এক জাতি এক প্রাণ একতার ভিত্তি হল একটি সুষ্ঠ ও কার্যকর ভাষা নীতি

হঠাৎ করে হিন্দি ভাষাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে আঞ্চলিকতাবাদের চেঁচামেচি শুরু হয়েছে । কেউ বলছেন মাতৃভাষাকে ধ্বংসের অপচেষ্টা। কেউ বলছেন কেন্দ্র  সারাদেশে আগুন লাগানোর চেষ্টা কর ইত্যাদি । যেন মনে হচ্ছে  কোনও বিদেশি শক্তি দেশে ক্ষমতাসীন হয়ে তাদের ভাষা জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।  এই সব আঞ্চলিক ভাষা বিপ্লবীরা আসলে কবির ভাষার অনুসরণে  “ভাষার নামে বজ্জাতি সব ভাষা-জালিয়াত খেলছে জুয়া” -র দল। এরা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের বিশুদ্ধ বিদেশি ও  এক সময়ের শাসকের ভাষা ইংরেজির ব্যাপারে নিবেদিত প্রাণ এবং সম্ভব হলে নিজেদের সন্তানদের মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই ইংরেজি শেখাতে আগ্রহী। তখন তাদের মনে আঞ্চলিক বা মাতৃভাষার  কোনও  স্বাভিমানই জাগে না ।  বিবেকানন্দের ভাষায় এটাই “দাসসুলভ মানসিকতা বা পরান্ধানুকরণ প্রিয়তার” চূড়ান্ত লক্ষণ। তাই তারা বিদেশী ইংরেজির পরিবর্তে স্বদেশী হিন্দির  গুরুত্ব বৃদ্ধির শুভ প্রচেষ্টাকে আঞ্চলিক বা মাতৃভাষা ধ্বংসের অপচেষ্টা বলে মূল বিষয়টি গুলিয়ে দিতে চাইছে।

দীর্ঘ পরাধীনতার পর  স্বাধীন হলে কোনও দেশ প্রথমেই  এক স্বাধীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক -প্রশাসনিক নীতি গ্রহণ করে যার মাধ্যমে দেশবাসীর পরবর্তী প্রজন্ম পরাধীনতাজাত বিদেশি ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন চর্চা থেকে মুক্ত হয়ে দেশজ সংস্কৃতি – ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করে স্বনির্ভর ও আত্মগর্বে বলিয়ান এক জাতিরূপে বিকশিত হতে পারে।

ইজরায়েল এক আদর্শ উদাহরণ। তারা নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে অশেষ যাতনা সহ্য করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকতে বাধ্য হয়।  ফলে অস্তিত্বের ও জীবন জীবিকার তাগিদে তাদেরকে সেখানকার ভাষা, লোকাচারের সঙ্গে একাত্ম হতে হয়। তা সত্ত্বেও, তারা  স্বভূমি ফিরে পেয়ে ভাবেনি যে, আমরা পাকেচক্রে  নানা ভাষা শিখতে বাধ্য হয়ে একটি বহুভাষিক জাতিতে পরিণত হয়েছি। তাই  অপ্রচলিত ও বিশ্বের অতি কম সংখ্যক মানুষের ভাষা হিব্রুকে রাষ্ট্রভাষা করা ঠিক হবে না।  বরং  আমেরিকা সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের সাহায্যে রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম রূপে ইংরেজি বা অন্য কোনও বহুল প্রচলিত ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।  সেটা না করে রাষ্ট্রের কর্ণধাররা  হিব্রুকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে সেই ভাষাতেই প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সরকারি কাজের ব্যবস্থা করেছে।  এর ফলে  তারা মোটেই মধ্যযুগে ফিরে যায়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাদের অবদান যে কোনও দেশের পক্ষে লজ্জার। সে দেশের জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র .০২ শতাংশ। ১২৯ জন নোবেল পেয়েছেন। শুধু পদার্থবিদ্যায় ৫৩ জন। এই একটি দেশের উদাহরণই যারা ইংরেজি ছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষা হয় না বলে লাফায় তাদের গালে চড় মারার জন্য যথেষ্ট।

