বাংলা প্রবাদ বলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই প্রবাদ যেমন বঙ্গবাসীর জন্য একশত ভাগ সত্য , তেমনটি উড়িষ্যার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বটে। উড়িষ্যার অধিকাংশ পালপার্বণগুলি জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে এবং জগন্নাথ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। পূর্ব পর্বেই বলেছি উড়িষ্যার সংস্কৃতিতে পট বা পটির উৎপত্তি বহু পূর্ব থেকে এবং মন্দিরের প্ৰয়োজনীয়তার জন্যই হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে পটগুলি যে চিত্রিত হয়, তাদের বিভিন্ন প্রকার নামের “পটি”তে অভিহিত করা হয়। যেমন – স্নানযাত্রাপটি, অনবসর বা অনসরপটি, ঝুলনপট, শ্ৰীকৃষ্ণজনমপটি, কাঞ্চিবিজয়পটি, কৃষ্ণলীলাপটি, বামন জনমপটি, সহর্ষ কুম্ভাভিষেকাপটি, দশেরা পটি, দোলযাত্রাপটি, কন্দর্প অধিবাসা এবং দমনকচোরী, চন্দনযাত্রা, রুক্মিণী বিবাহ প্রভৃতি।

রামায়ণ বা রামপটি

পূর্ব পর্বেই বলেছি সকল পটির মধ্যে অনবসরপটি সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। স্নানযাত্রার পরবর্তী পনেরো দিন যখন দেবমন্দিরে দারুব্রহ্ম লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকেন। এই সময় রত্নবেদী বা রত্নসিংহাসনে পটচিত্রের উপর তিন দেবদেবীকে চিত্রিত করে উপস্থাপন করা হয়। এই বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরী পটচিত্রের নামই হল অনসর বা অনবসর পটি।

এটিই প্রকৃত অনসর পটি। উক্ত পটিটি নারায়ণ পটি।

প্রাচীন কথানুসারে মহারাজ ইন্দ্রদুম্ন মন্দির প্রতিষ্ঠার পর যখন তাঁর আরাধিত দেবতার সম্পর্কে জানতে চান, তখন যতেক নিয়ম ব্রহ্মা রাজাকে বলেছিলেন তার মধ্যে স্নান যাত্রা এবং তার পরে ১৫ দিন তাঁর অবসর বাসের কথা উল্লেখিত হয়। একথা শুনে রাজা অত্যন্ত ব্যথিত হন। একপক্ষকাল ব্যাপী তাঁর প্রভু অন্তরালে গুপ্ত অবস্থায় থাকবেন। তা হলে ভক্তের কি উপায়? তাঁরা কি প্রভু দর্শনের বঞ্চিত হবেন? বিকল্প কোনো ব্যবস্থা?

অনসর পটি। এই পটিই মন্দিরে পূজিত হয়।

উত্তরে ব্রহ্মা যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেখান হতেই মন্দিরের পটচিত্রের আদি উৎস। অষ্টাদশ শতকের বিশিষ্ট সংস্কৃত পন্ডিত নিলাদ্রী মহোদয় এ বিষয় তাঁর গ্রন্থে অপূর্ব লেখনির মাধ্যমে বিবরণ দিয়েছেন – ব্রহ্মা মহারাজ ইন্দ্রদুম্নকে বলেছিলেন অনঅবসরের পক্ষকাল দারু ব্রহ্ম বংশদণ্ডের চালচিত্র দ্বারা আচ্ছাদিত থাকবেন। সেই চালচিত্র স্নানযাত্রার পরের দিন থেকে সূক্ষ্ম বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত থাকবে। তার উপর থাকবে তিনটি পট।

