মহাম্ভোধেস্তীরে কনকরুচিরে নীলশিখরে
বসন্ প্রাসাদান্তে সহজবলভদ্ৰেণ বলিনা।
সুভদ্ৰামধ্যস্থঃ সকলসুরসেবাবসরদো
জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে॥
নীল সবুজের আদি দিগন্ত জলরাশি
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভীমবেগে অবিরাম আছড়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে। ফেনিল জলরাশি গুরু গুরু শব্দবেগে মুহূর্ত মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বেলাভূমির বুকে। তবু সখ্য হয়ে অবস্থান করছে বেলাভূমি ও সমুদ্র। এই সমুদ্রের বেলাভূমি যেথায় শেষ হয় সেথায় খানিক তফাতে অনেকটা পাহাড়ের মতো উঁচু বালিয়াড়ি ঢিবি অবস্থান করছে। তার নাম #নীলসুন্দর_পর্বত। স্থানীয় ভাষায় এর নাম #নীলাচল।সমুদ্রের তীরে এমন শক্ত বালিয়াড়ি পর্বত কেমন করে গড়ে উঠল কেউ জানে না। পূর্বে নীলসুন্দর ও নীল সমুদ্র আরো নিকটবর্তী ছিল । সময়ের ব্যবধানে আজ সমুদ্র একটু সরে গিয়েছে।
সেই মহাসমুদ্রের তীরদেশে, কনকোজ্জল নীলাদ্রির শিখরে প্রাসাদাভ্যন্তরে বলশালী বলরাম ও সুভদ্রার মধ্যভাগে বাস করিতেছেন, যিনি সমস্ত দেবগণকে সেবা করার নিমিত্ত অবসর প্রদান রাজার রাজা মহারাজা প্রভু জগন্নাথ।
বেলাভূমির কিছুটা পর থেকেই যতদূর চোখ যায় সামনে পিছনে শুধু তাল আর নারিকেল বৃক্ষ। নীল আকাশের গায়ে সবুজের এক আশ্চর্য আলপনা।সমুদ্রের হাওয়ায় গাছগুলোর ঝাঁকড়া মাথায় দিবানিশি শরশর শব্দ ওঠে। তাল তমালের ফাঁকে ফাঁকে নীল পর্বত উঁকি দেয় আর দেখা যায় স্থানীয় মানুষজনদের।
নীল পর্বতে ছোট্ট এক পাথরের মন্দির। সেখানে পূজা হয় ভগবান শ্ৰীপুরুষোত্তমের। দিনের বেলায় মাঝে মাঝে কাঁসর ঘন্টা মঙ্গল শঙ্খনাদে আরতি হয় ভগবানের। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামলে মন্দিরে জ্বলে ওঠে অজস্র প্রদীপ। দূর হতে সেই বিন্দু বিন্দু আলো ঝোপ – ঝাড়ের ফাঁকে জোনাকির আলোর মতো চোখে পড়ে।
শ্ৰীপুরুষোত্তমের মন্দিরে উচ্চ নীচ, ধনী দরিদ্র সকলের প্রবেশ অবাধ। সেই পরম ব্রহ্মের নামেই এই স্থানের নাম পুরুষোত্তম ক্ষেত্র। আবার তাঁর শক্তি শ্ৰী লক্ষ্মীদেবীর জন্য এ স্থানের নাম শ্ৰীক্ষেত্র ও বটে। রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন , যিনি ব্রহ্ম, তিনি আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাকে ব্রহ্ম বলি। পুরুষ বলি। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এসব করেন তাকে শক্তি বলি। প্রকৃতি বলি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যিনি পুরুষ তিনি প্রকৃতি। আনন্দময় আর আনন্দময়ী। পিতা আর জননী। যিনি জগৎরূপে আছেন- সর্বব্যাপী হয়ে তিনি মা।
অজেহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানীমীম্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।
যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
যিনি ভাগবতোত্তম, তিনি সর্বভূতে আত্মার আত্মাস্বরূপ ভগবানকেই দেখেন এবং আত্মার আত্মাস্বরূপ পরমাত্মাকে সমস্ত জীবকে দেখেন।
সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ্ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ ।
ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ ।।
অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্ ।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি ॥
