ভারতবর্ষের ইতিহাসে খিলাফত আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ধর্মীয় আন্দোলনের রাজনৈতিকীকরণ ও হিন্দু নিধনের প্রকৃষ্টতম উদাহরণ হল খিলাফত আন্দোলন। খিলাফত শব্দটি এসেছে KHALIFA বা KHALIFAH(ARABIC) শব্দ থেকে। KHALIFA শব্দের উইপিকিডিয়া গত মানে হল-“Is a name or title which means ‘Successor’ ,’ Ruler’ or ‘Leader’.It most commonly refers to the leader of a Caliphate;but is also used as a title among various Islamic religious groups and orders.” ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ এর কোন পুত্র সন্তান না থাকার জন্য তিনি তার কোন উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে যাননি। কিন্তু নির্দেশ ছিল উত্তরাধিকারী যেন কোরেশ উপজাতিরই হয়।যেহেতু তিনি নিজে উক্ত উপজাতির মানুষ ছিলেন। ফলস্বরূপ আবু বকর ই মুহাম্মদের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হন। তাই তিনি হলেন নবউত্থিত ইসলামী সাম্রাজ্যের পারত্রিক অধিকর্তা বা খলিফা। পরবর্তীকালে এই খলিফা পদের জন্য এবং অধিকার ও ক্ষমতার হস্তান্তরের জন্য অনেক সংঘর্ষ হয়। সে এক লম্বা চওড়া ইতিহাস। উমাইয়া গোষ্ঠী ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে ও সংঘর্ষ বাধে এই খলিফা পদের জন্য।1288 খ্রিষ্টাব্দে অটোম্যান তুর্কিরা ও খলিফা পদ দাবি করে। কিন্তু তারা আরবীয় কোরেশ উপজাতির ছিল না বলে তাদের সেই খলিফাধিকার ও সর্বত্র স্বীকৃতি পায়নি।
ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মুহাম্মদ -বিন -কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের ফলে সিন্ধু সরাসরি উমাইয়া শাসিত দার- উল-ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পরে আব্বাসীয়রা খেলাফৎ দখল করলে ও সিন্ধুর শাসন বাগদাদ কেন্দ্রিক দার-উল-ইসলামের হাতেই বর্তায়। এইভাবে খলিফার নাম মাত্র রাজনৈতিক অধীনতাযুক্ত কিন্তু খলিফার ধর্মীয় কর্তৃত্ব যুক্ত বিভিন্ন ইসলামি সাম্রাজ্য পৃথিবীতে গড়ে উঠতে থাকে। গজনীর সুলতান মাহমুদ বিশ্বজনীন খেলাফতের অধীনতা স্বীকার করে ভারতে লুণ্ঠন করেন। তিনি নিজের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করেন প্রতিমা পূজকদের দেশ জয় করার কর্তব্যকে। সোমনাথের মন্দির লুন্ঠনের পরে তার উপাধি সংখ্যা বর্ধিত হয়। এইভাবে খলিফার আধ্যাত্বিক ও আইনী নীতি প্রযুক্ত হয় বিভিন্ন ইসলামী শাসনাধীন রাজ্যের জনগণের মধ্যে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটেন, তুর্কি সাম্রাজ্যকে ভেতর থেকে দুর্বল করার জন্য তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীন বেশকিছু রাজ্যকে যুদ্ধোত্তর কালে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রস্তাব দেয়। যুদ্ধে জার্মানি ও তুর্কিরা পরাজয়ের পরে, ব্রিটিশরা একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে ,আরবের স্থাপনা করে।যা তখনও তুর্কি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এছাড়া জর্ডান,সিরিয়া,লেবানন, প্যালেস্টাইন এবং ইরাক ও তুর্কির একাধিপত্যে ফাটল ধরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।
তুর্কিরা জার্মান শিবিরে যোগ দেয় 1914 এর 4 ঠা নভেম্বর।আর সেইদিন হতেই ভারতের মুসলিমরা ব্রিটিশের থেকে দূরে সরতে শুরু করে। আর যখন, যুদ্ধ শেষ হলো এবং তরুণ তুর্কিরা সুলতানকে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য করল সেই ক্ষণে তুর্কি সাম্রাজ্য ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়। এবং খলিফার সার্বভৌমত্ব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ভারতীয় মুসলমানরা খলিফাদের প্রতি প্রথম থেকেই শ্রদ্ধাশীল ছিল। যেহেতু এটি তাদের ধর্মের সাথে জড়িত বিষয়।ফলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলিমদের ক্রোধ এক নতুন মাত্রা পেল। তাই তারা খিলাফতের পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করলো। এর সাথে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কোন সম্পর্ক ছিল না। তবুও গান্ধীজী খিলাফত আন্দোলনকে কংগ্রেসের আন্দোলনের সাথে যুক্ত করলেন। মহাত্মা স্থির করলেন ,খিলাফতের আন্দোলনে সামিল হয়ে তিনি ভারতের মুসলমানদের নেতা হয়ে বসবেন ।