পর্ব ২
কুকুর গুলো
শুঁকছে ধূলো,
ধুঁকছে কেহ
ক্লান্ত দেহ।
গঙ্গা ফড়িং
লাফিয়ে চলে;
বাঁধের দিকে
সূর্য্য ঢলে।
পাল্কী চলে রে….
প্রাচীন যান শিবিকা বা পাল্কীর কৌলিন্য ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অভিজাত থেকে নামী, মহারাজা হতে সরকারী কর্মী সকলের কাছে পাল্কী একটি অভিজাত বিষয়বস্তু হয়ে উঠছিল। বড়লোকের হাতি পোষা এবং চার কি ছয় কাহার নিয়ে পাল্কীর খরচ চালানো এবং পাল্কী রক্ষার জন্য খান কতক জোয়ান পালোয়ান লাঠিয়াল রাখা একইব্যাপার ছিল। তাছাড়া পূর্ব পর্বেই বলেছি যে, নানা দুর্গম স্থানে একমাত্র যান ছিল পাল্কী কি ডুলি। ফলে, সাধারণ মানুষেরও পাল্কী ব্যাবহারের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কারণ, কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বেড়ে চলছিল কলকাতার ব্যবসা বাণিজ্য এবং বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত। এখন যেমন কলকাতা শহরের মোড়ে মোড়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে ,তখন অমন পাল্কীর স্ট্যান্ড থাকত।
আজকাল আমরা গাড়ি কিনি। কেউ কেউ তো তিন চারটে গাড়ি কেনে, ভিআইপিদের কথাটা নাহয় বাদই দিলাম। সে যুগের নিজের একখানা পাল্কীর মধ্যেই লুকিয়ে থাকত সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন। আঠারো শতক নাগাদ কলকাতায় পাল্কীর সংখ্যা ছিল বেশ কয়েকশ। এর মধ্যে ছিল কিছু নিজস্ব, ব্যক্তিগত মালিকানার এবং কিছু ভাড়ার। পূর্বে পর্বেই বলেছি , যে সাধারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনে পথ, দুর্গমতা এবং দূরত্ব অনুযায়ী পাল্কী ভাড়া করত।
সে সময় পাল্কীর ভাড়া হতো মাইলের হিসাবে। ভাড়া ছিল মাইল প্রতি তিন আনা করে। আর একটা পুরো দিনের ভাড়া ছিল দেড় টাকার মতো।
যাদের নিজস্ব পাল্কী এবং মাইনে করা কাহার – বেহারা থাকত তাদের মাইনে কেমন হতো ? তখনকার পাল্কী বেহারাদের মাস মাইনে বাঁধা ছিল – মাসে চার টাকা বা পাঁচ টাকা। প্রতি পাল্কী বহন করতে চার বা ছয় কাহার – বেহারা লাগতো। যাদের নিজস্ব পাল্কী ছিল ,তাদের তারমানে মাসিক খরচ হতো ওই পঁচিশ টাকার মতো। সে যুগে পঁচিশ টাকা মানে বিশাল ব্যাপার ছিল।
তো পাল্কীর এমন চাহিদা দেখে বেহারারাও বাড়াবাড়ি শুরু করল। যেমন খুশি ভাড়া চাইতে লাগল , সব জায়গায় যেতেও চাইত না যদি না মর্জি হতো। ফলে, সাধারণ মানুষ বেশ সমস্যায় পড়ল। ফলে, নগরপাল একদিন হুকুম জারি করল , প্রত্যেক পাল্কী বেহারাদের লাইসেন্স করাতে হবে বাহক হিসাবে। হাতে পড়তে হবে নম্বর দেওয়া ব্যাজ । যাতায়াতের মাশুল ঠিক হবে ঘন্টার উপর।