অনসর পটি অঙ্কন করা হচ্ছে

শ্ৰী জগন্নাথ, শ্ৰী বলভদ্র এবং ভুবনেশ্বরী সুভদ্রাকে কাপড়ের উপর চিত্রিত করা হয় সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় নীতি মেনে। বলভদ্র শ্বেত শুভ্র। তিনি কেশব , তিনি সদাশিব। তিনি শঙ্খ, চক্র, হল এবং মুষলধারী চতুর্ভুজ বলভদ্র, সালঙ্কার হয়ে অবস্থান করেন। সুভদ্রা কাঁচা হরিদ্রার ন্যায় সুবর্ণা। তিনি পদ্মাসনে অধিষ্ঠিতা। তিনি চতুর্ভুজা। তিনি দুই হস্তে দুইটি পদ্ম এবং অন্য দুই হাতে বরাভয় মুদ্রায় অবস্থান করছেন। তিনি ভুবনেশ্বরী , তিনি স্বয়ং মহামায়া। তাঁর চিত্রিত দেহ আভরণে ভূষিতা। শ্ৰী পুরুষোত্তম জগন্নাথ দেব পদ্মাসনে উপবিষ্ট। চতুর্ভুজ জগন্নাথ নারায়ণ তাঁর চার হস্তে শঙ্খ , চক্র ,গদা, পদ্ম ধারণ করে আছেন। তিনি পদ্মলোচন। তিনি ব্যোমনীলাভ বর্ণ। তাঁর বক্ষে অবস্থান করছে শ্ৰী বৎস ও কৌস্তভ মণি। তিনি বামন , তিনি রাম, তিনি কেশব কৃষ্ণ। তাঁর গলে দোদুল্যমান বনমালা হার । তিনি রাজরাজেশ্বর হয়ে সর্বাগ্রে অবস্থান করছেন।

যেসকল স্থানে নিয়ম মেনে জগন্নাথ উপাসনা হয় সেখানেই স্নানযাত্রার পরে এই পটি পূজিত হয়।

শাস্ত্র মতে,,,,,
“তারা সাক্ষাৎ শূলপাণি সুভদ্রা ভুবনেশ্বরী।
নীলাদ্রৌ জগন্নাথস্তু স্বয়ং দক্ষিণকালিকা।।”

  • শূলপাণি সদাশিবস্বরূপ বলভদ্র সাক্ষাৎ দেবী উগ্রতারার পূরুষাকার প্রকাশ, সুভদ্রা মায়াবীজাধিষ্ঠাত্রী দেবী ভুবনেশ্বরী এবং নীলাদ্রিক্ষেত্রে অবস্থিত জগন্নাথ স্বয়ং পরব্রহ্মস্বরূপ নির্গুণ শূণ্যরূপা দক্ষিণাকালী।
নৃসিংহ পটি

শাক্তদের কাছে দক্ষিণাকালী, ব্রহ্মবাদীদের কাছে দারুব্রহ্ম, বৈষ্ণবদের কাছে গোলকবিহারী, তন্ত্রসাধকের কাছে ভৈরব—বিভিন্ন সময়ে নানান নামে নানান উপাচারে পূজিত হয়েছেন তিনি। এখনও হন। তাই তাঁর পূজামন্ত্রে আছে সমস্ত হিন্দুসম্প্রদায়ের পূজার অনুষঙ্গ, আছে সমস্ত হিন্দুসম্প্রদায়ের নানাবিধ আচার। এভাবেই একইরূপে একইসঙ্গে সমস্ত হিন্দুসম্প্রদায়ের মানুষের নাথ হয়ে উঠেছেন জগন্নাথ।

রঘুরাজপুর গ্রাম

যথাবিহিত নিয়মে এই তিন দেবদেবীর সকল পূজা পদ্ধতি পটেই সম্পন্ন হয়। রাজাকে ব্রহ্মা বলেছিলেন জেনে পটের মধ্যেই নিরাকার দারুব্রহ্ম অবস্থান করবেন আপন মহিমায়। যদিও দারু বিগ্রহ থেকে পটে অঙ্কিত চিত্র সম্পূর্ণ পৃথক। সেখানে তিনি নররূপী নারায়ণ , নররূপী শিব , নারীরূপী প্রকৃতি স্বরূপা মহামায়া। কিন্তু তাঁরা একই। পটচিত্রে জগন্নাথদেবকে নারায়ণ বা নীলমাধব, বলভদ্রকে বলরাম বা শেষদেব এবং সুভদ্রা ভুবনেশ্বরী নামে অভিহিত হন।

