পাক পাক পাকিস্তান, মুর্শিদাবাদ আর নেই হিন্দুস্তান

১৮৫৭ সালে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে যে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের ব্যারাক স্কোয়ার ছিল সেই মহাবিদ্রোহের সূতিকাগার। ১৮৫৭ সালের ২৬ জানুয়ারি, বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার থেকে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ প্রথমে ব্যারাকপুর, তারপর ধীরে ধীরে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যারাক স্কোয়ারের বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যারাকপুরে সিপাহি মঙ্গল পান্ডে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। লড়াইয়ের মাঠে কয়েকজন ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করে শেষে নিজেই নিজের রিভলভার থেকে নিজের বুকে গুলি করেন তিনি। প্যারেড গ্রাউন্ডে লুটিয়ে পড়েছিল তাঁর দেহ। ইংরেজরা আহত শরীরকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভারতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিবাদী মঙ্গল পান্ডেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন ১৮৫৭ সালের ৮ এপ্রিল।১৯০৬-এর ৩০ ডিসেম্বর, ঢাকায় ‘মুসলিম লিগ’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, লিয়াকত আলি খান, এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, হোসেন সোহরাওয়ার্দী, মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর মতো প্রথম সারির মুসলিম নেতৃবৃন্দ। মুর্শিদাবাদ ছিল প্রথম থেকেই মুসলিম অধ্যুষিত জেলা। ফলে এই জেলায় খুব সহজেই মুসলিম লিগের প্রভাব পড়ে। এই জেলার বেশকিছু সম্ভ্রান্ত মুসলিম ক্রমেই মুসলিম লিগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে আবদুল বারি, জনাব মুহাম্মদ আফাজউদ্দিন, মৌলবি আবদুল গণি, মাওলানা আবদুল মোমিন, সাখাওয়াত হোসেন আল-কাদরি প্রমুখ ছিলেন অন্যতম। এঁরা বিশেষ করে গোটা পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের ‘বিশেষ স্বার্থরক্ষা’র জন্য প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। জেলাজুড়ে এই নেতৃবৃন্দ মুসলিম লিগের আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে প্রথম থেকেই ছিলেন তৎপর। পরবর্তীতে এঁদের সঙ্গে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ’র পরিচয় হয় ও আলি জিন্নাহ’র উগ্র সমর্থক হয়ে ওঠেন এঁরা। এঁদের নেতৃত্বে ১৯৩৭-এর অক্টোবর মাসে ‘বহরমপুর কুমার হোস্টেল’ প্রাঙ্গণে মুসলিম লিগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং আলি জিন্নাহ। মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণ, ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা এসব বিষয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হয়।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের তীব্রতা ঝড়ের মতো আছড়ে পড়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে। এই বঙ্গভঙ্গের সময়কালেই মুর্শিদাবাদ জেলার বিশেষ করে কৃষ্ণনাথ কলেজকে কেন্দ্র করে বহরমপুর শহর আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই সময় কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন এডোয়ার্ড মনোমোহিনী হুইলার। মূলত তাঁর নির্ভয় আশ্রয়ছায়াতলে সেদিন কৃষ্ণনাথ কলেজের একদল ছাত্র দেশকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র, অনুশীলন সমিতির পুলিন দাস ও বহরমপুরের ভূপেশচন্দ্র নাগ। ১৯১০ সালে দীপান্তর থেকে ফিরে এসে ভুপেশ পুনরায় গুপ্ত সমিতির কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। অতুল কৃষ্ণ ঘোষ, সতীশ চক্রবর্তী, শিশির ঘোষ ছিলেন কৃষনাথ কলেজের ছাত্র, অধ্যাপক এবং বিপ্লবী বাঘা যতীনের প্রিয় শিষ্য।