এখনও পর্যন্ত ভারতের অবস্থা এর বিপরীত এবং লজ্জাকর।  ইহুদিদের মতো বাধ্য হয়ে ভারতীয়দের বিভিন্ন দেশে বসবাস করতে হয়নি।  আমরা পরাধীন অবস্থাতেও  স্বভূমি, স্বভাষা, স্বসংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। যেখানে ব্রিটিশ অফিসাররাও এদেশ শাসন করার জন্য দেশীয় ভাষা  শিখত সেখানে স্বাধীন ভারতে কার্যত ইংরেজিকেই উচ্চশিক্ষা ও কাজের ভাষা রূপে একমাত্র গুরুত্ব  দেওয়া  হয়েছে (হিন্দি আছে তবে নাম মাত্র) । কিছুদিন আগে পর্যন্তও সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ের প্রতিলিপি হিন্দি বা অষ্টম তফসিল ভুক্ত অন্য কোনও ভাষায় পাওয়া যেত না । বর্তমান সরকারের উদ্যোগে সম্প্রতি সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরকম একটি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা এখনও চালু থাকায় ভারতীয়রা অবচেতন মনে শিখেছে যে, শুধু উচ্চশিক্ষা বা উচ্চপদের চাকরি নয় বরং বেয়ারা বা ঝাড়ুদারের চাকরি পেতে ইংরেজিই একমাত্র চাবিকাঠি। এই মানসিকতার জন্য জাতির  কর্ণধারদের বিগত ৬০-৬৫ বছরের ব্যর্থ নীতিই দায়ী।

এ বিষয়ে গান্ধীজির বক্তব্য সব থেকে মারাত্মক। তিনি বলছেন, “…আমরা যেন বিস্মিত না হই যে, ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা জাতিকে পরশাসনপাশে আবদ্ধ করেছি। ছলনা, চাতুরী এবং অত্যাচারের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা এদেশবাসীকে প্রতারণা করতে ও তাদের মধ্যে আতঙ্কের বন্যা বওয়াতে পশ্চাদপদ হননি।…” তিনি আরও বলছেন,  কলেজে যে কয় বছর  কাটাতে হয় সে সময় স্কুলজীবনে লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিকে আরও মজবুত করার কথা।  কিন্তু হয় বিপরীত। কারণ, এই সময় আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে ভুলতে শুরু করি, অনেকের মনে নিজের মাতৃভাষার প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাব জাগ্রত হয়।” পরাধীন অবস্থা থেকে স্বাধীন অবস্থায় আমরা আরও এগিয়েছি। এখন কলেজে নয় প্রথম শ্রেণী থেকেই তাচ্ছিল্য ভাব। কচি ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্র ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাকিয়ে (মানে shrug করা যেটাও বিদেশের অক্ষম নকল) গর্ব করে বলে, “আমার না বাংলাটা ঠিক আসে না”। আর বাবা-মায়েরাও সন্তান একটি ইংরেজি বানান ভুল করলে বা কম নম্বর পেলে লজ্জায় মরে যান।

ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার বিকল্প দিশা দেখাতে গান্ধীজি বলছেন , “রাশিয়া যা করেছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ,জাপান ইত্যাদি যা করতে চলেছে , আমাদেরও তাই করতে হবে।  জাপানে বাছাই করা কিছু লোক ইংরেজি ভাষায় উচ্চ জ্ঞান অর্জন করে সেই ভাষায় ভালো ভালো জিনিস সহজ করে নিজের ভাষায় অনুবাদ করেন। এই ভাবে তারা অগণিত জনসাধারণের ইংরেজি শেখার নিরর্থক পরিশ্রম বাঁচিয়ে দেন।”

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বক্তব্যেও একই ভাবনার প্রতিধ্বনি-  “ভারতবর্ষ পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রবেশ করিয়াছিল রাজা রামমোহন রায়ের আমল হইতে। অর্থাৎ জাপান পাশ্চাত্য শিক্ষালাভ করিবার সত্তর বছর পূর্বে। কিন্তু ভারতবর্ষ ইউরোপের সাহিত্য লইয়াই ভুলিয়া রইল; জাপান বাছিয়া লইল বিজ্ঞান। ফলে সত্তর বছরের মধ্যে হইল নবীন সূর্যোদয়, কিন্তু দেড়শত বছরেও ভারত যে তিমিরে সে তিমিরেই রইয়া গেল।” ( প্রবন্ধ – জাতীয় সম্পদের মূলে বিজ্ঞানের শক্তি)

ইংরেজি শিক্ষার কুপ্রভাবে ভয়ানক ক্ষিপ্ত গান্ধীজি এখানেই ক্ষান্ত না হয়ে বলছেন, “…আমার হাতে স্বৈরতন্ত্রী ক্ষমতা থাকলে আজই আমি দেশের ছেলেমেয়েদের বিদেশী ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা পাবার প্রথা রদ করতাম এবং পদচ্যুত করার হুমকি দিয়ে প্রতিটি শিক্ষক ও অধ্যাপককে অবিলম্বে এ পরিবর্তন কার্যকরী করতে বাধ্য করতাম।…” অর্থাৎ অহিংসার পূজারী গান্ধীজি ইংরেজি শিক্ষা রদে স্বৈরতন্ত্রী হতেও সম্মত ছিলেন।