হিন্দুদের নেতা তো তিনি আছেনি ই। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে খিলাফতের সঙ্গে এক করে ফেলার নির্দেশে তিনি নিজ প্রবৃত্তির প্রভাবে ধর্মীয় উপাদানকে রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। যে তুর্কির সঙ্গে ভারতের বিন্দুমাত্র যোগ নেই ,বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাদের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা ছিল না ,সেখানে তুর্কির খলিফাদের ক্ষমতায় বসানোর আন্দোলন ছিল চূড়ান্ত মূর্খামি ও ভন্ডামি। এ প্রসঙ্গে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ গান্ধীজিকে সাবধান করে দিয়েছিলেন।কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি ।অচিরেই এই আন্দোলন পথভ্রষ্ট ও পর্যুদস্ত হয়।
মুসলিম লীগ তার ডিসেম্বর 1919 এর সম্মেলনে খিলাফত অবিচারের বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করে ,কংগ্রেস নেতৃত্বকে তাদের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য আমন্ত্রণ ও করেন। পন্ডিত মতিলাল নেহেরু, পন্ডিত মদনমোহন মালব্য এবং গান্ধীজীর মত অধিকাংশ বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বিরাট উৎসাহ সহকারে সাড়া দিলেন। এবং আলোচনা সভায় যোগ দিলেন। গান্ধীজী বললেন -“যদি হিন্দুরা মুসলমানদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব অর্জন করতে চায়, তবে তারা অবশ্যই ইসলামের সম্মান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তাদের সঙ্গে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে”। মুসলমানদের গান্ধীজী আহ্বান করলেন -“ওঠো, জাগো,অথবা চিরকালের জন্য অধঃপতিত হও”।1920 সালের আগস্টে কলকাতাতে এক জরুরি অধিবেশনে গান্ধীজি খিলাফত আন্দোলন কে নীতিগত সমর্থন দিলেন।কংগ্রেসকে ছাড়াই এবং তার অধিবেশনের আগে। তিনি তার নেতৃত্বও গ্রহণ করলেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তুরকির খলিফার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে আন্তর্জাতিক ইসলামের স্বার্থে এটা প্রয়োজন। তিনি যারা দার-উল- ইসলামের বিভিন্ন অংশ দখল করে আছে ,তাদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ধর্মীয় দায় হিসাবে জেহাদকে সমর্থন করেছিলেন।ফলস্বরূপ যখন বৃটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মুসলিমদের কাছে এক ধর্মীয় কর্তব্য,জেহাদ , হিন্দুদের কাছে- তা দেশাত্মবোধের আহবান ছিল মাত্র।
এদিকে তুর্কি বিখ্যাত নেতা কামাল পাশা খলিফা হতে অস্বীকার করে ,খলিফা প্রথা লোপ করে সেই ধর্মান্ধ প্রতিষ্ঠানের গোড়াতেই কুঠারাঘাত করলেন।তিনি বললেন -“ইসলাম হচ্ছে পরাজিত জাতির ধর্ম ,যেদিন থেকে তা আমাদের মাটিতে পা রেখেছে, তুরস্কের অবস্থার ক্রমাবনতি হয়েছে”। তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের আসন থেকে ছুঁড়ে ফেললেন।এবং তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করলেন ।কিন্তু ভারতবর্ষে খিলাফত নেতারা এই শোচনীয় বিপর্যয়ের পরেও ক্ষান্ত হলেন না। যেখানে তুরস্ক নিজেই খলিফা প্রথা বাতিল করল, সেখানে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফতের মত একটি বিষয় প্রচার-প্রসারের দায় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নেওয়া কতটা উদ্ভব কান্ড ! তা ভাবার বিষয়। তবে এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল অন্য।
1921 সালের মধ্যেই খিলাফত আন্দোলন শেষ হয়ে যায় করুণভাবে।কিন্তু ওই একই বছর কেরালার স্থানীয় মুসলিম মোপলাদের মধ্যে এক বিদ্বেষপূর্ণ অপপ্রচার চালায় মুসলিমরা।যে, খিলাফত আন্দোলন সফল হয়েছে ।এবং ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি হয়েছে ও খলিফা আবার তার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাদেরকে বলা হয় কাফেরদের (অমুসলিম)খতম ও দার-উল- ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার প্রকৃত সময় আগত।মোল্লা ও মৌলবীদের এই আহবানে মোপলা ধর্মান্ধতার অলীক কল্পনা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সত্বর তারা মোহাম্মদ হাজী নামক এক ব্যক্তিকে খলিফা ঘোষণা করে। এবং জেহাদ ঘোষণা করে। তাদের ক্রোধ প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশদের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু হিংস্র ও তিক্ত প্রত্যাঘাত তাদের ওপর নেমে আসে ব্রিটিশদের তরফ থেকে।ফলে খিলাফতীরা চরমভাবে পরাজিত হয়।
