাক অন্য একটি গল্পে। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার জন্য নীলমণি দাশ লিখলেন একটি বিশেষ নিবন্ধ৷ যার মূল বিষয় ছিল মেয়েদের শরীরশিক্ষার অধিকার। যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা যেন লড়াই করতে পারে। ব্যায়াম ও কুস্তি যাতে মেয়েরাও শিখতে পারে, তার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি।
নিবন্ধটি প্রাথমিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশ শতকের প্রথম দশকে কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা সংস্কারক সোচ্চার হয়ে উঠছিলেন এই বলে যে, মহিলাদের জন্যেও শরীরশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এই প্রস্তাবনায় সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেছিলেন নীলমণি। মনে রাখতে হবে নীলমণি দাশের বয়স তখন মাত্র ২৩। আমাদের সময়ে নীলমণি বেঁচে থাকলে নিশ্চয় একজন সৎ নারীবাদী হিসাবে প্রশংসিত হতেন। ২৩ বছর বয়সী সেই যুবক এমন ভাবনা কীভাবে ভেবেছিলেন তার সঠিক তথ্য নেই। তবে অনুমান করা যেতে পারে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবী চৌধুরানী’ পড়ে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। যে উপন্যাস হয়ে উঠেছিল নারী স্বাধীনতা এবং তাদের লড়াই করার মূল অস্ত্র। যে মহিলার শারীরিক প্রশিক্ষণের শিক্ষক ছিলেন একজন পুরুষ। নীলমণি নিশ্চয় গভীর সংযোগ উপলব্ধি করেছিলেন।
নিঃসন্দেহে নীলমণি দাশের মতো আধুনিক ব্যায়ামবিদ এ দেশে বিরল। অনেকসময় কোনো বিশেষণে ভূষিত করলেও, মানুষটার কাজ আমরা ভুলে যাই। কিন্তু নীলমণি দাশ কিংবা ভীম ভবানী, ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত, মনোহর আইচ-দের বাঙালি মনে রাখবে তাঁদের কাজে, অনুপ্রেরণায়, সর্বোপরি সততায়।
©বঙ্গদর্শন