বঙ্গভঙ্গের সময়ে স্বদেশি আন্দোলনে উত্তাল কলকাতা | এই সময়ে কলকাতায় অক্ষয়কুমার সরকারের মেসে এসেছেন তিনি | তাঁকে দেখেই মেসের ছেলেরা ধরে বসল, একটা গান লিখে দিতে হবে | কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি বসে পড়লেন কাগজ কলম নিয়ে | লিখে ফেললেন প্রথম কয়েকটা লাইন | তারপরে ছেলেদের বললেন,চল জল’দার ওখানে যাই | ওখানে ‘আদ্ধেক’ গান কম্পোজ় হতে হতে বাকিটা লেখা হয়ে যাবে | জল’দা মানে জলধর সেন, ‘ওখানে’ মানে ‘বসুমতী’র দফতরে | সকলে মিলে গেলেন সেখানে | জলধর সেন বললেন, এ তো মাত্র কয়েকটা লাইন, বাকিটা কই ? তিনি বললেন কম্পোজ করতে দিন, হয়ে যাবে বাকিটা | সত্যিই তাই | কম্পোজ করতে করতেই পুরো গানটা লিখে ফেললেন উনি | তার পর গানের সুর হল | কাগজে ছাপা গান নিয়ে চলে গেল মেসের ছেলেরা |
সন্ধেয় জলধর সেন বিডন স্ট্রিটের এক বাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে আছেন। হঠাৎ শুনলেন, দূর থেকে এক দল ছেলে গান গাইতে গাইতে আসছে | অবাক হয়ে গেলেন জলধর সেন | কয়েক ঘণ্টা আগে বসুমতীর প্রেসে ছাপা হয়েছে সেই গান আর ইতিমধ্যেই সেই গান লোকের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে | শুনে রোমাঞ্চ হয়েছিল তার |
বুঝতে পারলেন কোন গান ? আর কে সেই গীতিকার ?
গানটি ছিল ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ | গানটির গীতিকার ছিলেন রজনীকান্ত সেন | রজনীকান্ত সেন ‘কান্তকবি’ নামেই বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন। সুদীর্ঘকাল ধরে তাঁর গান বাঙালি মননে এক হর্ষ-বিষাদের স্থান অধিকার করে রেখেছে | শুধু স্বদেশি গান লিখে কিংবা গেয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছিলেন গ্রামে গঞ্জে। সেখানে সাধারণ মানুষকে স্বদেশি অন্দোলনের তৎপর্য বুঝিয়েছিলেন।
জীবনের মধ্য ভাগেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন গলার ক্যানসারে। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজে। সামনে খাবার, খেতে পারেন না। অসম্ভব পিপাসা, কিন্তু জল দিলে সব পড়ে যায় বুক বেয়ে। মুখ দিয়ে কখনও বেরিয়ে আসে দুর্গন্ধময় পুঁজ-রক্ত। রাতের পর রাত ঘুম হয় না। তাই কাগজ টেনে রজনীকান্ত সেন লিখে যান একের পর এক লেখা— গান। কবিতা। হাসপাতালে বসেই লিখেছিলেন ‘সেখানে সে দয়াল আমার বসে আছে সিংহাসনে’ বা ‘ওগো, মা আমার আনন্দময়ী, পিতা চিদানন্দময়’। অন্তরে কোন সাধন থাকলে এমন লেখা যায় ? রোগশয্যায় তাঁর পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্য পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০-এর ১৩ সেপ্টেম্বর রজনীকান্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
প্রয়াণ দিবসে কান্তকবি রজনীকান্ত সেনকে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য |