ব্রিটিশদের সঙ্গে সংঘর্ষে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও হতাশাগ্রস্ত মোপলাদের অবশিষ্ট জেহাদী ক্রোধ এবার নির্দোষ হিন্দুদের ওপর নেমে এলো।তারা প্রচার করল যে ব্রিটিশদের মতো ‘হিন্দুরাও কাফের’।ফলে নির্বোধ হিন্দু যারা একসময় “হিন্দু- মুসলিম ভাই ভাই” এবং “আল্লাহু আকবর” ধ্বনিতে আবেগময় হয়ে পড়েছিল ,সহজেই তারা মোপলা গণহত্যার শিকার হল। মুসলমানদের কাছে খিলাফত রাজের অর্থ হলো এদেশে পুনরায় মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা।মোপলা নেতারা ঘোষণা করলেন- “আমরা শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে স্বরাজ ছিনিয়ে নিয়েছি- ইসলাম অথবা মৃত্যু “এই দুইয়ের মধ্যে হিন্দুদের একটিকে বেছে নিতে হবে। শুরু হলো হিন্দু নিধন যজ্ঞ। ভারতের প্রশাসনিক আধিকারিকদের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী 1500 হিন্দু খুন হয়। 20000 কে বল পূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়।এবং 3 কোটি টাকার মতো সম্পত্তি লুঠ হয়। বেসরকারি হিসেব ছিল আরও ভয়ঙ্কর।হিন্দু মহিলাদের যথেচ্ছ অপহরণ, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণ করা হয়। ডক্টর অ্যানি বেসান্তের বর্ণনায়: “তারা যথেচ্ছ খুন ও লুন্ঠন করে এবং যে সমস্ত হিন্দু নিজ ধর্ম পরিত্যাগে সম্মত হয়নি তাদের হত্যা বা বিতাড়িত করে।কোথাও প্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে শুধু পরিধেয় বস্ত্র ছাড়া সবকিছু কেড়ে তাদের বাসস্থান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়”(Annie Besant, Future of Indian politics, p.252)। তৎকালীন ভাইসরয় পত্নী ‘শ্রীমতি রিডিং’ এর কাছে পাঠানো এক মর্মস্পর্শী আবেদনপত্রে মালাবারের হিন্দু মহিলা মন্ডলী আনুপূর্বিক বর্ণনা দিয়েছিলেন-” সম্ভবত মহামান্যা দানবতূল্য বিদ্রোহীদের দ্বারা সংঘটিত সমস্ত আতঙ্কপূর্ণ ও বর্বর কুকীর্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবহিত নন;বহু কূয়ো ও জলাশয়, আমাদের নিকটতম ও প্রিয়তম যাঁরা আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস পরিত্যাগ করতে সম্মত হয়নি, তাঁদের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কিন্তু প্রায় অর্ধমৃত দেহতে ভর্তি; গর্ভবতী মহিলাদের কেটে টুকরো করে রাস্তার ধারে, জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়েছে; খন্ড-বিখন্ড শবের মধ্যে থেকে ভ্রূণ বেরিয়ে এসেছে;নিষ্পাপ ও অসহায় শিশুদের আমাদের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের চোখের সামনে হত্যা করা হয়েছে; আমাদের স্বামীও পিতারা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের গায়ের চামড়া তুলে নেওয়া হয়েছে এবং জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছে, আমাদের অসহায় বোনেদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্য থেকে বলপূর্বক অপহরণ করা হয়েছে এবং তাঁরা সেই সমস্ত লজ্জা বলাৎকারের শিকার হয়েছে,যা শুধু ওই অমানবিক নরকের কুকুরদের ইতর ও পাশবিক কল্পনায় আসতে পারে; হাজার ঘর-বাড়ি দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হিংস্রতা ও ধ্বংসের উন্মত্ততার ফলে ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে;আমাদের পূজাস্থলী অপবিত্র ও ধ্বংস করা হয়েছে এবং দেবদেবীর মূর্তি,যেখানে ফুলের মালা শোভা পেত; সেখানে গো-মাংস লেপন করে লজ্জাকর ভাবে অপমান করা হয়েছে অথবা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হয়েছে।…………. আমাদের ছোট্ট গ্রাম গুলি থেকে বিতাড়িত হয়ে, ক্ষুধার্ত,নগ্ন অবস্থায় আমরা যেভাবে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি তা আজও আমাদের স্মৃতিতে অম্লান…….”( দি ট্র্যাজিক স্টোরি অফ পার্টিশন,ভাষান্তর-সুব্রত ভৌমিক,p.69-70)।