রামায়ণ পটি

এই অনসর পটি বড় নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে তৈরি হয়। বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন হতে অনসর পটির কাজ শুরু হয়। যতদিন এই চিত্র তৈরি হয় ততদিন বেশ কিছু নিয়ম সংস্কার মেনে চলতে হয়। যিনি এই চিত্র অঙ্কন করবেন তাঁর নিমিত্ত একটি ঘর চুনকাম করা হয়। যদি কাঁচা মাটির গৃহ হয় তবে তা ভালো করে গোবর দিয়ে নিকানো হয়। এই সময় চিত্রকরের গৃহে কোনো প্রকার আমিষ রন্ধন এমনকি পিঁয়াজ , রসুনও নিষিদ্ধ থাকে। প্রত্যহ স্নান করে , ধৌত বস্ত্র পরিধান করে তবেই চিত্রকর তাঁর কাজ শুরু করেন। অনসর পটি নির্মাণের সময় নারী সঙ্গ , কু অভ্যাস, নেশাজাত দ্রব্যে কঠোর নিষেধ থাকে। ঈশ্বরে নামে দিন শুরু করে রাত্রি কালে চিত্রকর সংযম পালন করে মাটিতে শয়ন করেন। কারণ এই পটচিত্র এবং ঈশ্বর একীভূত হয়ে অবস্থান করেন।

শ্ৰীকৃষ্ণলীলা পটি

অনসরপটি নির্মাণের কর্ম সম্পাদন হলে চিত্রকর নিজস্ব পূজারী পরিবারের সকলকে নিয়ে একটি পূজা করেন।সাধারণত স্নানপূর্ণিমা রাত্রেই চিত্র নির্মাণের কর্ম সম্পাদন করেন। পরের দিন প্রাতে মন্দির হতে বিশেষ অর্চনা সামগ্রী সহ অজনা মালা , ঘন্টা, ছাতা, বাঁশি ইত্যাদি নিয়ে মূল পুরোহিত একটি পূজা করেন পটিদেবের উদ্দেশ্যে। তারপর একটি কালো বস্ত্রখণ্ডের মাধ্যমে পটচিত্রটিকে বাঁধা হয়। ধীরে ধীরে শোভাযাত্রা করে মূল চিত্রকর তাঁর স্কন্ধারূঢ় পটিগুলিকে মন্দিরে নিয়ে চলেন। মন্দিরের সিংহ দরজায় মন্দির কর্তৃপক্ষের বিশেষ প্রতিনিধি এইটি গ্রহণ করেন।

প্রথমে জ্যেষ্ঠ সদাশিব শ্বেত কেশব বলভদ্রের বলরাম পটি গ্রহণ করা হয় , তারপর ভ্রাতা কৃষ্ণ কেশব জগন্নাথের নারায়ণ পটি গ্রহণ করা হয় এবং তার সঙ্গে গ্রহণ করা হয় আরও একটি ছোট পটি। এই ছোট্ট পটিটি পতিতপাবনপটি নামে বিখ্যাত। এরপর গৃহিত হয় মহামায়া সুভদ্রা দেবীর ভুবনেশ্বরী পটিটি।

সকল পটি গ্রহণের পর সিংহদুয়ার হতে মন্দিরের অভ্যন্তরে পটিগুলি নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাঁশ নির্মিত আচ্ছাদনের সামনে একটি বিশেষ চৌদলায় পটচিত্রগুলি রাখা হয়। এরপর চিত্রকরদের বিদায়ের পালা। পরবর্তী কাজগুলির জন্য আসেন দর্জি সেবক। তিনি জড়ানো পটগুলিকে খুলে চালচিত্রের উপর স্থাপন করে দেন।

পটচিত্রের দেবতাদের বিশেষ মন্ত্রসহকারে সাংকেতিক ভাবে মহাস্নান করানো হয়। এইভাবে সম্পূর্ণরূপে বিকল্প দেবতার প্রতিষ্ঠা হয়। এই সময় থেকে একপক্ষকাল মন্দিরের গুহ্যগৃহে দারুব্রহ্মের গুপ্ত অবস্থান হয় এবং গর্ভগৃহের মূল দেবদেবী রূপে সর্বসমক্ষে এই পটচিত্র বিরাজ করেন এবং যাবতীয় রীতিনীতি, পূজা সব এখানেই সম্পন্ন হয়। তাই বলা যেতে পারে যে, অনবসর বা অনসরপটি দিয়ে বহুপ্রাচীন কালের আগমনবার্তা সূচিত হয়েছে।

