পর্ব ৩
মনে করে যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘােড়ার পরে
টগবগিয়ে তােমার পাশে পাশে….
পাল্কী বা শিবিকা…তার ধরন গড়ন অনুসারে নানা নাম ছিল। ক্ষেত্র বিশেষে চেহারার কিছু রদবদল হতো। সেসব পাল্কী বা শিবিকা এবং সমগোত্রীয় যানগুলি নিয়ে আমি প্রথম পর্বে আলোচনা করেছি। যেমন – দোল, চতুর্দোল, অষ্টদোল, দ্বাদশদোল, ডুলি ইত্যাদি। এছাড়াও ছিল ডাক , মিয়ান্না বা মহনা। এই মিয়ান্না বা মহনা পাল্কী সম্পর্কে আমরা উইলিয়াম বেইলি নামক এক শিল্পীর লেখা থেকে জানতে পারি।
” সলভিন্স নামের একজন ফ্লেমিশ শিল্পী ব্রুশেলস থেকে কলকাতায় এসেছে বছর চারেক আগে। প্রচুর টাকা পয়সা রোজগার করেছে অল্প দিনের মধ্যে । কোচ মেকার স্টুয়ার্টদের কারখানায় পাল্কীর গায়ে নকশা এঁকে তার রোজগারের পরিমাণটা বেশি। অবশ্য সেসব পাল্কী সাধারণের ব্যবহারের জন্য নয় ।রাজারাজড়ার পাল্কী। তার মধ্যে দুটো খবর আমি জানি যা তৈরি করিয়েছিল লর্ড কর্নওয়ালিস মহীশূরের রাজার জন্য। যার এক একটার দাম ছিল ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। সেই পাল্কী সাজিয়েছিল সোনার রং এর উপর অন্য রং-এর নকশায় । এতে তার সুনাম ছড়িয়ে ছিল খুবই। তুমি অবাক হয়ে যাবে, এইসব পাল্কীর অদ্ভুত কারিগরি দেখলে । নানান ধাতুতে তৈরি ।সেগুলো আবার রুপো দিয়ে বাঁধানো । কোনো কোনোটা আবার পুরোটাই নিরেট রুপো দিয়ে তৈরি। ভিতরের লাইনিং ভেলভেটের । তার ওপর সোনারুপো দিয়ে কাজ করা ঝালর । তাঞ্জোরের মহারাজকুমারের জন্য স্টুয়ার্ড কম্পানি অল্প ক’দিন আগেই বানিয়েছে দুটি পালকি, যার প্রতিটির দাম দশ হাজার টাকার মতো। এগুলোর নাম #মহনা বা মিয়ান্না পাল্কী। ভিতরে থাকে শুয়ে যাওয়ার বিছানা-বালিশ পর্যন্ত।”
পাল্কীর এমন ধারা রমরমা থাকায় পাল্কী নিৰ্মাণ এবং তাকে চিত্রিত করার ব্যবসাও বেশ জমে উঠেছিল। যে কাজে দেশীয় মানুষদের সঙ্গে পাল্লা দিতে ঢুকেছিল বিদেশী শিল্পীরাও । ইংল্যান্ডের বেশ কিছু নামী শিল্পী পাল্কীতে ছবি এঁকে পয়সা রোজগার করত।
তাঞ্জাম পাল্কী ব্যবহার করত সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষজন। তাঞ্জাম পাল্কী দেখতে অনেকটা চওড়া চেয়ারের মতো হতো এবং মুক্ত অর্থাৎ খোলা হতো। ডাক পাল্কীতে মানুষও যেত , ডাকও যেত। তাই অনেকে একে পাল্কী ডাক বলত। এসব পাল্কীর সঙ্গে বেহারা , চৌকিদার ছাড়াও থাকত বঙ্গি বরদার আর মশালচি। বঙ্গি বরদারদের কাজ মাল বওয়া। মশালচির কাজ অন্ধকারে আলো দেখানো।, মশাল জ্বালিয়ে। ডাক পাল্কী রাতেও চলত। না হলে , সকালে ডাক পৌঁছবে কেমনে? বা জরুরি কাজ সম্পন্ন হবে কি করে ?
