ঘনাদার স্রষ্টার সাথে পাঙ্গা, সাধারণ গড়পড়তা বাঙালি কি আর পারে?

সূর্য কাঁদলে সোনা। ঘনাদার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েও আগে সুবিশাল এই উপন্যাসটি পড়ে দেখার সুযোগ ঘটে নি। অনেক দিনের চেষ্টার পর এই দ্বিতীয় লকডাউনে সময় মিলল, আর দেরি কেউ করে?

এই উপন্যাসটি ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেসবাড়ির ছাদের ঘরে থাকা লম্বা কালো শীর্ণকায় ঘনশ্যাম দাস এর গল্প নয়, গল্প তাঁর ঊর্ধ্বতন দ্বাবিংশতম পূর্বপুরুষ ঘনরাম দাস কে নিয়ে (অর্থাৎ কিনা তস্য তস্য ঘনাদা) । আর এখানে সেই মেসবাড়ির বাকি প্রতিনিধি যথা শিবু, শিশির, গৌর ও সুধীর অনুপস্থিত। এই উপন্যাসে ঘনাদার কাহিনীর স্বাদ নিয়েছেন ইতিহাসের অধ্যাপক “মর্মরের মত মস্তক যাঁর মসৃণ” শিবপদবাবু, “মেদভারে হস্তির মত যিনি বিপুল” ভবতারণবাবু, “কুম্ভের মত উদরদেশ যাঁর স্ফীত” রামশরণ বাবু, “শিরোশোভা কাশের মত শুভ্র” হরিসাধন বাবু সরোবরের সান্ধ্য আড্ডায়।

ঘনরাম দাস, যাঁকে স্প্যানিশরা গানাদো (স্প্যানিশে যার অর্থ গরু ভেড়া) নামে চেনে, তাঁর জীবন ভয়ঙ্কর উথালপাথালে ভরা । কখনো তিনি ভাসকো ডা গামার জাহাজে করে ভারত থেকে পশ্চিম গোলার্ধে আসা ক্রীতদাস, কখনো তিনি মেক্সিকো বিজয়ী হারনান্দ করতেজ এর বিশ্বস্ত সহাকারি, কখনো পরিষ্কার ল্যাটিন শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দেন, কখনো তলোয়ার খেলায় বাঘা বাঘা স্প্যানিশ বীরকে পরাস্ত করেন। এই গানাদোই স্পেনের মেক্সিকো জয়ের অন্যতম কারিগর; যখন টেঞ্ছটিটলান (মেক্সিকো সিটির অ্যাজটেক নাম) এ স্প্যানিশ বাহিনী প্রায় মরতে বসেছিল, তখন তিনিই ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে (অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চারশো বছর আগে) ট্যাঙ্ক ব্যবহারের পরামর্শ দেন! অবশ্য আমরা যারা ঘনাদাকে চিনি, সামান্য নুড়ি, কাদা, ছড়ি, হাঁস, টুপি নিয়ে ভেল্কি দেখিয়ে দেন যিনি, যিনি একই সাথে প্রথম এভারেস্টের শীর্ষে ও মঙ্গলগ্রহে পৌঁছেছেন, তাঁর পূর্বপুরুষ এরকম না হলেই আশ্চর্য হতাম। দুর্ভাগ্যবশত আধুনিক দুনিয়া এঁর কোন খোঁজ রাখে নি, কেননা একমাত্র যে বইয়ে তাঁর সব রোমহর্ষক কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ ছিল, টলোসা মঠের পাঠাগার ফ্যালাঞ্জিসটরা স্পেনের গৃহযুদ্ধে পুড়িয়ে ফেলার সাথে সাথে তা নাকি ধ্বংস হয়ে যায়!

