সোমনাথ মন্দির । ভারতের গুজরাটের উপকূলে অবস্থিত প্রায় ২ হাজার বছরের প্রাচীন এই মন্দির ভূগোলবিদদের কাছে এক বিস্ময় কারণ উত্তর মেরু হতে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট কৌণিক সীমার সরলরেখায় পৃথিবীর একমাত্র স্থলভাগ এই মন্দিরটি, বাকী পুরোটাই জলভাগ !আর একের পর এক তুর্কী, আফগান, আরব, মুঘলদের ধ্বংসলীলার,ধর্মীয় হিংসার স্বীকার হয়েছে এই মন্দিরটি ।
তেরো শতকের আরব ভূগোলবিদ আসারু-ল-বিলাদের লেখা ওয়ান্ডারস অফ থিংস ক্রিয়েটেড, অ্যান্ড মার্ভেলস অফ থিংস এক্সিস্টিং বইতে তিনি সোমনাথ মন্দির ও এর ধ্বংসের বিবরণ দেন এভাবে-
“সোমনাথ: ভারতের বিখ্যাত শহর, সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত এবং সমুদ্রের তরঙ্গবিধৌত । এই স্থানের বিস্ময়কর স্থানগুলির মধ্যে একটি হল এক মন্দির যেখানে সোমনাথ নামে একটি বিগ্রহ রয়েছে । বিগ্রহটি মন্দিরের মাঝখানে নিচের কোনোরকম ঠেকনা ছাড়াই উপর থেকে ঝুলে রয়েছে । হিন্দুরা এটিকে খুব শ্রদ্ধা করে । বিগ্রহটিকে ওভাবে ঝুলতে দেখে মুসলমানই হোক, আর কাফেরই হোক, সবাই আশ্চর্য হয়ে যায় । চন্দ্রগ্রহণের দিন হিন্দুরা এই মন্দিরে তীর্থ করতে আসে । সেই সময় লক্ষ লক্ষ লোক এই মন্দিরে ভিড় জমান ।”
“সুলতান ইয়ামিনু-দ দৌলা মাহমুদ বিন সুবুক্তিগিন ভারতের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করলেন । তিনি ভেবেছিলেন সোমনাথ ধ্বংস করে দিলেই হিন্দুদের মুসলমান করা যাবে । তাই তিনি সোমনাথ ধ্বংস করার ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নবান হন । এর ফলে হাজার হাজার হিন্দুকে জোর করে মুসলমান করা হয় ।”
তিনি ৪১৬ হিজরির জিল্কাদা মাসের মাঝামাঝি সময় ( ১০২৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ) এসেছিলেন ।
“বিগ্রহের দিকে সুলতান আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলেন । তারপর লুটের মাল নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন । ধনসম্পদ তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল । সেখানে সোনা ও রুপো দিয়ে তৈরি অনেক মূর্তি ছিল । রত্নখচিত অনেক পাত্র ছিল । ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সেসব জিনিস সেই মন্দিরে পাঠিয়েছিলেন । মন্দির থেকে লুণ্ঠিত দ্রব্যের মোট অর্থমূল্য ছিল কুড়ি হাজার দিনারেরও বেশি ।”
প্রথমে মন্দিরটি ধ্বংস করেন আরবের শাসনকর্তা জুনায়েদ ৭২৪ সালে । আবার তৈরী করে হিন্দুরা ।
তারপর ১০২৪ সালে ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ চালান গজনীর সুলতান মাহমুদ !
এরপর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ১২৯৬ সালে । তার ধ্বংসলীলা নিয়ে হাসান নিজামির তাজ-উল-মাসির লিখেছেন,
“গুজরাটের রাজা করণ পরাজিত হন, তাঁর সেনাবাহিনী পলায়ন করে, “পঞ্চাশ হাজার কাফেরকে তরবারির আঘাতে নরকে নিক্ষেপ করা হয়” এবং “বিজয়ীদের হাতে আসে কুড়ি হাজারেরও বেশি ক্রীতদাস ও অগণিত গবাদি পশু ।”
এরপর ১৩৭৫ সালে মুজাফফর শাহ আবার ধ্বংস করেন এই মন্দিরটি । আবার নির্মাণ করে এটিকে হিন্দুরা ।
এরপর ১৪৫১ সালে গুজরাটের সুলতান মাহমুদ বেগদা আবার এটি ধ্বংস করে দেন ।
১৭০১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন । আওরঙ্গজেব সোমনাথ মন্দিরের জায়গায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন । এই মসজিদটি এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিল যে মন্দিরটির ভগ্নাংশের উপরেই মসজিদটি বানিয়ে দেয়া হয়েছিল এমন নগ্নভাবে যে হিন্দু শাস্ত্র-ভিত্তিক মোটিফগুলি বাইরে থেকেই দেখা যেত মসজিদের দেয়ালে । এতটাই নগ্ন ও নির্লজ্জ ছিল তাদের আক্রমণ ।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর সে বছরের ১২ই নভেম্বর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সোমনাথ মন্দির পুনঃ স্থাপনের নির্দেশ দেন । এ কাজে মহাত্মা গান্ধীও তাকে আশির্বাদ করেন । তবে তিনি পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রের অর্থে যেন মন্দির করা না হয় । যেখানে পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে নিয়েছিল ইসলামিক দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য, সেখানে ভারত নিজেদের পূর্বপুরুষদের বারবার ভেঙে দেয়া মন্দিরটিকে পুননির্মাণ করার জন্য জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে অস্বীকার করে ব্যক্তি অর্থায়নে এর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় ।
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে ধ্বংসাবশেষ সাফ করে ফেলা হয় । আওরঙ্গজেব কর্তৃক মন্দির ভেঙ্গে করা মসজিদটির কী হবে ? তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেছিলেন তারা সেটা ভাংবেন না,বরং রেখে দেবেন কারণ তাঁর ভাষায় “ধ্বংসের চেয়ে সৃষ্টির শক্তি বড় ।” এমন মহানতা দেখিয়ে প্রতিশোধ না নিয়ে কয়েক মাইল দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মসজিদটিকে এবং সসম্মানে অক্ষত রাখা হয় । এটাই ছিল হাজার বছরের মন্দির ভাংচুরের আক্রমণের বিরুদ্ধে হিন্দুদের নৈতিক বিজয় । জওহরলাল নেহেরু একে বলেছিলেন হিন্দু পুনর্জাগরণের আন্দোলন, রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কে এম মুন্সি একে বলছেন, স্বাধীনতার ফলশ্রুতি এবং অতীতে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হওয়া অবিচারের প্রতিকার ।
রূপকথার ফিনিক্স পাখি,বারবার ছাই হয়েও ফিরে আসে যে । তেমন ই এক ফিনিক্স পাখি গুজরাটের সোমনাথ মন্দির । এই মন্দির বাঁচাতে গিয়ে হানাদারদের হাতে যে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর জীবন বলিদান হয়েছে তাদের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ।
সংগৃহীত।