দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে হিন্দুত্ব ভিত্তিক দল সফল হওয়ার পর থেকেই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা এই বলে ‘কুমিরের কান্না’ কাঁদছেন যে, ফ্যাসিবাদীরা গান্ধী ভাবনা ধ্বংস করে চলেছে। একটু গভীর ভাবে দেখলে বোঝা যায় যে নেহেরু ও তার অনুগামী চাটুকারেরাই আসলে গান্ধী ভাবনাকে ধ্বংস করেছেন।
গান্ধীজীর চিন্তাধারার অনেক দিকের সঙ্গে একমত না হলেও কিছু ক্ষেত্রে গান্ধী ভাবনার অনন্যসাধারণতা অবশ্যই আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। প্রথমত, গান্ধীজী ক্ষমতার রাজনীতির মোহে আবদ্ধ ছিলেন না। অর্থাৎ যেভাবে হোক ব্রিটিশ তাড়িয়ে নিজেদের হাতে ক্ষমতা আনাটাই তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। তিনি ভারতীয় সমাজ ও তার নেতৃত্বের সাত্ত্বিকতার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
পরাধীনতা জাত দাস মনোবৃত্তি সম্বন্ধে গান্ধীজি সম্যক সচেতন ছিলেন। এই মনোবৃত্তির তিনটি দিক ছিল। এক, পাশ্চাত্য তখন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উন্নতির ফলে তাদের করায়ত্ব পার্থিব জাঁকজমক দিয়ে বাকি বিশ্বের মানুষকে বিস্ময়াবিষ্ট করে ফেলেছিল। তাই এদেশের অধিকাংশ মানুষ পাশ্চাত্যের সমস্ত কিছুকে একমাত্র প্রামান্য মনে করে নিজেদের পূর্বপুরুষ, সংস্কৃতি, পরম্পরাকে এমন কি ভাষাকেও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে শুরু করেছিল।
দুই, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের ঘাড়ে পোপতন্ত্র ও ও রাজার মধ্যেকার বিবাদ থেকে উদ্ভূত নতুন তত্ত্ব সেকুলারিজম বা সম্প্রদায় নিরপেক্ষতার (ধর্মনিরপেক্ষতা নয়) ভূত চেপে বসা। ভারতবর্ষ আধ্যাত্মিকতার দেশ। তাই গান্ধীজী আধ্যাত্মিকতার ভিত্তিতে ভারতীয় রাজনীতিকে গড়তে চেয়েছিলেন। নিষ্কাম ও ত্যাগময় ‘রাম রাজত্ব’ ছিল তার এই রাজনীতির চূড়ান্ত গন্তব্য। সেখানে দাঁড়িয়ে গান্ধীজী স্ব ভাষা, স্বাবলম্বন ও বিশুদ্ধ স্বদেশীর ভিত্তিতে ভারত গড়ার কথা ভেবেছিলেন।
তৎকালীন ভারতের অধিকাংশ প্রাদেশিক সমিতি প্রধানমন্ত্রী রূপে প্যাটেলকে চাওয়া সত্ত্বেও একমাত্র গান্ধীজীর ইচ্ছাতেই নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।
অথচ অন্ধ স্নেহের কী নির্মম পরিহাস যে সেই নেহেরু,গান্ধী ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের পূর্বজ, অতীত গৌরব, সংস্কৃতি ও পরম্পরাকে অস্বীকার করে ঔপনিবেশিক ও ইউরোপীয় ধ্যান ধারণার অন্ধ অনুকরণ করেন। তার বংশধর পরবর্তী কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। অবশ্য শাস্ত্রীজির চিন্তাধারায় ভারতের মাটির গন্ধ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি বেশিদিন প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেননি।
নেহেরুর ভাবনা কয়টি মূল স্তম্ভের ওপরে দাঁড়িয়েছিল। এক,সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতের আত্মা ধর্মকে অস্বীকার করে পাশ্চাত্যের তত্ত্ব সেক্যুলারিজমকে প্রাধান্য দেওয়া এবং সেটা একমাত্র সংখ্যাগুরুর হিন্দু ভাবনার ক্ষেত্রে। দুই, প্রশাসনিক, শিক্ষা ও ভাষা সম্পর্কিত নীতির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক নীতিকে সযত্নে অনুসরণ করে যাওয়া। তিন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে কম্যুনিস্ট ভাবনা সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করা।
এই তিনটিই উপরোক্ত গান্ধী ভাবনার সম্পূর্ণ উল্টো। নিচের আলোচনায় তা আরো স্পষ্ট হবে-
স্বদেশী ভাবনা ব্যক্ত করতে গিয়ে গান্ধীজী বলছেন,” দূরের চেয়ে কাছের সেবা ও তাকে কাজে লাগানোর যে মনোভাব তারই নাম স্বদেশী। এই সংজ্ঞা মেনে নিলে ধর্মের ক্ষেত্রে পূর্বপুরুষদের ধর্মেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।……… রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বদেশী মানে দেশের শাসন ব্যবস্থার দোষ থাকলেও তা মেনে নেওয়া এবং তার দোষ শুধরাবার চেষ্টা করা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্বদেশী মানে আমাদের কাছের প্রতিবেশীর তৈরি জিনিসটাই আমরা ব্যবহার করব এবং কোন খুঁত থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করব।”
……..রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই একথা আমি বিশ্বাস করি না। ধর্মকে বাদ দিয়ে যে রাজনীতি তা বাসি মরার মতো। তাকে কবর দেওয়া উচিত।”
উপরোক্ত ভাবনা অনুযায়ী দীর্ঘ বিধর্মী আক্রমণের ক্ষত সারিয়ে পুনর্নির্মিত সোমনাথ মন্দিরের দ্বারোদঘাটন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা তো ভারতবাসী হিসেবে গর্বের ব্যাপার। অথচ নেহেরু সেই অনুষ্ঠানে নিজে তো যাননি উপরন্তু রাষ্ট্রপতিকে যেতে বারণ করেন। কারণ তাতে নাকি দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবে। এতেই বোঝা যায় যে সেক্যুলারিজমের ভূত কী ভাবে নেহেরুর মাথায় চেপে বসে ছিল। অথচ গান্ধীজী বলছেন,” আমার মতে ধর্মীয় শিক্ষা একমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তব্য হওয়া উচিত।
সরকার ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করবে এতে আমি রাজি নই।” তাহলে ভারতে যখন মূল সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার কোনও স্থান নেই, তখন সরকারি ব্যবস্থায় সমান্তরাল মাদ্রাসা শিক্ষা কি ধর্মনিরপেক্ষতাকে ক্ষুন্ন করে না ?