ডাক পাল্কীর জন্য থাকত রাতে চটি বা সরাই খানার ব্যবস্থা কয়েক মাইল ছাড়া ছাড়া। সেখানেই যাত্রীদের খাওয়া থাকা বিশ্রাম । চটি বা সরাইখানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বেহারাদের বদল ঘটত। আগের বেহারারা ওই চটি বা সরাই খানায় থেকে পরের পাল্কীর জন্য অপেক্ষা করত। আর সরাই খানার অপেক্ষারত বেহারারা আসা পাল্কী নিয়ে আমার গন্তব্যে পাড়ি দিত। পথের ধারে ধারে এক ক্রোশ অন্তর অন্তর পুলিশ চৌকি থাকত , চুরি ডাকাতি আটকাতে। তবে শেষ রক্ষা হতো না বুঝি।
১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে ,ডাক পাল্কীর ভাড়ার হিসাব কলকাতা থেকে পাটনা ছিল ৪০০ সিক্কা টাকা।কলকাতা থেকে কাশী ছিল ৫০০ সিক্কা টাকা। এছাড়াও অতিরিক্ত আরো কোথাও যেতে হলে মাইল পিছু খরচ পড়ত এক টাকা দুই আনা। মাইলের পর মাইল হুম হুনা হুম হুনা স্বরে ঘর্মাক্ত দেহে ছুটে চলত পাল্কী।
ডুলির ছিল প্রধানত গ্রামাঞ্চলে। অনেকে ভাবতেন ডুলি কলকাতার আভিজাত্যে কখনো নিজেকে উপস্থিত করে নি। কিন্তু কলকাতাতেও ডুলি চলত। সে প্রমাণ মেলে কয়েকটি পদ্যে । কিভাবে একটু বলি –
কলকাতার আদি যুগের কোম্পানির আমলে প্রথম কালা জমিদার ছিল নন্দরাম সেন। কালা জমিদারের কাজ ছিল কোম্পানির হয়ে খাজনা আদায় করা। একবার খুব জল কষ্ট দেখা দেয় । সেই সময় ,এহেন নন্দরাম সেনকে তার মা হুকুম করেন যে, মানুষের জলকষ্ট নিবারণের জন্য এক বছরের মধ্যে এগারোটা পুকুর খুঁড়তে। সেই আদেশ পেয়ে নন্দরাম বেরয় প্রচণ্ড জলকষ্টের স্থান গুলি নির্ণয় করতে। তো সেই ঘটনা নন্দরামের জীবনীতে পদ্যআকারে লেখা হয়েছে। সেখানে এই ডুলির উল্লেখ আছে ।
গাড়ি ঘোড়া নাহি ছিল , ডুলি মাত্র সার
বহিত ধনাঢ্য লোকে দেশস্থ কাহার।
ঘোড়ার গাড়ি বা প্রাচীন রথ কোনো দিনই পাল্কী বা শিবিকা, দোল, চতুর্দোল, অষ্টদোল ইত্যাদির আভিজাত্য, মহিমাকে ম্লান করতে পারে নি মোটেই। তো একটা সময় চতুর্দোলা , অষ্টদোলা কলকাতার রাস্তায় চলত স্বমহিমায়। চার খার বেহারা কাঁধে চতুর্দোলা। আট কাহার বেহারা কাঁধে অষ্টদোলা। বিয়ের দিন বর কনের জন্য উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত গৃহে বরাদ্দ থাকত চতুর্দোলা। মহেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচারনায় কলকাতার চতুর্দোলা চতুর্দোলা চাপা বর কনের কথা জানা যায় –
“বর যেমন চতুর্দোলা বা অন্যবিধ যান করিয়া আসিয়াছে সেইভাবে চলিল, কন্যা পিছু পিছু চলিল। চতুর্দোলায় ঘেরাটোপ থাকায় গরম হইত। এইজন্য ঘেরাটোপ একটু তুলে দুপাশে দুজন ঝি পাখার বাতাস করিতে করিতে যাইত।”
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কলকাতার ইংরেজবাবুরা পাল্কী চেপে আয়েশ মিটিয়েছে পুরোদস্তুর। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাক্ষিণ্যে অথবা নাম ভাঙিয়ে , কিংবা নিছক বিলিতি বা বিদেশী হবার কারণেই রীতি মতো সবাই পাল্কী চেপে বাবুগিরি করত। হাতে থাকতো উড়াবার মতো যথেষ্ট অর্থ। সেসব অর্থ মাইনে বা সৎ ভাবে রোজগারের ছিল না। সবই ছিল উপরি রোজগার। কোম্পানিকে লিকিয়ে ঠকিয়ে সে সময় ছিল চোরাই ব্যবসার রমরমা। বড়া সাহেবদের জন্য ছিল পোষা পাল্কী আর ছোটা সাহেবদের সঙ্গে ছিল ভাড়া পাল্কী।