বাঘা যতীন সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ভারতে স্বাধীনতা লাভের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি জার্মানির সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখান থেকে প্রচুর অস্ত্র আনতে চেয়েছিলেন। জাহাজ ভর্তি অস্ত্র নামানোর ভার পড়েছিল কৃষ্ণনাথ কলেজের তরুণ ছাত্র অতুল ঘোষ, সতীশ চক্রবর্তী ও যোগেন্দ্রনাথ সরকারের উপর। বহরমপুর থেকে অস্ত্র যাওয়ার কথা ছিল রাজশাহীতে। অজয় নদের পুল ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্বও ছিল সতীশ চক্রবর্তীর উপর। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের কাছে গোপন সংবাদ পৌঁছে গেলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। কৃষ্ণনাথ কলেজের কয়েক শত ছাত্র সেই সময় ব্রিটিশ সরকারের হাতে প্রেপ্তার হন। ১৯১৫ সালে বালেশ্বরে এক অসম যুদ্ধে বিপ্লবী বাঘা যতীনের মৃত্যু হলে মুর্শিদাবাদে আরও কিছুদিন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চলেছিল। বিপ্লবী ধারার এই কাজটি সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিপ্লবী নলিনী বাগচী, সূর্যসেন প্রমুখ। ১৯১৬ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় সূর্য সেন অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে সূর্য সেন চট্টগ্রামে ফিরে যান ও সেখানে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।১৯২৩-এ ৩নং রেগুলেশন আইনে বন্দি সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সি জেল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলের ৭নং ঘরে এসেছিলেন। বর্তমানে এটি এখন মানসিক হাসপাতাল। এই বছরেই সুভাষচন্দ্র জেল থেকে ছাড়া পান। কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র, বহরমপুরের তরুণ যুবকরা সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে শহর পরিক্রমা করেছিলেন। এই সময় সুভাষচন্দ্র তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে জেলার তরুণ যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন সন্দেহ নেই।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বহরমপুর ও কান্দির মেয়েরা স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের কান্দিতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বাড়িতে প্রায় ৫০০ মহিলা ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ শুনিয়ে অরন্ধন করে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করেছিলেন। মুর্শিদাবাদ মহিলা সমিতির মধ্যে ‘মুর্শিদাবাদ মহিলা রাষ্ট্রীয় সমিতি’ ছিল উল্লেখযোগ্য মহিলা সমিতি। মণিমালা দেবী ও মৃণাল দেবী সমিতির কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। নেতাজি সুভাচন্দ্রের সঙ্গে মণিমালা দেবী ও মৃণাল দেবীর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ১৯৩৯-এর ৩১ জুলাই, সুভাষচন্দ্র মৃণাল দেবীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলায় মহিলা সমিতির কাজ প্রসারলাভ করিতেছে জানিয়া আমি সুখী হইয়াছি। নারীসমাজে জাতীয়তার বাণী প্রচার করা বিশেষ প্রয়োজন এবং সেই কাজের জন্য মহিলা সমিতির ও মহিলা কর্মীর বিশেষ আবশ্যকতা আছে…”।১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ৩ দিন ধরে তৎকালীন স্যার সিরিল রাডক্লিফের বাউন্ডারি কমিশনের সুপারিশ অনুসারে মুর্শিদাবাদ জেলা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল পাকিস্তানে৷ আর খুলনা জেলা হয়েছিল ভারতের অংশে। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট জেলার সদর শহর বহরমপুরের ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে পাকিস্তানের নামে প্রথম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পালিত হয়েছিল। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা সরকারিভাবে তুলেছিলেন সেই সময়ের মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক আইসিএস অফিসার আই. আর. খান। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কাজেম আলি মির্জা, সনৎ রাহা, নিতাই গুপ্ত, শ্যামাপদ ভট্টাচার্য প্রমুখ। বহরমপুরের খাগড়া এলাকার বাসিন্দা নব্বই ছুঁই ছুঁই ভবানী রায় জানান, সেই সময় শহরের প্রধান সরকারি দফতর ছাড়াও অনেকর বাড়ির ছাদে, আজকের জেলার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেশরী বালিকা বিদ্যালয়, লন্ডন মিশনারী স্কুল সর্বত্রই পত পত করে উড়ে চলেছিল পাকিস্তানের পতাকা। জেলা জুড়ে চাপা উত্তেজনার পরিবেশ। বাড়ির বাইরে ওই কটা দিন পা ফেলার যো ছিল না। ১৪ অগস্ট মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে যোগ হবার এই খবর বাতাসে বিদ্যুতের গতিতে ছাড়িয়ে পরে। রাতারাতি তৈরি হয়ে যায় পাকিস্তানের পতাকা। তার পরের দিন জেলা জুড়ে বেড়ায় বিভিন্ন স্থানে মিছিল। স্লোগান উঠে “পাক পাক পাকিস্তান, মুর্শিদাবাদ আর নেই হিন্দুস্থান৷”মুসলিম লীগের সমর্থনে লালবাগ ,ধুলিয়ান , বেলডাঙা ও জঙ্গিপুরের মত এলাকায় বহু মুসলমান ডঙ্কা বাজিয়ে লাঠি তলোয়ার খেলা করে তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ইংরেজদের ভারত ছাড়িয়ে স্বাধীনতার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বেশি খুশি হয়েছিলেন তারা।১৫ ই আগস্টের পর কিছু মুসলিম সম্প্রদায় স্লোগান তুলেছিল “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ” , তেমনি কুমার হোস্টেলের মালদার হিন্দু ছেলেরা জমিদারি এলাকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিল। দানি বাবু ও আইনজীবী মনি দুবে তাদের শান্ত করতে গেলে হোস্টেলের ছেলেরা তাদের তুলে নিয়ে যায়। তৎকানিন এস.ডি.ও শশাঙ্ক বাবু সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে এসে তাদের উদ্ধার করেন।

আকাশবাণীর খবর, তারপর সবটাই অন্ধকার আর ভয়ে মোড়া ,মুর্শিদাবাদ স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। তার ঠাঁই হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণার ফলে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে গোটা অঞ্চলে। এখানকার বাসিন্দারা ১৫ অগাস্টকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিক নেতা এবং নদীয়ার রাজপরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রতিবাদ নিয়ে হাজির হন কলকাতায় ব্রিটিশ প্রশাসনের দরবারে, এবং মাউন্টব্যাটেনের কানে খবর পৌঁছয়। তড়িঘড়ি মানচিত্র বদলানোর আদেশ দেন ভাইসরয়, যাতে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি ভারতেই থাকে, এবং মুসলমান অধ্যুষিত জেলা যায় পূর্ব পাকিস্তানে। এই প্রক্রিয়া শেষ হয় ১৭ অগাস্ট গভীর রাতে।
১৬ ই মে ১৯৪৬ বৃটিশ পার্লামেন্ট–এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ জুলাই ১৯৪৬ গঠিত হল ভারতের সংবিধান সভা । প্রথম সভা বসল ৯ ই ডিসেম্বর ১৯৪৬,এরপর ৩ রা জুন ১৯৪৭ বৃটিশ পার্লামেন্ট ভারতের দেশভাগ মেনে নিল ।১৮ ই জুলাই ১৯৪৭ বৃটিশ পার্লামেন্ট ১৯৩৫ সালের Government of India Act, 1935 কে সংশোধন করে Indian Independence Act, 1947 পাশ করল।এই Indian Independence Act, 1947 এর বলে ১৫ ই আগস্ট ১৯৪৭ দিনটিকে ভারত ও পাকিস্থান দুটি পৃথক দেশ গঠনের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দিল । ১৯০৫ সালে যা ছিল ‘বঙ্গভঙ্গ’এর মহড়া এই Act এ তা কারযকরী করা হল ‘পূর্ববঙ্গ’ ও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামে দুটি প্রদেশ তৈরির মধ্য দিয়ে । ১৯০৫ সালে আঁকা মানচিত্রকে ভিত্তি করে একটি মানচিত্র এর সঙ্গে যুক্ত করা হল ।এই মানচিত্র অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দিনাজপুর, মালদহ, যশোহর এবং বনগাঁ থানাকে ‘পূর্ববঙ্গ’এর মধ্যে ধরা হয় । যদিও বলা হয় Bengal Boundary Commission এর পেশ করা রিপোর্টের উপরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