স্বদেশী ভাবনা অনুযায়ী গান্ধীজি প্রাথমিক স্তর থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষার পক্ষপাতি ও ইংরেজি শিক্ষার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। মেকলে প্রবর্তিত ঔপনিবেশিক ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি গান্ধীজী এতটাই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে, গণতন্ত্র ও অহিংসার পূজারী হওয়া সত্ত্বেও, ইংরেজি শিক্ষা নিষিদ্ধ করতে তিনি তার জাত খুইয়ে স্বৈরাচারী হতেও রাজি ছিলেন। তাঁর কথায়,”আমার হাতে স্বৈরতন্ত্রী ক্ষমতা থাকলে আজই আমি দেশের ছেলে মেয়েদের বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা পাওয়ার প্রথা রদ করতাম এবং পদচ্যুত করার হুমকি দিয়ে প্রতিটি শিক্ষক ও অধ্যাপককে অবিলম্বে এই পরিবর্তন কার্যকর করতে বাধ্য করতাম।”
গান্ধীজী রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলছেন,”সারা ভারতের চিন্তা বিনিময়ের জন্য আমাদের ভারতীয় ভাষাসমূহের মধ্য হইতে একটা ভাষা চাই যাহা অধিক সংখ্যক লোক বর্তমানে জানে এবং যাহা অপর সকলে সহজেই শিখিতে পারে।”সেখানে বিগত ৬০-৬৫ বছর ধরে ঔপনিবেশিক ভাষা ও শিক্ষানীতি এমন ভাবে চলেছে যে অবস্থা পরাধীনতার থেকেও খারাপ। বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত যে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিবেকানন্দ, সেই মেট্রোপলিটন স্কুল বাংলা মাধ্যম ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে এবং ইংরেজি মাধ্যমের দাবিতে উঠে যাওয়ার মুখে। অর্থাৎ সাহেব তাড়িয়ে আমরা যেন নিজেরাই,’বাদামী সাহেব’ হতে আগ্রহী।আমাদের ঘরের সন্তানেরা বিচিত্র ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,”আমার না বাংলাটা ঠিক আসে না”। আর তাদের বাবা-মায়েরাও সন্তানের একটা ভুল ইংরেজি বানানের জন্য লজ্জায় মরে যান।
ভারী শিল্প নিয়ে গান্ধী ভাবনার সঙ্গে অনেকে দ্বিমত হলেও, স্বাধীন ভারতে স্থানীয় আর্থসামাজিক অবস্থার কথা না ভেবে সোভিয়েত মডেলের অন্ধ অনুকরণে শুধু ভারী শিল্প কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছোট ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে স্বাবলম্বী গ্রাম গঠনের গান্ধী ভাবনাকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়। পরিণামে আজ বহু গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, পানীয় জল নেই, বিদ্যালয় নেই, শিক্ষক – ছাত্র অনুপাত খুবই কম। গ্রাম থেকে শহরে মানুষের পলায়ন অব্যাহত। এই নীতির সার্বিক ব্যর্থতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, সোভিয়েত রাশিয়া আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার কাছাকাছি সময়ে ভারতও আর্থিক অচলাবস্থার সামনে পড়ে। বিমানে করে সোনা নিয়ে বিদেশে বন্ধক রেখে টাকা আনার মতো লজ্জা ও অপমানের ঘটনা ঘটে।
অর্থাৎ সঠিকভাবে দেখলে, নেহেরু তন্ত্রীরা গান্ধীজীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শুধু টাকার ওপর তার ছবি ছাপানোর ব্যবস্থা করেছে। এবং বাস্তবে এরা গান্ধী ভাবনাকে হত্যা করেছে ও ভোট পাওয়ার জন্য গান্ধী ভজনার নাটক করে। গান্ধীজীর দুঃখজনক মৃত্যু না হলে তাকে বেঁচে থেকে তার চিন্তাধারার অপমৃত্যু দেখতে হতো এবং তার অবস্থা যে কবির ভাষায়,” কি যন্ত্রনায় মরেছে পাথরে নিস্ফল মাথা খুঁটে”- র মতো হত সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
সুব্রত ভৌমিক
(লেখক- দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টেন্ট-এর অ্যাসোসিয়েট সদস্য)
গান্ধী ভাবনার সূত্র – গান্ধী রচনা সম্ভার, সম্পাদনা- সত্যেন্দ্রনাথ মাইতি। গান্ধী মেমোরিয়াল কমিটি, পশ্চিমবঙ্গ)