এই পর্বের প্রথম দিকে আরও যেসকল পটের কথা উল্লেখ করেছিলাম তাদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পটই পূজার উপযোগী এবং মূল বিগ্রহের পশ্চাদপট রচনার ক্ষেত্রে বা মূলমন্ডপকে সজ্জিত করবার নিমিত্ত বহুল ব্যবহার হয়েছে। স্নানযাত্রার সময় যে স্নানবেদিতে মূল বিগ্রহ বসেন , তার পিছনে অর্থাৎ স্নানমণ্ডপের দেওয়াল গাত্রে চিত্রকরগণ বিভিন্ন প্রকার পদ্মফুল আঁকেন। রথের চাকায় নানা প্রকার পাতার নকশা, মিথুন হংসের চিত্র, পার্শ্বদেবতার চিত্র, নারীদের চিত্র দিয়ে – সখীপটী, অষ্টাদলপদ্ম, জয়বিজয়, মুকুটের পিছনে প্রভা, বৈদিক এবং পৌরাণিক ঋষিদের কেন্দ্র করে অঙ্কিত ” ঋষিপটি ” , জীবজন্তু- পক্ষী পটি দিয়ে রথ সজ্জিত ও নান্দনিক করে তোলেন।

ঝুলনপূর্ণিমায় লক্ষ্মী , সরস্বতী এবং মদনমোহনকে মুক্তিমন্ডপে সর্বসমক্ষে আনা হয়। এই মন্ডপটিকে বলা হয় ঝুলনকুঞ্জ। সেখানে যুগলের দোলনার চারিপাশে নানা ধরনের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পটি দিয়ে সজ্জিত করা হয়। এছাড়াও রাম – সীতা- লক্ষ্মণ, নারায়ণ , অরণ্যের নানা চিত্র, উত্তাল ঝর্ণা , পশুপাখির চিত্র ইত্যাদিও থাকে। প্রচুর সখীপটিও অঙ্কন করা হয় ঝুলনকুঞ্জ সাজানোর জন্য।

জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ভাদ্রমাসে সারা ভারতব্যাপী ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের জন্মদিন পালিত হয়। শ্ৰীক্ষেত্র জগন্নাথদেবের মন্দিরেও তা পালিত হয়। এই সময় মদনমোহনদেবকে কেন্দ্র করে চারিপাশে শ্ৰীকৃষ্ণ জন্মকথার বিভিন্ন লীলা চিত্রিত হয়। সাধারণত মধ্যভাগে শ্ৰীকৃষ্ণের জীবন কাহিনী অঙ্কিত হয়। এগুলিকে জন্মাষ্টমীপটি বলে। এটি ১৮ ঘর চিত্রকরগণ অর্থাৎ যাঁরা জগন্নাথপটি অঙ্কন করেন তাঁরাই করেন।

নবগুঞ্জার রূপী শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন

শ্ৰীকৃষ্ণলীলাপটিও জন্মাষ্টমীর সঙ্গেই সম্পৃক্ত। এতে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব কিছু বর্ণনা থাকে। বামনজনমপটিতে বিষ্ণুর বামন অবতারের চিত্র আঁকেন চিত্রকরগণ। সহস্রকুম্ভ অভিষেকপটি তে মা বিমলাকে জগন্নাথ মন্দিরে আনত হয় অশ্বিন মাসে। তার পূর্বে বিমলা মায়ের মন্দিরের দেওয়ালে চিত্রকরগণ বিশেষ কয়েকটি ছবি আঁকেন, যেমন – ব্যাঘ্র, কেশররাজ সিংহ, অজস্র পূর্ণ কুম্ভ এবং বৃক্ষ। বিজয়া দশমীর দিন জগন্নাথদেবকে অপূর্ব রাজবেশে সজ্জিত করা হয়। এই দিন বড় চৌকনা কাঠের তক্তা চিত্রকরদের নিকট প্রেরিত হয় মীন বা মৎস্য অঙ্কনের নিমিত্ত। এটি মীনাদণ্ডপটি নামে পরিচিত।