ভাগ্যের কি করুণ পরিহাস যে গান্ধীজির প্রিয়তম ভাবশিষ্য নেহরু, যিনি তৎকালীন ভারতের অধিকাংশ কংগ্রেস প্রাদেশিক সমিতি সর্দার প্যাটেলকেই প্রধানমন্ত্রী রূপে চাওয়া সত্ত্বেও একমাত্র গান্ধীজির ইচ্ছাতেই প্রধানমন্ত্রী হন; তিনি  এবং মূলত তার বংশধর অন্য  কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীরা গান্ধী ভাবনাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে রেখেছে বিগত ৬০-৬৫ বছর ধরে। ঔপনিবেশিক ইংরেজি নির্ভর প্রশাসনিক, শিক্ষা ও ভাষা নীতি অনুকরণ করে এসেছে। মনে হয় ভারতবর্ষ যেন সেই গর্দভের দেশ যেখানে একজন ভারতীয় অন্য এক ভারতীয়র চাকরির পরীক্ষা নেন ইংরেজিতে ; একজন ভারতীয় আইনজীবী একজন ভারতীয় বিচারকের সামনে তার বক্তব্য রাখেন ইংরেজিতে।

মেকলের মানসপুত্র বাদামি সাহেবরা যে ইংরেজি শিক্ষার  ঢক্কানিনাদ করে বাস্তবে তার কঙ্কালসার চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। বিশ্বের ৩০০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নেই । তার মানে মৌলিক গবেষণা ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কোনও অবদান নেই। যেখানে পরাধীন ভারতের প্রতিভারা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হওয়া সত্ত্বেও পাশ্চাত্যে তাদের জ্ঞান, মৌলিক অবদানের জন্য নোবেল পেয়েছে, সেখানে স্বাধীন ভারতে বিজ্ঞানে কোনও নোবেল নেই।

সারা বিশ্বের ছবি অবশ্য অন্যরকম। বিশ্বের প্রথম ৫০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতেও বিদেশি ভাষায় উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই  (আমেরিকা ও ব্রিটেন বাদে কারণ সেখানকার জাতীয় ভাষা ইংরেজি) । পাঠ্যপুস্তকে দেশীয় বা মাতৃভাষার প্রাধান্যই বেশি।  জার্মানি, জাপান, চীন, কোরিয়া, সুইডেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য।

তাই এই দাস মনোবৃত্তি থেকে বেরিয়ে এসে ইংরেজির গুরুত্ব হ্রাস করার কোনও উদ্যোগ মোটেই গৈরিকীকরণ নয় বরং তা গান্ধীজি, প্রফুল্ল চন্দ্র ও অন্যান্য মনীষীদের ভাবনা অনুযায়ী (স্থানাভাবে যাদের কথা আলোচনা করা গেল না ) দেশের নীতি নির্ধারণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যা শুরু হওয়া উচিত ছিল তা প্রায় ৭০ বছর পর শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু ভারতে জাতপাত এর মতোই ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক রাজনীতির কারবারিরা এবং কিছু তথাকথিত প্রগতিশীলরা ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দিকে গুরুত্ব দেওয়ার ঘোরতর বিরোধী। এ ব্যাপারে তাদের অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি থেকে জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে ।   প্রথমত হিন্দি সমেত সমস্ত আঞ্চলিক ভাষাই দেশজ ভাষা। তাই আন্তর্জাতিক স্তরে এবং জাতীয় স্তরে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও কাজের ভাষা রূপে  বিদেশি ইংরেজির পরিবর্তে স্বদেশি হিন্দিকে গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ আঞ্চলিক ভাষার অমর্যাদা নয়। যেসব প্রগতিশীলরা হিন্দুত্বকে সাম্প্রদায়িকতা বলে গালি দেয় তারাই আবার ভাষার নামে আঞ্চলিকতাবাদকে প্রশ্রয় দিতে আগ্রহী কারণ তাহলে ভারতকে টুকরো টুকরো করতে সুবিধা হয়। তারা হিন্দু মুসলিম ঐক্যের জন্য ওকালতি করেন কিন্তু একজন অসমীয়া  একজন তামিল এর সঙ্গে কোন ভাষায় ভাব বিনিময় করবে সে ব্যাপারে নীরব । তবে কি তারা ইংরেজিতে ভাব বিনিময় করবে? তখন কি আঞ্চলিক ভাষার স্বাভিমানে  ঘা লাগবে না?  দ্বিতীয়তঃ ইংরেজি ছাড়া নাকি দেশ চলবে না। বাস্তবে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ দেশবাসী ইংরেজি পড়তে লিখতে পারেন , বলতে পারেন তার থেকেও কম । এর জন্য সমস্ত বিদেশি টিভি চ্যানেল প্রথম ক’বছর জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলি ইংরেজিতে দেখানোর পর টি আর পি না বাড়ায় এখন তা আঞ্চলিক ভাষায় ডাব করে দেখাচ্ছে।