ব্যাস…. এসব হুকুম শুনে হুহুম না হুম না বন্ধ হয়ে গেল পুরো শহর জুড়ে। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ , কলকাতায় হল প্রথম ধর্মঘট। বেহারারা নগরপালের হুকুমের বিরুদ্ধে পাল্কী বহন করাই বন্ধ করে দিল। সেসময় , সব বেয়ারাই ছিল সনাতনী বাগদি সম্প্রদায়ের এবং উড়িষ্যার মানুষজন। তারা অভিযোগ করল , হাতে ওইসব ব্যাজ , তাবিজ বাঁধলে জাত যাবে। সমাজের মানুষের কাছে অপাংক্তেয় হবে ।তাছাড়া তারা একেবারেই রাজি ছিল না ব্যাজের জন্য দাম দিতে । কলকাতায় তখন বেহারাদের সংখ্যা ছিল প্রায় এগারো হাজার কয়েকশো। তারা সবাই একাট্টা হয়ে গিয়েছিল। কোম্পানির হুকুম মানতে নারাজ বেহারাদের ময়দানে সমাবেশ হয়। দলবেঁধে সেই সমাবেশে যোগদান করেছিল সমস্ত বেহারারা । তারপর তারা চলল ম্যাজিস্ট্রেটের দরবারে।
পাল্কী বেহারাদের প্রতিবাদে ম্যাজিস্ট্রেট কিছুটা নরম হল। ফলে, ম্যাজিস্ট্রেট জানাল, ঠিক আছে ব্যাজের দাম মুকুব করে দেবে। বেহারারা বেরিয়ে এলো । লোকে ভাবল ধর্মঘট বুঝি মিটলো। কিন্তু তার কোথায় কি হলো ? বেহারারা লালবাজারে সুপ্রিম কোর্টের সামনে জমায়েত শুরু করে হইচই করতে লাগলো । পরের দিন সকাল থেকে শহরে একজন বেহারারও টিকির। দেখা নেই। কলকাতার রাস্তায় পাল্কী বেহারাদের বিচিত্র কণ্ঠসঙ্গীত পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। এভাবে বেশি দিন চললে কোম্পানির অফিস আদালতের সব কাজ বন্ধ হয়ে যাবে আর সরকার মাছি মারবে।
ফলে , সংবাদমাধ্যমে হইচই শুরু হল । একদল নিল সরকারের পক্ষ। একদল নিল বেহারাদের পক্ষ। সময়ের অনুপাতে মজুরির পক্ষে যাদের সায় নেই তাদের যুক্তি ছিল এরকম – ধরা যাক , একজন কালীঘাটে যাচ্ছেন ।যেতে হয়ত মেরেকেটে সময় লাগবে এক ঘন্টা। মজুরি হিসাবে বেহারারা প্রত্যেকে পেত দুই আনা করে । কিন্তু এই এক ঘন্টার জন্য তাদের ক্ষয় করতে হয় সারাদিনের শ্রম ও শক্তি । আরেক রকম যুক্তি দেয়া হল – ঘড়ি থাকে যাত্রীদের পকেটে, বেহারাদের কাছে নয় । এখন তো কোন বাবুদের ঘন্টা দু আড়াই পাল্কী চেপে অনায়াসে বেহারাদের ঠকাতে পারে এক ঘন্টার মজুরি দিয়ে । তাহলে সরকারি খরচে প্রত্যেক বেহারাকে উপহার দেওয়া হোক একটি করে ঘড়ি।
কাগজপত্র যতই যা লিখুক। ধর্মঘট থামার নামগন্ধ এতোটুকু ছিলনা। বিপদ বেশি যাদের তাদের নিজস্ব পাল্কী। তাদের মাস মাইনে করা বেহারারাও অন্যান্য কাহার বেহারাদের দেখাদেখি যোগ দিয়েছিল ধর্মঘটে ।বেশ কিছুদিন এইভাবে চলল। তারপর দেখা গেল, বিহার থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে রাউনি বেহারারা চলে আসছে কলকাতায়। তারা বাগদি ও ওড়িয়া বেহারাদের না ছোঁয়া পালকি মহানন্দে তুলে নিচ্ছে নিজের কাঁধেই । দেখতে দেখতে কলকাতা শহর আবার পাল্কীর হাঁকডাকে গমগমিয়ে উঠলো। একটা ঘুমন্ত শহর জেগে উঠলো।