দোলযাত্রার দিন দোলবেদীতে দোলনার উপর ধাতব বিগ্রহ রাখা হয়।তার পাশে ও পিছনে সূর্যদেবের মূর্তি ও পিছনে প্রচুর গাছপালা রাখা হয়। দুটি সিংহ মূর্তিও আঁকা হয় পটে। কন্দর্পঅধিবাসাপটিতে কন্দর্প দেবের চিত্র অঙ্কন করা হয়। সেখানে নীলবর্ণের কন্দর্পকে পুষ্পধনু ও তীর হস্তে দেখানো হয়।

চন্দনযাত্রা জগন্নাথদেবের সবথেকে উল্লেখযোগ্য উৎসব। এই সময় দারুব্রহ্ম তাঁর শক্তিকে নিয়ে নৌবিহার করেন। নরেন্দ্র সরোবরে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন যে সুন্দর পাঁচটি চিত্রিত নৌকায় প্রভু জলবিহার করেন তাকে চাপাস বলে। চিত্রকরেরা জল মধ্যস্থ মন্দিরগাত্র সুন্দর করে চিত্রিত করেন এবং চাপাসের কিছু কাঠের নকশাও সুন্দর করে রঙ করা হয়। এই দিনই তো অনসরপটির কাজ শুরু হয়।

নৌবিহারের পটচিত্র

জ্যৈষ্ঠ মাসে রুক্মিণীবিবাহ একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব। এদিন মদনমোহনজীর সঙ্গে দেবী রুক্মিণীর বিবাহ হয় মাজনা মণ্ডপে। এই মণ্ডপ সজ্জায় চিত্রকরগণ বহু পূর্ণ কুম্ভ এবং বৃক্ষপটি নির্মাণ করেন। আগে এসব কাজের জন্য চিত্রকরগণ অর্থের তুলনায় জমিই অধিক পেতেন। কিন্তু ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে আইনানুসারে সকল চিত্রকর অর্থ পেয়ে থাকেন।

পুরাণে জগন্নাথ ,বলরাম, সুভদ্রা ও সুর্দশনকে বিরাট, সূত্রাত্মা , অন্তর্যামী ,শুদ্ধির প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও বলরাম বিশ্ব , সুভদ্রা তৈজস ,জগন্নাথ হলেন প্রাজ্ঞ এবং সুদর্শন তুরীয় হিসাবে চিহ্নিত।

তাঁরা হলেন চারিবেদ। স্কন্দ্পুরানে জগন্নাথ হলেন সাম, বলরাম ঋক , সুভদ্রা যজু এবং সুদর্শন হলেন অথর্ববেদ…. তিনি হলেন অব্যক্ত পুরুষ। তাঁর ইচ্ছে স্বরূপীনি শক্তি সুভদ্রা ও বিরাটরূপী শক্তি বলরামের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত।তিনি ঘন নীল বর্ন। অর্থাৎ , পৃথিবীর যাবতীয় প্রকাশ তাঁর মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয়। সুভদ্রা হলেন ঐতিহ্য এর প্রতীক । তাঁর পীতবর্ণ। বলরাম হলেন শুভ্র ,ক্ষমতার প্রতীক…তাঁরাই রথে আসীন হন…

জগন্নাথ কোনো নিৰ্দিষ্ট গোত্রের বা নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের দেবতা নন। তিনি নিজেই একজন সম্প্রদায়। তিনি একাধারে মহাবিষ্ণু, যিনি গর্ভগৃহের রত্নবেদীতে বসে আছেন দক্ষিণকালিকা যন্ত্রের ওপরে, কামবীজে পূজিত হচ্ছেন, আবার ভৈরব মন্ত্রেও পূজিত হচ্ছেন। সাধারণক্ষেত্রে মহালক্ষ্মী তাঁর শক্তি হলেও, বিশেষ মতবাদে বিমলারূপিনী দুর্গা তাঁর শক্তি। একাধারে জগন্নাথ বৈষ্ণব, শাক্ত এবং শৈব দেবতাদের সংমিশ্রিত রূপ।