সারাদেশে অহিন্দিভাষীরা  নাকি ভয়ানক হিন্দি বিরোধী।  বাস্তবে উপরোক্ত রাজনীতির কারবারি ও তথাকথিত প্রগতিশীল দুর্বুদ্ধিজীবী ছাড়া কেউই তীব্র হিন্দি বিরোধী নন। দক্ষিণীরা  প্রয়াগে কুম্ভ স্নানে এসে  ভাঙাচোরা হিন্দিতে কাজ চালিয়ে নেন, ভাষা কোনও সমস্যা হয় না। হিন্দি কে নিয়ে তাদের মধ্যে হয়তো কিছুটা আশঙ্কা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে যা  বিভিন্ন ভাষাভাষী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জনগণের মধ্যে সঠিক চেতনা তৈরির মাধ্যমে সহজেই দূর করতে পারেন।

দক্ষিণ ভারতের উপর ইসলামের প্রভাব বেশি না থাকায় সেখানকার ভাষাগুলি অনেকাংশে বিশুদ্ধতা বজায় রেখেছে। পক্ষান্তরে, হিন্দির মধ্যে অনেক আরবি-ফারসি শব্দের মিশ্রণ ঘটেছে। ওই সব শব্দ বাদ দিয়ে দেশীয় শব্দ সমৃদ্ধ হিন্দি ভাষা দক্ষিণীদের কাছেও ব্রাত্য মনে হবে না।

হিন্দির স্বপক্ষে গান্ধীজি  সহ অন্য বহু মনীষীর  বক্তব্য রয়েছে সেগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলোও অস্বীকার করা যায়  না যেমন:-

১) সব দেশবাসী হিন্দিভাষী না হলেও সর্বাধিক প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষ হিন্দিভাষী। অষ্টম তফসিলভুক্ত অন্য যে কোনও ভাষাভাষী যেখানে এককভাবে ১০% নয় অর্থাৎ হিন্দি মাধ্যমে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছানো যায়।

২) হিন্দির মাধ্যমে ভৌগোলিক ভাবে দক্ষিণ ভারতের কয়টি ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়টি জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্য ছাড়া (যেখানকার জনসংখ্যা খুবই নগন্য ) শুধু যে অবশিষ্ট ভারতের  বিস্তীর্ণ ভূভাগের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় তা নয় বরং সাংস্কৃতিকভাবে অখণ্ড ভারতের অঙ্গ বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মানুষও হিন্দি সহজে  বুঝতে পারেন ফলে এই দেশগুলির মধ্যে ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগের’ কূটনীতির বাস্তব রূপায়ণে হিন্দি একটি শক্তিশালী মাধ্যম ।এমনকী চীন-রাশিয়ার  বহু মানুষ হিন্দি গানের ভক্ত যেখানে আমরা স্বপ্নেও চীনা বা রুশ গান গাওয়ার কথা ভাবতে পারি না।

সমস্ত ভুল ধারণাকে দূরে রেখে ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিকতাবাদ বা খণ্ডিত জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে ‘এক জাতি এক প্রাণ একতাকে’ সর্বোপরি গুরুত্ব দিলে আমার মনে হয় নিম্নলিখিত বাস্তবসম্মত এক বিকল্প ভাষানীতি আসমুদ্রহিমাচল  দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে-

১)  প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত  সাধারণ শিক্ষা   বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষার (অষ্টম তফসিলভুক্ত) মাধ্যমে হবে। অবশ্য মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং  ও প্রযুক্তি বিদ্যার ক্ষেত্রে তা স্নাতক স্তর পর্যন্ত হবে।

২) সমস্ত ভিন রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হিন্দিতে মেডিকেল ,ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তি বিদ্যা পড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে।

৩) স্নাতকোত্তর মেডিকেল, ভারতীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, ভারতীয় ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সর্বভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন হিন্দিতে হবে।

৪) হিন্দিভাষী অনেকের মধ্যে এরকম ভাবনা আছে যে হিন্দি মাধ্যমে দেশ চলবে তাই আমাদের আর অন্য কোনও দেশীয় ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন নেই । এ জন্য অনেক অহিন্দিভাষী হিন্দির  প্রতি আপত্তি জানান । এই সমস্যার সমাধানে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে হিন্দিভাষী রাজ্যে যেমন হিন্দি তেমনি হিন্দিভাষী রাজ্যে যে কোনও একটি দক্ষিণী ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে, তবে তাতে মূলত ভাবপ্রকাশের সহায়ক অর্থাৎ ব্যাকরণ ও ভাষার গঠন সম্পর্কিত অধ্যয়নই বেশি থাকবে। সাহিত্যের পরিমাণ কম থাকবে।

৫) স্নাতক স্তরে ইংরেজি সমেত অন্য বহুল প্রচলিত বিদেশি ভাষা যেমন স্প্যানিশ, জার্মান ,রুশ, চীনা ঐচ্ছিক বিষয়  রূপে থাকবে।

৬) ভারতীয় প্রশাসনিক সেবা সমেত যে কোনও সর্বভারতীয় চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান ব্যবস্থা অর্থাৎ অষ্টম  তফসিলিভুক্ত যে কোনও ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাই বলবৎ থাকবে। কিন্তু বাধ্যতামূলক ইংরেজি পত্রের পরিবর্তে  অহিন্দিভাষীদের  জন্য হিন্দি এবং হিন্দিভাষীদের জন্য যে কোনও দক্ষিণী ভাষার পত্র থাকবে। ফলে হিন্দি ও অহিন্দিভাষী কেউই নিজেদের বঞ্চিত মনে করবেন না। অহিন্দিভাষীদের হিন্দিতে আপত্তি এখানেই যে উচ্চশিক্ষা ও চাকরির পরীক্ষায় হিন্দিভাষীরা অন্যায় সুবিধা পাবে।  এই ব্যবস্থায় হিন্দিভাষীরা  কোনও অন্যায় সুবিধা পাবে না ফলে অহিন্দিভাষীদেরও কোনও আপত্তি থাকবে না।

৭) উচ্চ ন্যায়ালয় -এর কাজ বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় এবং সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়-এর কাজ হিন্দিতে হবে।

অর্থাৎ  এই ভাষা নীতির লক্ষ্য  হবে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে যোগাযোগ ও কাজের ভাষা রূপে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি কে গুরুত্ব দেওয়া। এর সঙ্গে  প্রাদেশিক  বা আঞ্চলিক ভাষাকে গুরুত্বহীন করার কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ সহজ যুক্তি বলে  বিদেশি ইংরেজির স্থানে স্বদেশি হিন্দি আসলে যদি আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব কমে তাহলে ইংরেজি থাকাতে গুরুত্ব   তো ইতিমধ্যেই  কমে গিয়েছে তাহলে সে ব্যাপারে  ভাষা বিপ্লবীদের আপত্তি নেই কেন।

এই ব্যবস্থা গৃহীত হলে দক্ষিণ ভারতে হিন্দি এবং হিন্দিভাষী রাজ্যে বহু দক্ষিণী ভাষার শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রয়োজন হবে। অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের একটি নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে । উত্তরের মানুষের  দক্ষিণে এবং দক্ষিণের মানুষের উত্তরে  চলাচল বাড়বে। তাদের মধ্যে কালক্রমে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হবে। অসবর্ণ  বিবাহের মতো অসভাষা বিবাহ বাড়বে। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের দূরত্ব কমবে । এমন পরিবার দেখা যাবে যেখানে বাবা হিন্দিভাষী, মা তামিল ও পুত্রবধূ তেলেগু হবে। এভাবে জাতপাতের বেড়া ভাঙার মতো ভাষার বেড়াও ভাঙবে। ‘এক জাতি এক প্রাণ একতা ‘ বাস্তবায়িত হবে।

আমি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি মতো এক বিকল্প ভাষানীতি পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করলাম। আশা করি বিচক্ষণ দেশবাসী  ও দেশের কর্ণধাররা কোনও  না কোনও পথ নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন। এবং ‘ভাষার নামে বজ্জাতি সব ভাষা – জালিয়াত খেলছে জুয়া’- দের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হবে।

( গান্ধীজীর উক্তির  সূত্র – গান্ধী রচনা সম্ভার, সম্পাদনা- সত্যেন্দ্রনাথ মাইতি, গান্ধী মেমোরিয়াল কমিটি, পশ্চিমবঙ্গ)

সুব্রত ভৌমিক

মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব

লেখক দি ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব ইন্ডিয়ার অ্যাসোশিয়েট সদস্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.