৩০ শে জুন ১৯৪৭ গভর্নর জেনারেলের ঘোষনা(Ref. No.D50/7/47R) মোতাবেক সিরিল র‍্যাডক্লিফ কে চেয়ারম্যান করে পাঁচ জনের Bengal Boundary Commission গঠিত হয় । ৩০ শে জুন থেকে ১৪ ই আগস্ট ১৯৪৭ মাত্র ৪৫ দিন হলেও প্রকৃত পক্ষে ১৮ ই জুলাই ১৯৪৭ থেকে ১২ ই আগস্ট ১৯৪৭ মোট ২৫ দিন কমিশন হাতে পায় । আর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৬ থেকে ১৯ এবং ২১ থেকে ২৪ শে জুলাই ১৯৪৭ মাত্র ৮ দিন পাওয়া যায়। ১২ ই আগস্ট ১৯৪৭ সিরিল র‍্যাডক্লিফ রিপোর্ট পেশ করেন। ১৪/১৫ ই আগস্ট ১৯৪৭ মাঝরাতে যথারীতি দ্বি-খন্ডিত স্বাধীনতা ঘোষিত হল ।১৯০৫ সালের আঁকা মানচিত্রকে রিপোর্টে পেশ করা হয়েছে বলে সুকৌশলে প্রচার করে মুসলিম লীগ ময়দানে নেমে পড়ে ।

                  নদীয়ার ৯০ উর্ধ্ব কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথায় – ঐ সময় কে কার বাড়ি দখল করবে, কে কোন হিন্দু বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করবে, কোন্ সিনেমা হল দখল করা হবে মুসলিম লীগের কর্মীরা হিন্দু এলাকায় এসে প্রকাশ্যে তা বলাবলি করতে থাকে। এলাকার পরিচিত মুসলিম ব্যাক্তিরাও সে সময় বিপক্ষে চলে যায়, এর ফলে হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। হিন্দু জনবহুল এলাকা পূর্ব পাকিস্থানে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর মহারানী জ্যোতির্ময়ী দেবীর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনে সামিল হন কাশিম বাজারের মহারাজা শ্রী সচন্দ্র নন্দী, জিয়াগঞ্জের জমিদার সুরেন্দ্র সিংহ নিহালিয়া, মুর্শিদাবাদের নবাব বংশীয় ওয়াসেদ আলী মির্জা, মুর্শিদাবাদের রানী স্বর্ণময়ী দেবী, কবু লাহিড়ী, সাবিত্রী দেবী, প্রমথ নাথ সুকুল, তারক দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্নাথ মজুমদার, রানাঘাটের ইলা পালচৌধুরী, এনাদের নেতৃত্বে জায়গায় জায়গায় সাধারণ মানুষের বিশাল আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। মালদা থেকে অতিরিক্ত জেলাশাসক মঙ্গল কুমার আচার্য ছুটে আসেন কলকাতায়। পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন মহল থেকে চিঠি ও ট্রামকল ঘন ঘন পৌঁছতে থাকে দিল্লীতে। রাজধানীতেও এই আন্দোলন শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঁচ জেলা কেঁড়ে নেওয়ায় প্রবল বিরোধে নেমে পড়েন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শশাঙ্ক শেখর সান্যাল, পন্ডিত লক্ষীকান্ত মৈত্র এমনকি বি.আর আম্বেদকরও নেমে পড়েন প্রতিবাদে। মহারানী জ্যোতির্ময়ী দেবী মহারাজ সৌরিশ চন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে।আন্দোলনের তীব্রতা দেখে ভয় পেয়ে যান লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন স্বাধীনতা ঘোষণার পরেও আন্দোলন কেন হচ্ছে ? মাউন্টব্যাটেন আশঙ্কা প্রকাশ করেন - যদি এই আন্দোলন চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়ে দেশভাগ আটকে যায়, যদি ভারত পাকিস্থান ভাগ না হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় তবে তা ইংল্যান্ডের কাছে ভীষণ চাপের বিষয়। তড়িঘড়ি তিনি ডক্লিফকে নির্দেশ দেন বাউন্ডারি ঠিক করতে।