যা সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, তাকে তুমি অবিনাশী বলে জানবে৷ সেই অব্যয় আত্মাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।
শ্ৰীবলভদ্র মহাবলশালী, তিনি শঙ্খের ন্যায় শুভ্র আবার এই উৎকল – কলিঙ্গের সমুদ্র পাড়ের সবুজে ঘেরা মনোরম এই অঞ্চলটির আকৃতি অনেকটা শঙ্খের মতো। তাই এই স্থানের নাম শঙ্খ ক্ষেত্র। নীলাদ্রি এই অঞ্চল। ভগবান পুরুষোত্তম , তিনিই জগন্নাথ ,তিনিই জগবন্ধু। এইটিই তাঁর ভবন, এইটিই তাঁর পুরী, তাঁর গৃহ বা আলয়। লোকমুখে তাই এই স্থান #পুরী নামে অধিক পরিচিত হয়ে ওঠে।
নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে।
বলভদ্রসুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ।।
জগন্নাথদেব কেবলমাত্র মন্দির বা মানব মনেই বিরাজ করেন না। তিনি উড়িষ্যার হস্ত শিল্প এবং কুটির শিল্পেও সমভাবে বিরাজ করেন। উড়িষ্যার রঘুরাজপুরের পটচিত্রের খ্যাতি জগৎ জোড়া। সেই পটচিত্রকে সবর্তভাবে প্রভাবিত করেছে উড়িষ্যার জগন্নাথ সংস্কৃতি। সুন্দর রঙের বিন্যাস এবং সুসংহত সূক্ষ্ম রেখার যুগলবন্দি এই পটচিত্রে জগন্নাথ সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপ যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি আরও নানা পুরাকল্পেরঘটনাও বিধৃত হয়েছে।
উড়িষ্যার পটশিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন জগন্নাথদেবের মন্দির। নীলমাধব শ্ৰী জগন্নাথ দেবের শবর সেবায়েতগণ থেকেই সৃষ্ট হয়েছে এই চিত্রকর শ্রেণী। ফলে, রাজাধিরাজ শ্ৰী জগন্নাথদেবের অঙ্গসজ্জা , পূজা উপকরণ থেকে রথ সজ্জা, চিত্র সর্বত্রই এই চিত্রকরগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উৎকল কলিঙ্গের তীরে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের আত্মময় দেহটি নীল পাথরে প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। সেই নীলপ্রস্তরই নীলমাধব রূপে শবর দ্বারা পূজিত হতে থাকে। নীলমাধব রূপী শ্ৰীবিষ্ণুই আজও দারুব্রহ্ম রূপে পূজিত হন। জগবন্ধুর নিকট উচ্চ নিচ নেই। এই পটচিত্রের সূচনাও সেখান থেকেই। নবকলেবর সময় যে দারুমূর্তি নির্মাণের কাজ অতিসঙ্গোপনে হয়, সেই সব কাজেই চিত্রকরদের ভূমিকা থাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে।
চিত্রকরগণই এই দারুমূর্তির উপরে দড়ির আস্তরণ দেন এবং তারপর এক সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে শ্ৰী কাপড় দিয়ে দারুব্রহ্মকে আচ্ছাদিত করেন। বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরী একপ্রকার আঠার মাধ্যমে শ্ৰীকাপড়কে দারুব্রহ্মের অঙ্গে লাগানো হয়। কর্পূর , ধুনা, গুগুল ইত্যাদি ভালো করে #রাঁধনা করে অর্থাৎ আগুনের সাহায্যে প্রস্তুত করে লেপন করা হয়। এটি অত্যন্ত সুগন্ধী লেপন। এরপর #খাদিলাগি নামক এক প্রকার মৃত্তিকার পালিশ বা বলতে পারেন Soft clay stone ব্যবহার করা হয়। চিত্রকরগণ এই কাপড়ের উপর নকশা ফুটিয়ে তোলেন। হিসাবমতো এই বস্তুটি চিত্রকরদের করা প্রথম পট বলা যায়। কারণ, যে এখানে নির্মাণ করা হয় , তা এই একই পদ্ধতি অনুসারে নির্মিত হয়। চিত্রকরদের নিকট এইটি অত্যন্ত শুভ কর্ম। তবে কেবলমাত্র নবকলেবর নয় বছরের বিভিন্ন সময় এই চিত্রকরগণ রঙ করেন দেববিগ্রহকে।