শুধু তাই বা বলি কেন, জগন্নাথ স্নানবেদীতে মহাগণপতি, শয়নে মহাবিষ্ণু, গমনে মার্তন্ড ভৈরবরূপী সূর্য, ভোজনে মহাভৈরবরূপে রুদ্র এবং শ্রীমন্দিরের গর্ভগৃহের রত্নবেদিকায় প্রথমা মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি শ্রীমদ্দক্ষিণকালিকারূপে সদাসর্বদা অধিষ্ঠান করছেন।

প্রকৃতপক্ষে জগন্নাথ হলেন সনাতন হিন্দু ধর্মের সমস্ত দেবদেবীর সম্মিলিত রুপ । বলা যায় পরব্রহ্ম পরমাত্মার সূক্ষ্ম প্রতীক ওঁকারের স্থুলরুপ তথা স্থুল প্রকাশ । এর মধ্যে দিয়ে হিন্দু ধর্মের সমস্ত মতধারাগুলিকে একত্রে সমন্বয় করার চেষ্টা চলেছে প্রাচীন কাল থেকেই ।

শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে চরম বৈষ্ণব মতবাদে শ্রীমন্দির অনুপ্রাণিত হলেও দুর্গামাধব পূজার পদ্ধতি আজও পুরীতে প্রচলিত। আশ্বিনের কৃষ্ণা অষ্টমী থেকে শুক্লা নবমী পর্যন্ত ১৬ দিন ব্যাপী দেবী বিমলার সাথে তার ভৈরব জগন্নাথ একত্রে প্রত্যক্ষ ভাবে পূজা পান। সপ্তমী, মহাষ্টমী এবং মহানবমীতে ছাগ ও মেষ বলি হয়, দেবী বিমলাকে সামিষ ভোগ (যাতে মাছও থাকে) নিবেদন করা হয়। এই সময় বিমলা দেবী ভুবনেশ্বরী, বনদুর্গা, রাজরাজেশ্বরী, উগ্রতারা, মাতঙ্গী, বগলা, নারায়ণী, সিংহবাহিনী, জয়দুর্গা, শূলিনীদুর্গা এবং হরচন্ডীরূপে পূজিতা হন।

শুধু শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা নয়, মূর্তিতত্ত্বে যদি ফিরে আসি, খেয়াল করলে দেখতে পাব, দিব্য ত্রিমূর্তির উপরিভাগ মানবীর বক্ষস্থলের (chest wall) আকৃতি বিশিষ্ট এবং নিম্নভাগ জরায়ুর দেহভাগের মত(body of uterus, uterine corpus)। জগন্নাথের সুবর্তুল নেত্রদ্বয় পূর্ণগর্ভা নারীর স্তনযুগলের মত এবং পরিপূর্ণ জরায়ু সেই সৃষ্টিকর্ত্রীর বিশ্বচরাচর প্রসবের ধারণাকেই সুসংগঠিত করে। Fertility cult ভিন্ন আর কিছু নয়। জগন্নাথ বিমলা দেবীর ভৈরব হয়েও তাঁর দেহাঙ্গ বই কিছু নন এবং দুইতে সম্মিলিত না হলে সৃষ্টিকর্ত্রীর পরিপূর্ণ অবয়ব আসে না।

, মহাভৈরব জগন্নাথের প্রতি নিবেদিত প্রসাদ যতক্ষণ না মহাভৈরবী বিমলা দেবীকে উৎসর্গ না করা হয়, ততক্ষণ তা ‘মহাপ্রসাদ’ হিসেবে গণ্য হয় না। তাই আজ প্রসাদের থালায় তুলসী ও জবার একত্রে অধিষ্ঠান : ‘মহাপ্রসাদ’।

প্রভু যেমন অনাদি , অনন্ত , অদ্বিতীয়। প্রভুর লীলার যেমন কোনো বিরাম নেই , তেমনি কালের রথে চড়ে পুরীর পটচিত্রও অজেয়, অমর।

পরিশেষে চক্রআঁখি মহাপ্রভু-মহাভৈরব-মহাদেবী জগন্নাথের উদ্দেশে বারংবার প্রণাম করে বলি,

“সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমারি দুখানি নয়নে”

  • নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে।
    বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ।।

সমাপ্ত

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.