এই ধর্মঘটের ফাঁকে ঘটে গিয়েছিল আরো এক অবাক করা ঘটনা সে সময় ব্রাউনলো সাহেব থাকত কলকাতার ইংরেজ পাড়ায় । তার ছিল নিজস্ব একটি পাল্কী। যেদিন থেকে ধর্মঘটে সূচনা ঘটল বেহারারা বেপাত্তা। ফলে, অফিস কামাই হল তিন দিন। ব্রাউনলো ঘরের মধ্যে বসে বসে অনেক কিছু ভাবল। চারদিনের দিন নিজের পাল্কী পায়ে জুড়ে দিল চারটি চাকা। তারপর আস্তাবল থেকে টেনে এনে নিজের ঘোড়াকে জুড়ে দিল পাল্কীর সঙ্গে । অমনি পাল্কী ছুটল টগবগিয়ে । ক্রমে সে গাড়ির ইংরেজিতে নাম দাঁড়ালো ব্রাউনবেরি। বাংলার নাম ,পাল্কী ঘোড়া । তবে এ বিষয়ে বেশি আলোচনা করতে চাই না কারণ, আমাদের দেশের সবথেকে প্রাচীন তথা আদিম যানের মধ্যে অন্যতম ছিল রথ। ঘোড়ায় টানা সেসব রথ বিভিন্ন ধরন হত । তার অন্যতম ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যও ছিল। সে রথ , ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা করব।
কলসওয়ার্দি নামের এক শিল্পী এই ধর্মঘটের সময়, মাকে পালকি সংক্রান্ত হাজারো তথ্য দিয়ে একটি চিঠি লিখেছিল । তার একটি অংশে ব্রাউনবেরির তৈরি এই পালকি গাড়ির কথা উল্লেখ করেছে সে। সেখানে আরও লিখেছিল –
ব্রাউনলোর বুদ্ধিটা মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল শহরে। যেন হয়ে উঠল, সর্বজনীন মহৌষধ। সেই ছোট্ট যানটির নামকরণ হয়ে গেল – ব্রাউনবেরি।ইতিহাস বলে , বাগদি ও ওড়িয়া বেহারাদের স্বাধীনতায় সেটাই হানল প্রথম আঘাত। রুজি রোজগারের ব্যাপারে দেউলিয়া হতে চলেছে বুঝতে পারার ফলে তাদের বাগে আনা কঠিন হলোনা আর। মিটিং হল। নির্ধারিত হল মজুরি। পাল্কী আর বেহারাদের গায়ে পড়ল সংখ্যার ছাপ, হাতে উঠল ব্যাজ। ফিরে এলে নিজেদের কাজে।
ভাড়া করা পাল্কী আর নিজস্ব পাল্কীর মধ্যে বেশ একটু তফাৎ থাকত। নিজস্ব পাল্কী তৈরি করা , তাকে নক্সা দিয়ে সাজানো খরচ বেশ একটু বেশিই পড়ত। আপন প্রতাপ , আভিজাত্য ইত্যাদি দেখানোর জন্য কিংখাবে মোড়া, সোনা বা রূপো বাঁধানো , গজদন্তের কারুকাজে পাল্কী সুসজ্জিত করা হতো। নিজস্ব পাল্কী বাহারের সঙ্গে আরামদায়কও হতো বেশ। ঝাকুনি লাগত কম। ভিতরে পাতা হতো গদি। পাশে রাখা থাকতো নরম বালিশ । সেগুলো সময় বিশেষে রেশম, পশমের আভিজাত্যে মুড়ে যেতো।
ভাড়ার পাল্কী হতো কম বাহারি হতো। পাল্কীর তলা বানানো হতো বেতের সাহায্যে। বাকিটা কাঠের। কোনো কোনো পাল্কী চামড়া দিয়ে মোড়া থাকতো। দুইপাশে লাগানো ডান্ডা কাঁধে চলত বেহারা।
বড় বড় মানী মানুষ বা রাজা মহারাজারা বাহারি ঝালর দেওয়া পাল্কী ব্যবহার করতেন। কলকাতা শহরের নামী দামী বড় মানুষদের বানানো পাল্কীর মূল্য পড়ত দুই থেকে তিন হাজার পর্যন্ত। যদিও এর থেকে দামী পাল্কীও ছিল সে কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। কোনো কোনো পাল্কীতে দরজা লাগানো থাকত।
সাধারণ ভাড়ার পাল্কী নির্মাণে খরচ অনেক কম পড়ত।এর মধ্যে আরামাদির ব্যবস্থা কিছুই থাকত না। পাল্কীগুলোর আকার ছোট বা বড় হতো মাঝে মাঝে। অর্থাৎ, সাধারণ লোকে চড়বে তাই মাপজোপ , আরামের কি দরকার ? এই পাল্কী চড়েই শহর কলকাতার এপাড়া ওপাড়া মানুষ কাজে কর্মে। যাতায়াত করত।
#ক্রমশঃ
@দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত )
তথ্যঃ ১ ) প্রাচীন শিল্প পরিচয়
২) কলিকাতার কাহিনী
৩) পালকি থেকে পাতাল রেল
৪) এক যে ছিল কলকাতা