তাঁর চিত্রকলার পাঠ শরু হয় তৎকালীন আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে। তার কাছে শেখেন ড্রয়িং, প্যাস্টেল ও জলরং। পরবর্তীতে শিল্পী সি এল পামারের কাছে লাইফ স্টাডি, তেল রঙ ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেন। ভারতীয় রীতিতে তার আকা প্রথম চিত্রাবলী ‘কৃষ্ণলীলা-সংক্রান্ত’। এই রীতি অনুসারী চিত্রশিল্পের তিনি নব জন্মদাতা। ১৮৯৫ সালের দিকে অবনীন্দ্রনাথ প্রথম নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে আকলেন ‘শুক্লাভিসার’- রাধার ছবি মাঝে রেখে উৎকীর্ন কবি গোবিন্দ দাসের পংক্তিমালা। ১৯০০ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলে কৃষ্ণলীলা সিরিজ প্রদর্শিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে লর্ড কার্জনের দিল্লী দরবারে আরো দুটি প্রদর্শনী এবং লন্ডনের ‘স্টুডিও’ পত্রিকায় চিত্রালোচনা প্রকাশিত হলে অবনীন্দ্রনাথের ছবি শিল্পরসিকদের মাঝে আগ্রহের জন্ম দেয়। তার ‘শাজাহানের অন্তিমকাল’ মোঘল মিনিয়েচারের এক লোকায়ত নিরীক্ষা, যেখানে শাজাহানের অন্তিম অবস্থা করুন রসের। ক্রমান্বয়ে আকলেন ‘বুদ্ধ ও সুজাতা’(১৯০১), কালীদাসের ঋতুসংহার বিষয়ক চিত্রকলা(১৯০১), ‘চতুর্ভূজা ভারতমাতা’(১৯০৫), ‘কচদেবযানি’(১৯০৬), ‘শেষযাত্রা’(১৯১৪)। জাপানী প্রভাবে অবনীন্দ্রনাথ অঙ্কন করেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘ওমর খৈয়াম’(১৯৩০) চিত্রাবলী। চিত্রসাধনের শেষ পর্যায়ে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পচিন্তা নতুন মাত্রা লাভ করে। গড়ে তোলেন ‘কুটুম কাটাম’ – আকার নিষ্ঠ এক বিমূর্ত রূপসৃষ্টি।
সাহিত্যসাধনা
প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা আনুমানিক ছাব্বিশ। গল্প কবিতা চিঠিপত্র শিল্প আলোচনা যাত্রাপালা পুথি স্মৃতিকথা সব মিলিয়ে প্রকাশিত রচনা সংখ্যা প্রায় তিনশ সত্তরটি। পিত্রব্য রবিন্দ্রনাথ থাকুরের অনুপ্রেরণায় লেখালেখির সূত্রপাত। কবিগুরু ‘বাল্য গ্রন্থাবলী’র কর্মসুচী শুরুর প্রাক্কালে বলেছিলেন,- “ছোটদের পড়বার মত বই বাংলাভাষায় বিশেষ নেই। এ অভাব আমাদের ঘোচাতে হবে। তুমি লেখ।” ‘বাল্য গ্রন্থাবলী’র প্রথম ও তৃতীয় বই অবনীন্দ্রনাথের শকুন্তলা ও ক্ষীরেরপুতুল। অবনীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘নবযুগ’পত্রে ১৩১১ শ্রাবনে, ‘নবদুর্ব্বা’ নামে। রাণী বাগীশ্বরী অধ্যাপক থাকার সময় ১৯২১-১৯২৯ সালের মধ্যে যে ঊনত্রিশটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪১ সালে ‘বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় লিখিত ভারতীয় নন্দন তত্বের একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে যা বিবেচিত হয়। চিত্রকলায় ধারাবাহিকতায় লেখালেখির জগতেও আপন ঐতিহ্যের অনুরাগী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তিনি বেশ কিছু যাত্রাপালা ও পূথি রচনা করেন। যার মধ্যে ‘অরন্যকান্ত পালা’, কঞ্জুশের পালা, কাক ও পানির পালা, ঋষিযাত্রা, মারুতির পুথী, চাইবুড়োর পুথি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জন্ম
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। সে দিক থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পিতৃব্য ছিলেন।
তিনি পারিবারিক সুবাদে শৈশবেই চিত্রকলার আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৮৮১ থেকে ৮৯ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। ৮৯ সালেই সুহাসিনি দেবীর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৯০ এ গড়া রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার সদস্য হয়ে তিনি কবিতা পড়েছেন, নাটক করেছেন। ১৮৯৬ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করেন। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রাণী মেরি ভারত ভ্রমনে এলে আর্ট গ্যলারী পরিদর্শনের সময় তাদেরকে ওরিয়েন্টাল আর্ট সম্পর্কে বোঝাবার দ্বায়িত্ব পান। ১৯১৩ সালে লন্ডনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, এবং তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সি আই ই উপাধী লাভ করেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি-লিট প্রদান করে ১৯২১ সালে। ১৯৪২ সালে শিল্পীপত্নীর মৃত্যু হয়। ১৯৪১ থেকে ৪৫ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর আচার্য রূপে দ্বায়িত্ব পালন করেন।
উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম
ওমর খৈয়াম (জাপানী রীতিতে আঁকা)
শাহাজাদপুরের দৃশ্যাবলী
আরব্যপোন্যাসের গল্প
কবিকঙ্কন চন্ডী
প্রত্যাবর্তন
জারনিস এন্ড সাজাহান
কৃষ্ণলীলাবিষয়ক চিত্রাবলী
বজ্রমুকুট
ঋতুসংহার
বুদ্ধ
সুজাতা
প্রকাশিত গ্রন্থ
শকুন্তলা (১৮৯৫)
ক্ষীরের পুতুল (১৮৯৬)
রাজকাহিনী (১৯০৯)
ভারত শিল্প (১৯০৯)
ভূত পত্রীর দেশ (১৯১৫)
নালক (১৯১৬)
বাংলার ব্রত (১৯১৯)
খাজাঞ্জির খাতা (১৯২১)
প্রিয় দর্শিকা (১৯২১)
চিত্রাক্ষর (১৯২৯)
বুড়ো আংলা (১৯৪১) জোড়াসাঁকোর ধারে (১৯৪৪)
সহজ চিত্র শিক্ষা (১৯৪৬)
ভারত শিল্পের ষড়ঙ্গ (১৯৪৭)
আলোর ফুলকি (১৯৪৭)
ভারত শিল্পে মূর্তি (১৯৪৭)
মাসি (১৯৫৪)
একে তিন তিনে এক (১৯৫৪)
শিল্পায়ন (১৯৫৫)
মারুতির পুঁথি (১৯৫৬)
রং বেরং (১৯৫৮)
………..
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা (https://www.facebook.com/pratapcsaha)। ধন্যবাদ।