এই বিশ্বাস আছে যে রসিক পাঠক ঘনাদা ও তাঁর পূর্বপুরুষদের বীরত্বের কাহিনী শুনে প্রমাণ চেয়ে রসভঙ্গ করবেন না। ‘সূর্য কাঁদলে সোনা’ উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য দক্ষিণ আমেরিকার সোনায় মোড়া দেশ পেরু আবিষ্কার, আর সেই আবিষ্কারে পদে পদে কত বিপদ ছিল, কত বিশ্বাসঘাতকতা, কত তঞ্চকতা, কত হানাহানি, আর সেসবে গানাদোর ভূমিকা কী ছিল সেসব নিয়েই কাহিনী। প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই বিপুল তথ্যবহুল উপন্যাসের স্পয়লার বিহীন সারাংশ দেওয়া আমার মত অকিঞ্চিৎকর পাঠকের পক্ষে একান্তই অসম্ভব। পৃথিবীর একদম অন্যপ্রান্তের ইতিহাসের পটভূমিতে এরকম একটা বাংলা উপন্যাস আর লেখা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। অদ্ভুত একটা উপন্যাস, যার বিস্তৃতি ছড়িয়ে আছে মেক্সিকো থেকে স্পেন, মাদ্রিদ থেকে সেভিয়া, মেদেলিন থেকে ত্রিয়ানা, স্পেন থেকে পানামা – নম্ব্রে দে দিওস বন্দর, আর তারপর পানামা থেকে পেরু – টমবেজ, কাক্সামাল্কা, কোরিকাঞ্চা শহর এবং সবেশেষে পেরু থেকে বঙ্গদেশের কাটোয়া! এসেছে অজস্র চরিত্র, অজস্র সূত্র। কাপিতেন সানসেদো, সাব্রিনা সেনোরা আনা তথা মার্সনেস, জুয়াচোর সোরাবিয়া তথা মারকুইস গঞ্জালেস দে সোলিস, পিজারো, আলমাগরো, হারনান্দ দে লুকে, ইনকা আতাহুয়ালপা, তাঁর ভাই হুয়াস্কার, মুইস্কা কুমারী কয়া, রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু! শুধু চরিত্রের নাম আর জায়গার নাম দিয়েই পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলা সম্ভব। এছাড়াও আছে স্প্যানিশ রাজনীতি, অর্থনীতি, ইনকা সভ্যতার বিভিন্ন রীতিনীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, তাদের দলাদলি, রাজনীতি, ল্লানটু, কিপু ইত্যাদি। প্রাচীন ইনকা সভ্যতার বহু গোপন রীতিনীতি পেরুতে বহিরাগত গানাদো কিভাবে এমন নিখুঁত ভাবে জানলেন সেটা একটা রহস্য বটে। অবশ্য এসব রহস্যের সাথে ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের বাকি বাসিন্দাদের সাথে সাথে আমরা ঘনাদার ভক্তরা খুবই পরিচিত। এরকম থিসিস সম ভজকট উপন্যাসের সব জট ছাড়িয়ে সব সূত্রের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সুচারু রূপে শেষ করার মধ্যে লেখকের মুন্সিয়ানা প্রকাশ পায়। ইতিহাস ও ফ্যান্টাসি ভিত্তিক তথাকথিত ‘বিশ্ববিখ্যাত’ সিরিজের নির্মাতারা যদি এই লেখকের সান্নিধ্য পেতেন, তাহলে হয়ত ওরকম জোলো সমাপ্তি দর্শকদের দেখতে হত না। এত এত সাহিত্য নিয়ে আজকাল ওয়েবসিরিজ হচ্ছে, ভাল পরিচালকের হাতে পড়লে ‘হের ডস’ ও তাঁর পূর্বপুরুষরা জেমস বন্ড কিংবা ইথান হান্টকে বলে বলে দশ গোল দিতেন এই ব্যাপারে নিশ্চিত।

উপন্যাসটি পড়লে পরিষ্কার বোঝা যাবে, সোনায় মোড়া দেশে কেন কান্নার রোল উঠেছিল, হাতে গোনা কয়েকজন স্প্যানিশ কিভাবে হাজার হাজার ইনকা আদিবাসীকে পরাস্ত করেছিল। ভারতবাসী এরকম নিদারুণ ইতিহাসের সাথে দিব্যি পরিচিত আছে। সূর্যদেবের ক্রন্দন খুবই স্বাভাবিক। উপন্যাসটি যত না গানাদোর বীরত্বের কথা, তার থেকে অনেক বেশি ইনকাদের ধ্বংসের কাহিনী। এই ধ্বংসে নিজের অবদান জেনে আত্মগ্লানিতে ভুগেছেন বঙ্গপুঙ্গব, আর তাই প্রায় অজ্ঞাতবাসে গিয়ে নিজেকে শাস্তি দিয়েছেন।

পরিশেষে বলি সত্যিকারের ঘনাদা/গানাদোর কথা – প্রেমেন্দ্র মিত্র। এত তথ্য, এত নিখুঁত বর্ণনা, ইতিহাস ইন্টারনেট/গুগল এর পূর্ববর্তী যুগে যিনি লিখেছেন, তিনি আসলে ঘনাদারও ওপরে যান। পাতা উলটিয়ে দেখছি, এই উপন্যাস লেখা হয় ১৯৬৭/ ১৯৬৮ সাল নাগাদ। সেসময় তিনি কতটা খেটে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, কোথা থেকেই বা এত নিখুঁত ইতিহাস পেয়েছিলেন খোদায় মালুম। অবশ্য ঘনাদার বাকি সব গল্পই এরকম নিখুঁত তথ্যবহুল। ইন্টারনেট/উইকিপিডিয়া/ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে তথ্য ডাম্প করে দেওয়া নয়, সেই তথ্যগুলোর মধ্যে কল্পনার ছুঁচসুতোর কারিকুরি করে কাহিনী বুনে দেওয়া, সেটাই তো লেখকসত্ত্বার যথাযথ প্রমাণ। আজকালকার “রিসার্চ করে” লেখা সাহিত্যকাররা একটু ভেবে দেখতে পারেন। উপন্যাসে স্পেনের সেভিয়া শহরের গুয়াদালকুইভির নদীর প্রসঙ্গ এসেছে, সেই নদীতে নাকি জাহাজ চলত। এই অধমের সেভিয়া শহরের গুয়াদালকুইভির নদীর পাড় ধরে হাঁটার সৌভাগ্য হয়েছিল – এত ছোট নদীতে জাহাজ কি করে চলত? ভাবলাম, এইখানে প্রেমেন্দ্র মিত্র একটু ভুল করেছেন। তারপর গুগল করতেই চোখ কপালে, এই নদী এখন শীর্ণকায়া হলেও ১৫০০ সাল নাগাদ এতে দিব্যি জাহাজ চলত। ঘনাদার স্রষ্টার সাথে পাঙ্গা, সাধারণ গড়পড়তা বাঙালি কি আর পারে?!

অর্ক সাঁতরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.