প্রায় দেড়শ বছর আগে ব্রিটিশ দের হাত ধরে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পাম চাষের শুরু হয়। মূলত পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশগুলি থেকে পাম গাছের বীজ আমদানি করা হয়েছিল চাষের জন্য। গত শতাব্দীর শুরুতে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলিতে পাম তেল উৎপাদন শুরু হয়।
পাম তেল, ভারতের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেনীর মানুষের জন্য একটি অর্থ সাশ্রয়ী রান্নার তেল। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় মতো উৎপাদনকারী দেশগুলির মধ্যে একটি বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যা তৈরি হয়েছে।
এপ্রসঙ্গে উল্লেক্ষ্য পাম, সয়াবিন এবং রেপেসিড এর মতো উদ্ভিজ্জ তেলগুলি জীবাশ্ম জ্বালানিগুলির বিকল্প বায়োডিজেলের উত্স হিসাবে ব্যপক রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেহেতু অপরিশোধিত তেলের দাম কমে গেছে, পাম তেলের দামও কমে গেছে। গত এক বছরে পাম তেলের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে আর এর তুলনায় অপরিশোধিত তেল ৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
গত ১২ই মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ই ইউ) পক্ষ থেকে জানানো হয় যে পাম চাষের ফলে অত্যধিক বনভূমি বিনাশের কারনে পর্যায়ক্রমে পরিবহন জ্বালানিতে পাম তেল ব্যবহার বন্ধ করা হবে। ইউনিয়নের পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির লক্ষ্য অংশ হিসাবে পাম তেল থেকে উত্পাদিত বায়োডিজেলের ব্যবহারে এই অবরোধ আনা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বার্তায় বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যেই ১৯৯০ এর তুলনায় ৪০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে চায় তারা।
ব্রাসেলস ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘ট্রান্সপোর্ট এন্ড এনভায়রনমেন্ট’ দাবি করেছে যে পাম গাছের চাষের জন্য ব্যবহৃত জমি বিবেচনা করলে পাম তেলের বায়োডিজেলের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানীগুলির তিনগুণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। দশকেরও বেশি সময় ধরে এনজিও গুলি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে রেনফরেস্ট বা স্বাভাবিক বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দাবি করে পাম তেল চাষের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। সংগঠনগুলি অভিযোগ করেছে যে ওরাঙওটাঙ্গের মতো বন্য প্রাণীর প্রাকৃতিক বাসস্থান এর ফলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে।
নতুন আইনটিতে যদিও ২ হেক্টর এর ছোটো জায়গায় তৈরি পাম তেলের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের পাম তেলের মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ তৈরি করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
নতুন এই নিয়মগুলিকে “বৈষম্যমূলক” হিসাবে বর্ননা করে, উৎপাদক দেশ গুলির কাউন্সিল মনে করে নতুন আইনটি বৈজ্ঞানিক ভাবে ত্রুটিযুক্ত এবং এবিষয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডাব্লিউটিও)র দারস্থ হবে তারা। অপরদিকে ডাব্লিউটিও তে বিতর্কের বিষয়ে তাদের অবস্থানে অনড় ইইউ বলেছে, এই আইনটি পরিবেশ ও পরিবেশগত উদ্বেগের থেকে নেওয়া হয়েছে। যদিও পাম তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির মতে ইইউ আইনটি বিশেষভাবে তাদের উৎপাদনকে লক্ষ্য করে নিয়েছে , পরিবেশগত বিস্তৃত উদ্বেগকে দেখা হয়নি।
পাম তেলের চাষকে বাধা দেওয়ার কারণে, দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা প্রভাবিত হবে বলে ইন্দোনেশিয়া দাবি করেছে। সেইসঙ্গে এয়ারবাস ইন্ডাস্ট্রি থেকে ২৫০টি বিমান কেনার পরিকল্পনাও করছে বলে জানিয়েছে সেদেশের সরকার ।
২০১৭-১৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৭.৮ মিলিয়ন টন পাম তেল আমদানি করেছিল যার ৫১ শতাংশ বায়োডিজেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই আমদানির ৮৭ শতাংশ নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইতালি এবং স্পেনের মতো দেশে ব্যবহার করা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে জৈব জ্বালানি বায়োডিজেল উৎপাদনে রেপেসিড তেলের অবদান সর্বাধিক ৫৫ শতাংশ তুলনায় পাম তেলের মাত্র ৩৫ শতাংশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের আইনটি নিয়ে কোন আপত্তি জানানোর ১২ মে পর্যন্ত সময় আছে, অন্যথায় ১২মার্চ এর ঘোষণাটি আইনে পরিণত হবে।
বায়োডিজেলের জন্য উদ্ভিজ্জ তেলের মধ্যে পাম তেল দামে সস্তা উত্স হলেও, ইউরোপের রেপসিড উত্পাদকদের কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত বলে অনেকে সন্দেহ করছেন।
ভারতের কাছে এই বিষয়টি দুভাবে আঘাত করবে। প্রথমত ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানি কমানোর কারনে দাম কমবে যা বেশি করে ভারতে পাম তেলের আমদানিতে উত্সাহ যোগাবে। এমনিতে ভারত দেশের মোট ভোজ্য তেলের চাহিদার ৬০ শতাংশ যা বছরে প্রায় ১৫ মিলিয়ন টন পাম তেল আমদানি করে।
আসিয়ান চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা পাম তেলের উপর ভারত বেশী আমদানী শুল্ক চাপাতেও পারবে না।
ফলস্বরূপ, ভারতকে ভোজ্য তেল আমদানির জন্য ৬০,০০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করতে হবে। তাই আমদানি বাড়ার অর্থ দেশের সঞ্চিত ডলারের বেশি খরচ। দেশের অর্থনীতি দুর্বল হবে।
দ্বিতীয়ত তেল আমদানি বৃদ্ধির ফলে ভারতীয় তৈলবীজ চাষীরা সঠিক দামও পাবে না। তাদের আয় কমবে, স্বল্পমেয়াদিতে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং দীর্ঘমেয়াদীতে দেশের ভোজ্য তেল শিল্পগুলি প্রভাবিত হবে।
দেশের নীতিনির্ধারকরা ভারতীয় কৃষক এবং অর্থনীতির কথা ভেবে ন্যায্য সিদ্ধান্ত নেয় কিনা তা ভবিষ্যতে দেখার বিষয়, কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবের ফলে প্রভাবিত দেশগুলি ত্রাণের জন্য অন্য দেশের বাজারগুলির দিকে তাকাবে।