ভারত পাকিস্তানের সীমানা নির্ণয় করতে পাঁচ সদস্যের বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হয়েছিলো, যার সভাপতি ছিলেন স্যার র্যা ডক্লিফ। ভারত ভাগ করার মাত্র দু মাস আগে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন। ভারতের জনগণ, ধর্মাবেগ, আঞ্চলিকতা সম্পর্কে তিনি তেমন ভাবে কিছুই জানতেন না। তার উপর মাউন্টব্যাটেন এবং ইংরেজদের ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার ব্যাপার ছিলো। টাইম প্রেসারের চাপে পড়তে হয় র্যা ডক্লিফ কে। বলাহয় তাই তিনি ভুলবশত এপার বাংলার পাঁচটি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্থানে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু অপরদিকে বেশ কয়েকজন গবেষক জানাচ্ছেন - এটি ভুল ছিল না, এটি ছিল গভীর চক্রান্ত। পাকিস্তানের সীমানা বাড়াতে র্যা ডক্লিফ কে চাপ দিচ্ছিলেন বেশ কয়েকজন নেতা এবং বেশ কিছু শিল্প সংস্থার মালিকরা।অবশেষে সাঁড়াশি চাপের ফলে সংশোধিত হলো র্যা ডক্লিফ  লাইন। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সিদ্ধান্ত অনুসারে বাংলার প্রথম গভর্নর চক্রবর্তী রাজা গোপালাচার্যয়ের তৎপরতায় আগের সমস্ত নোটিশ বাতিল করে জারি করা হয় নতুন ম্যাপের নোটিশ। সেই মতো অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট সারাদিন ধরে বারবার প্রচার হতে থাকে নদীয়া সহ পাঁচটি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভারতের মধ্যেই থাকবে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে কামান দেগে সারা রাত আলোর উৎসব অনুষ্ঠিত হলো। ধীরে ধীরে পাকিস্থানি বাহিনী সরতে থাকে পূর্ব দিকে এবং পাঁচ জেলার নতুন অন্তর্ভুক্ত এলাকার দখল নিতে থাকে ভারতীয় বাহিনী। ১৮ ই আগস্ট ভারতীয় পতাকা প্রথম ওঠে বনগাঁ প্রশাসনিক ভবনে এবং কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে পাকিস্থানের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করা হয়, তারপর শান্তিপুর। মালদার অতিরিক্ত জেলাশাসক মঙ্গল কুমার আচার্য কলকাতা থেকে মালদায় ফিরে গিয়ে পাকিস্থানি পতাকা নামিয়ে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মাজদিয়ার সাধারণ জনগণ দলবদ্ধ হয়ে শেখ আবুর তোলা পাকিস্থানি পতাকা তাকে দিয়েই নামিয়ে ফেলে  উত্তোলন করা হয় ভারতীয় পতাকা। সেই সঙ্গে পায়েসের অনুষ্ঠান করা হয়। ১৮ ই আগস্ট মুর্শিদাবাদের বহরমপুর সহ পাঁচ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্থানি পতাকা নামিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে উত্তোলন করা হয় ভারতীয় পতাকা। কৃষ্ণনগর, রানাঘাটের রাস্তায় বিশাল বিজয় মিছিল শুরু হয়। 

এই ইতিহাস দীর্ঘদিন ধরে ধামাচাপা হয়ে পড়েথাকে। ১৯৯১ সালে নদীয়া জেলার মাজদিয়া শিব নিবাস গ্রামের অঞ্জন সুকুল তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে ১৫ই আগস্ট ছাড়াও ১৮ই আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস প্রথমবার উদযাপন করেন। ঐদিন তিনি চূর্ণী নদীতে নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা রেখেছিলেন। রানাঘাট পৌরসভার প্রাক্তন পৌরকর্তা জানিয়েছেন প্রতি বছর ১৮ই আগস্ট তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিনটি পালন করেন। এক প্রতিনিধি জানিয়েছেন বনগাঁ বার অ্যাসোসিয়েশনে প্রতি বছর ১৮ ই আগস্ট দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়। মাজদিয়ার এক প্রবীণ নাগরিক জানিয়েছেন ১৯৪৭ এর ১৮ ই আগস্ট ভিটেমাটি হারানোর চক্রান্তের হাত থেকে ঈশ্বরের কৃপায় বেঁচে গেছি।এই হল মুর্শিদাবাদ এর স্বাধীনতা ও ভারতভুক্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

-সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.