“এবার ম’লে সুতো হব, তাঁতির ঘরে জন্ম লব, পাছাপেড়ে শাড়ি হয়ে দুলবো তোমার কোমরে…” – গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের রচনায় সেই বোধহয় বাঙালি পরিবারে ‘পাছাপেড়ে’ শাড়ি ও শব্দটির শেষ ও সর্বজনপ্রিয় উদযাপন। লেখাপড়া শেখা বাঙালি নারী কিম্বা পুরুষ দোকানে গিয়ে ‘একটা পাছাপেড়ে শাড়ি দেখাবেন?’ – এই প্রকাশ্য অনুরোধ করতে পারেন না বোধহয় আজ।
‘মাগ-মিনসে-মাই’-এর মতো ‘পাছা’ শব্দটিও শিক্ষিত বাঙালির সামাজিক উচ্চারণে ব্রাত্য হয়েছে। আর সেই পরিত্যক্ত অস্পৃশ্য শব্দটির জন্যই হারিয়ে গেছে বাংলার নিজস্ব তিনপাড়ের অনুপম শাড়ি, ‘পাছাপেড়ে’র অনবদ্য লৌকিক অনুপ্রাস। অথচ নবজাগরণের অন্যতমা কন্যা রাধারাণীদেবীর বয়ানে পাচ্ছি, “কলকাতা থেকে পার্শেলে শাড়ি আসত আমাদের। ডুরে পাড়, রঙিন সুতোয় বোনা শান্তিপুরী। …আরও ছেলেবেলায় আসত পাছাপেড়ে শাড়ি।”
গবেষক অতুল শূর জানাচ্ছেন, “বিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত বাঙালি মেয়েরা পাছাপেড়ে শাড়ি পরত। আজ মেয়েদের শাড়ি থেকে মধ্যেকার এই তৃতীয় পাড়টা মুছে গেছে।” বিশ শতকের গোড়ার দিক। বাঙালি মেয়েদের লেখাপড়া ধীরে ধীরে সর্বজনীন হয়ে উঠছে তখন। বাংলার বাইরের শাড়ি পরার চলন শুরু হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের আশ্রমকে কেন্দ্র করেই, ঠাকুরবাড়ির ও শান্তিনিকেতনের আলোকপ্রাপ্ত মেয়েদের পরিধানে আসছে দক্ষিণী বা কটকি শাড়ি। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে বিমলা অঙ্গে তুলে নিচ্ছে লাল মাদ্রাজি শাড়ি। ধীরে ধীরে দেখছি, গঙ্গাজলী, খড়কে ডুরে, দ্বারবাসিনী, নিয়রমেলানী – বাংলার এসব একান্ত বসন আড়ালে সরে যাচ্ছে। এলিট বাঙালির গানের পরিসর থেকে যেমন দূরপ্রান্তে চলে গেছে বাংলার কীর্তন গান।
অথচ বাংলার কথাসাহিত্যে বারবার আসছে এই প্রায় ‘অপরজনের’ পরিধেয় পাছাপেড়ে শাড়ির উল্লেখ। এই সাংস্কৃতিক বিরোধাভাস স্পষ্ট হয়ে আসে অমিয়ভূষণ মজুমদারের গল্পে, “পাছাপেড়ে শাড়ি কলকাতায় কী করে জুটল, এর চাইতেও বড়ো সমস্যা হল সেটা পরে কলেজে আসবার কথা দীপিতা কী করে ভাবতে পারল! শুধু পরা নয়, যেখানে যেরকম টানটোন দেয়া দরকার তেমনি করে দেহকে ফুটিয়ে তুলে! সারাদিন তাকে কেন্দ্র করে কলেজে একটা বাতাস খেলে গেল।” (দীপিতার ঘরে রাত্রি)।
©দুর্গেশনন্দিনী