সুপ্রসিদ্ধ এবং সুপ্রাচীন পটচিত্রের কথা আমরা রামায়ণ, মহাভারত, অনর্ঘরাঘব নাটকে পেয়ে থাকি। আবার বৈদ্যবিলাস গ্রন্থে ” কটি লাবণ্য সুন্দরী”তে রাজা চিত্রকরদের নিকট স্ত্রীর জন্য পটচিত্র চাইছেন এমন উল্লেখ আছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরণের পটচিত্র আছে। উড়িষ্যার পটচিত্রের শুরু জগন্নাথদেব তথা স্নানযাত্রা ও রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে। স্নানপূর্ণিমার দিন দারুব্রহ্মের পুণ্যস্নান পর্ব সমাধা হলে, বিগ্রহগুলিতে লেপ অর্থাৎ রঙ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এই সময় জগন্নাথ , বলরাম ও সুভদ্রা এবং সুদর্শনচক্রকে রত্নবেদী বা সিংহাসন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। অনবসর কক্ষে তখন জগন্নাথ ,বলরাম, সুভদ্রার চিকিৎসার ও বিশেষ ধরনের পথ্যের ব্যবস্থা করা হয়।
এই ১৫ দিন জগন্নাথ মন্দিরের দেবমন্দিরের গর্ভগৃহে মূল মূর্তির পরিবর্তে তিন দেবদেবীর পটচিত্র রাখা হয়। অনুমান করা হয়, ১০৭৮ – ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দ সময় কালের মধ্যেই অর্থাৎ গজরাজ অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গদেবের শাসনকালেই এই অবসরপটি তথা পটচিত্রে চিত্রিত দেবদেবীর অভিষেক সূচিত হয় পুরী মন্দিরে। যেহেতু জগন্নাথ সংস্কৃতি সমগ্র উড়িষ্যাকে একই সূত্রে বন্ধন করেছে, ফলে সকল কিছু বস্তু, কর্ম এবং কর্মফলে তিনিই অবস্থান করেন।
কাপড়ের উপর এই চিত্রের আরও প্রাচীন রূপ দেখতে পাওয়া যায় বগুড়া জেলার বিরিঞ্চি মন্দির গাত্রে। অপরূপ সেই সব চিত্র। কোথায় যেন ধ্রুপদী শিল্প সম্ভারেরই নিদর্শন হয়ে উঠেছে উড়িষ্যার শিল্পগুলি। উড়িষ্যার শিল্প ও ভাস্কর্যের স্বর্ণযুগ বলতে একাদশ থেকে পঞ্চদশ শতকেই বোঝানো হয়। কারণ এরপর বেশকিছু শতক উড়িষ্যা মরু শাসনের অধীন ছিল এবং সেই সময় যথেচ্ছভাবে উড়িষ্যার শিল্পকলাকে ধ্বংস করা হয়। এই একাদশ থেকে পঞ্চদশ শতক অবধি সময়ে পুরীমন্দির , কোনার্ক সূর্যমন্দির, ভুবনেশ্বরের মন্দির ইত্যাদির শ্রেষ্ঠ শিল্পনিদর্শনগুলি নির্মিত হয়েছিল। মাদলাপাঞ্জী থেকে জানা যায় যে, এই সময়ের মধ্যেই চিত্রকরদের নিয়োগ করা হয়েছিল পুরীমন্দিরের ভিতরে বিভিন্ন চিত্র করার জন্য। লক্ষ্মীমন্দিরের জগমোহন, গুন্ডিচা দেবীর মন্দিরে ঝুলনমণ্ডপ এই ধরনের প্রচুর ছবি দেখা যায়। কিন্তু সবথেকে বিখ্যাত পটচিত্রটি হল কাঞ্চিবিজয়।
বারংবার লেপ বা রঙ করার জন্য প্রাচীন রঙের বৈচিত্র এখন বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু এটিও জগন্নাথমন্দিরের এক বহু প্রাচীন রীতি, যা ” সুনিয়া পরব ” নামে পরিচিত।
এ ব্যতীত তালপত্রের উপর সূক্ষ্ম ধাতব পিনের ন্যায় তুলির আঁচড়ে অঙ্কিত হয় গীতগোবিন্দ, দশাবতারের মত শিল্পগুলি। ভাগবতঘর বা গড়ি থেকে গীতগোবিন্দকে কেন্দ্র করে এমন শিল্প বহুল পরিমানে প্রাপ্ত হয়। কাগজের আবিষ্কার না হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে তালপত্রের ম্যানুস্ক্রিপ্ট বা শৈলী উড়িষ্যার নানা স্থান থেকে প্রাপ্ত হয়। পটচিত্র বা তালপত্র শৈলীগুলিতে মহাকাব্য , পুরাণাদি কাহিনী বিবৃত হয়েছে। রামায়ণ ,মহাভারত তো বটেই তাছাড়াও হরিবংশ , লাবণ্যবর্তী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকের সময়কাল থেকে অবশ্য নানাবিধ তান্ত্রিক, বৌদ্ধ, জৈন এবং মুঘল মিনিয়েচার শৈলীও প্রাপ্ত হয়।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী