রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক শ্রী মোহনজী ভাগবত (Shri Mohanji Bhagwat) -এর বক্তব্য শুনে লিখেছেন অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)। ২৬ শে এপ্রিল, ২০২০।
১. অনেক শতক পর বিশ্ব এই অভূতপূর্ব সঙ্কটের মোকাবিলা করছে। সবার মনে হচ্ছে ঘরে বসে আছি, আমাদের সব কাজ বন্ধ। কিন্তু সঙ্ঘের কাজ চলছে। মানুষের জীবন যেমন থেমে থাকে না, অন্য খাতে বয়ে যায়; তেমনি সঙ্ঘের কাজও এখন অন্য খাতে বইছে। প্রার্থনা করা হচ্ছে, সেবা করা হচ্ছে গভীরতায়, অন্তরাত্মার ডাকে। সমাজ আমাদের সাহায্যও করছে। নিজে ভালো হওয়া ও দুনিয়াকে ভালো করা আমাদের কাজ। এই মুহূর্তে আমাদের কার্যক্রম হল সেবা। সেবার মধ্যে দিয়েই এই নীতিটি পালিত হচ্ছে “একান্তমে আত্মসাধনা/লোকান্তমে পরোপকার” — এটা সঙ্ঘের লক্ষ্য। একান্তে আত্ম সাধনা এবং লোকসমাজে পরোপকার। আমাদের ভাবনার বদল হয় নি, কিন্তু কার্যক্রম বদলেছে। সেবার কাজ চলছে এখন। কোনো ঢাক-বাজানোর কাজ নয়। যেন আত্মবৃত্তির পরিপাক, নিরহংকার বৃত্তির কাজ। নিজের বিবেকের কাছে নিজের কাজ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা যেন থাকে। কতদিন এই অবস্থা চলবে জানা নেই, কিন্তু যতদিন চলবে ততদিন নিজেকে ঠিক রেখে প্রেমভাব নিয়ে পীড়িতকে আপনার লোক মনে করে সেবার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
২. নিয়ম মেনেই কাজ করা হবে। মহামারীকে ভয় পেলে চলবে না। ঠাণ্ডা মাথায়, আত্মবিশ্বাস নিয়ে যোজনা-পরিকল্পনা করতে হবে। অসুখটা নতুন, যেটুকু জানা যাচ্ছে, সেইমত চলতে হবে। সেবার কাজ মাঝপথে ছাড়লে চলবে না, ক্লান্ত হলে চলবে না। সবাইকে আমরা সেবা করবো, যে চাইবে ওষুধ ও পথ্য তাকেই দেবো। এটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য, আমাদের ঐতিহ্য। সকলের প্রতি আমাদের সমব্যথিত্ব আছে। পীড়িত মানুষের মধ্যে কোনো ভেদ করবো না। সেবার মধ্যে থাকবে শ্রদ্ধা, কারণ এটা উপকার নয়। নিজেকে সুস্থ রেখে, সাবধানে থেকে পীড়িতের কাছে সঙ্ঘকে পৌঁছাতে হবে।
৩. ক্লান্তি কেন নয়, উদ্যাম কেন দরকার তা বলতে গিয়ে একটি অনবদ্য গল্পের অবতারণা করেন তিনি। সাফল্য ও ব্যর্থতার ফারাক মাত্র ৩ ফিট। এ বিষয়ে একটি ম্যাঙ্গানীজের খনি আবিষ্কারের গল্প বলেছেন। পূর্ববর্তী মালিক খনিজদ্রব্য না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে একখন্ড জমি নিলামে বেচে দেন। কিনে নেন এক উদ্যোগপতি; তিনি আরও খননকার্য চালিয়ে অমূল্য খনিজ পদার্থের ভান্ডার খুঁজে পেলেন। তাতেই তার প্রভূত লাভ হল। মাত্র ৩ ফুট বাকী থাকতে পূর্বজনের জয় অধরা থেকে গেলো। স্বার্থের কারণে অনেকানেক মানুষ হয়তো সেবাকাজকে, সঙ্ঘের কাজকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করবেন; তার প্রতি মনোনিবেশ না করে সাবধানে এবং প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে আপন লক্ষ্যে অবিচল থেকে কাজ করে যেতে হবে।
৪. লোককে আমরা সুরক্ষা দিচ্ছি মানে, আমাদের সুচরিত্রকে দৃষ্টান্ত হিসাবে উপস্থাপিত করে তাদের চরিত্র গঠন করছি। যতদিন দুঃসময় চলবে সেবার কাজ চলবে। নিদ্রা, তন্দ্রা, ভয়, ক্রোধ, আলস্য, দীর্ঘসূত্রতা — ত্যাগ করতে হবে। রাজনীতি নিরপেক্ষ হয়ে সেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে, রাজনীতিকে অতিক্রম করে সেবা করতে হবে। সঙ্ঘের কারো প্রতি কোনো শত্রুতা নেই। ক্রোধ এবং ভয় যেন আমাদের সেবাকাজের প্রতিবন্ধক না হয়।
৫. সবাইকে এটা বোঝাতে হবে, মহামারী একদিন চলে যাবে। তখন আমাদের রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণের কাজ করতে হবে, এই মহামারীর থেকে শিক্ষা নিয়েই করতে হবে। একটা যুগোপযোগী অর্থনীতি আমাদের রচনা করতে হবে। বিজ্ঞান ও দর্শনকে সামনে রেখে প্রশাসন একটা সঠিক রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা তৈরি করবে। সেই ব্যবস্থাকে যথার্থ করে তোলার জন্য প্রশাসনকে সমাজ সহায়তা করবে। বিদেশের উপর আর বেশি নির্ভর করা যাবে না। স্বদেশী আচরণ ও মন তৈরি করে নিতে হবে। স্বদেশী উৎপাদনের উপর জোর দিতে হবে। আত্মনির্ভরশীলতাই হবে আগামী উন্নয়নের মূল বার্তা।
৬. এই মহামারী এবং মানুষের আবদ্ধ জীবন প্রাকৃতিক পরিবেশকে অনেকটাই শুদ্ধ করেছে। পরবর্তী জীবনে আমাদের এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত যা পরিবেশবান্ধব, চিরায়ত হয়। এর জন্য জল ও বৃক্ষ সংরক্ষণ, জৈবকৃষি, গোরক্ষা, প্লাস্টিক-মুক্তি প্রভৃতি দিকে বেশি নজর দেবার কথা বলেছেন। উৎপাদনের গুণগত মান যেন সর্বোত্তম হয়, তার দিকেও নজর দিতে হবে।
৭. শিক্ষা ব্যবস্থা যথার্থ হতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ছোট সংখ্যায় ক্লাস এবং বৈদ্যুতিন বা ই -ক্লাসরুমের উপর জোর দেন তিনি। শরীরচর্চায় প্রাণায়াম, যোগ পদ্ধতির সংযুক্তি অপরিহার্য। সকলকে এই শরীরচর্চায় সামিল করে তুলতে হবে; নিজের পরিবার এবং প্রতিবেশী কুটুম্বকে।
৮. প্রতিবেশীরা যাতে সঠিক আচরণ করেন তারজন্য আমাদের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে হবে। আমাদের আচরণগুলির যথার্থতাকে প্রতিবেশীদের বোঝাতে হবে। আচরণ সামগ্রিক না হয়ে উঠলে সর্বাঙ্গীণ সাফল্য আসবে না। নাগরিক অনুশাসন পালন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ভগিনী নিবেদিতা (Sister Nivedita) এবং ড. বি. আর. আম্বেদকারের (Dr. B. R. Ambedkar) কথা স্মরণ করেছেন। অনুশাসনের পালন সমাজে শান্তি, সহযোগ ও সদ্ভাবের পরিবেশ আনে। সমাজের গণ্যমান্য লোকেদের দিয়ে সমাজ প্রবোধনের কাজ করতে হবে। নাগরিক অনুশাসনের পালনই হল আসল দেশপ্রেম।
৯. যুগোপযোগী আর্থিক পরিকল্পনা রচনা করতে হবে। নতুন বিকাশ-মডেলে শাসনব্যবস্থা প্রশাসন করবে, কিন্তু সমাজকে ‘স্ব’ বিকাশের কাজে একান্ত সাথী হতে হবে। রাষ্ট্র নির্মাণের যে কাজ চলছে তার পরের চরণ এইবেলা শুরু হবে। নতুন ভারতের উত্থান এই সংকট কাল থেকেই শুরু হবে। এই শিক্ষা ও বোধ যেন আমাদের জারিত করে।
লেখা: ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)
ছবি: শ্রী শীর্ষ আচার্য (Shri Shirsha Acharya)