এসব দুনম্বরি খবর গিয়ে পৌঁছল সাগরপারে। সব কিছুর উপর শাসন হবে হবে করে আর হয় না । শেষে একদিন হুকুম জারি হল – কোম্পানির রাইটার অর্থাৎ কেরানিরা ঘোড়া আর পাল্কীর জন্য পয়সা খরচ করতে পারবে না। সে তো কেরানিদের মাথায় হাত। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল। কি সব হুকুমনামা ? একে এই গরমের দেশে পড়ে আছে …তায় মাথায় রোদ , পায়ের তলায় জল নিয়ে অফিস করা? ফলে , এবার ইংরেজ কর্মচারীরা করল ধর্মঘট। একজোট হয়ে চলল কর্তৃপক্ষের দরবারে। আবেদন করল – বছরে অন্তত দুটো সময় যেন তাদের পাল্কী ব্যাবহার করতে দেওয়া হয়। এক ― যখন আকাশে জ্বলন্ত সূর্য , বাতাসে আগুনের ছাট, গাছপালা আগুনে পুড়ে ধুলোয় স্নান করবে, দিন যাপন করতে পারবে না। অর্থাৎ , এক কথায় বলতে গেলে গ্রীষ্মকাল। এবার ঠান্ডার দেশের মানুষদের কাছে তো এই দেশটার সবটাই গ্রীষ্ম কাল। যদিও একসময় মাঘের শীতে বাঘে পালাত। তবুও এসব ওই ইংরেজদের কাছে কিছু ছিল না। দুই – যখন আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বজ্রপাত , ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়বে, পথঘাট পুকুর নদী সব এক হয়ে যাবে তখন। অর্থাৎ, বর্ষাকাল।
কর্তৃপক্ষ চালাকি বুঝতে পেরে সরাসরি না মঞ্জুর করে দিল সেসব আবেদন । এর চার বছর পরে কোম্পানি জারি করল আরো কঠিন হুকুম। যেসব রাজ কর্মচারীরা পাল্কী বা ঘোড়া রাখবে তাদের বরখাস্ত করা হবে চাকরি থেকে। তবে, কিনা কোম্পানির লোক তো কেবলমাত্র বিদেশী ছিল না । ছিল দেশীয় মানুষজনও। তারাও ভারী বিপদে পড়ল।
ঝালরদার পাল্কী চড়তে চাইলে রাজার মুখের হ্যাঁ দরকার ছিল । কোম্পানি আবার কাউকে সম্মানিত করতে চাইলে ঝালরদার পাল্কী উপহার দিত। সেটা ব্যবহার করার জন্য অনুমতিও। এটা একটা প্রথা হয়ে উঠল। কলকাতায় ঝালরদার পাল্কী চড়তেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব ।
একসময় সনাতন পাল্কী সব কিছু ছিল। তারপর এল ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু পাল্কীর দিন শেষ হয় নি। তবে কিনা, ঘোড়ার চেয়ে মানুষের দাম গিয়েছিল কমে। যেকোনো পাল্কী বেহারার মজুরি একঘন্টা হিসাবে বা সারাদিনের ঘোড়ার ভাড়ার চেয়ে ছিল ঢের কম। পাল্কী বেহারার মজুরি সারাদিনের জন্য ছিল চার আনা কিন্তু ঘোড়ার ভাড়া ছিল ৫ টাকা। মানুষের কোনো দাম ই যেন ছিল না।
কবির বাল্যকালে রচিত “ছোটবেলা” -তে নিজের জন্মস্থান সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়ছর করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাঁড়-বের করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম , না ছিল বাস , না ছিল মোটরগাড়ি । তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না , রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবতে চিবতে , কেউ বা পালকি চড়ে কেউ বা ভাগের গাড়িতে।’
পাল্কী নিয়ে ইতিহাস অন্বেষণ করলে পাওয়া যাবে নানান কাহিনী। সে নাহয় পরের পর্বে বলব।
#ক্রমশঃ
@দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত )
তথ্যঃ ১ ) প্রাচীন শিল্প পরিচয়
২) কলিকাতার কাহিনী
৩) পালকি থেকে পাতাল রেল
৪) এক যে ছিল কলকাতা