মোপলা বিদ্রোহীদের গান্ধীজী সম্পর্কে স্পষ্ট উত্তর ছিলঃ”গান্ধীজী একজন কাফের,সে কিভাবে আমাদের নেতা হতে পারে?” খিলাফত সম্বন্ধে বিশ্বের 3 জন বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্য প্রাসঙ্গিক(1)মিঃ পোল্যাক লেখেন-“If Mohammad Alis interpretation of Islam is correct…….Islam is a world – danger to be fought remorselessly by all other peoples.”(2)এন্ডুজ রবীন্দ্রনাথকে লেখেন -” I am out against empires altogether,and to agree to the Khilafat demand(for an Ottoman empire)would surely cut the round under the Indian demand for independence. “(3)রোঁলার ডায়েরীতে পাই,রবীন্দ্রনাথের মতে-“Gandhi was not working……..for the unity of India but for the pride and force of Islam. “(হিন্দুর শত্রু হিন্দু, প্রিয়রঞ্জন কুন্ডু,p.16)।
খিলাফত আন্দোলনের দুটি সর্বনাশা পরিণতির জন্ম হয়। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় আনুগত্যে মুসলিম ধর্মান্ধতার ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ এবং দ্বিতীয়ত, খিলাফত আন্দোলনের মাথায় চেপে এক নতুন ধর্মান্ধ নেতৃত্ব, মুসলিম নেতৃত্বের রাশ নিজের হাতে নেওয়ার জন্য আবির্ভূত হল। এই সূত্র ধরে আলী ভাইরা (মৌলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী )গান্ধীজীর “ডান ও বাঁ হাত” হয়ে উঠল।
খিলাফত আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় শ্রদ্ধানন্দ ও ছিলেন। তিনি মুক্ত হয়ে দেখলেন যে মুসলিমরা হিন্দুদের ধর্ম পরিবর্তনের জন্য ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছে।1925 সালে ডক্টর সাইফুদ্দিন কিচলু (জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা) লাহোরে এক জনসভায় হিন্দুদের সতর্ক করে বললেন- “আমার প্রিয় হিন্দু ভাইয়েরা শোন, খুব মন দিয়ে শোনো,তোমরা যদি আমাদের ‘তাঞ্জিম’ আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি কর এবং আমাদেরকে যদি আমাদের অধিকার না দাও, তবে আমরা আফগানিস্তান অথবা অন্য কোন মুসলিম শক্তির সঙ্গে একই উদ্দেশ্যে জোটবদ্ধ হব এবং এই দেশে আমাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করব”(Indian Muslims,Ramgopal,p.166)। আবার শুরু হল ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরণ। প্রতিবছর হাজার হাজার হিন্দু কে ধর্মান্তরিত করা হতে লাগলো ।এত সুন্দর কাজ দেখে এবং সুরাবর্দীর রিপোর্ট পেয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডঃ আব্দুল্লাহ যথেষ্ট আনন্দিত হলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। তিনি দেখলেন যে এইভাবে চলতে থাকলে একদিন হিন্দুদের ও ভারতের ভাগ্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে।তিনি ধর্মান্তরিতদের আবার স্বধর্মে অর্থাৎ হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনতে এক ‘শুদ্ধি’ আন্দোলন শুরু করলেন।তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে 1923 সালের প্রথমার্ধে প্রায় 18 হাজারের বেশি মুসলিম হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে। মুসলিম নেতারা তাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে দেখে স্বামীজীর নামে নানারূপ দোষারোপ করতে শুরু করলেন। যৌথভাবে মুসলিম ও খ্রিস্টান কংগ্রেসীরা আক্রমণ শুরু করলো। আর স্বামীজিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না!!! 1926 সালের 23 সে ডিসেম্বর। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ অসুস্থতার জন্য শয্যাশায়ী ছিলেন।আব্দুর রশিদ নামে এক মুসলিম যুবক স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে আসে। এবং পরিচারিকাকে জল আনতে বলে।পরিচারিকা জল আনতে গেলে রশিদ তার রিভলবার থেকে স্বামীজিকে লক্ষ্য করে পরপর চারটি গুলি করে।মারা যান স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। আব্দুল রশিদ ধরা পড়ে।রশিদ কে বাঁচাতে মুসলিমরা অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করে।এবং কংগ্রেসের বিশিষ্ট সদস্য আসিফ আলী রশিদেরে তরফে কেস লড়েন।এবং রশিদের জন্য মসজিদে মসজিদে বিশেষ নামাজ পাঠ ও শুরু হয়।
খিলাফত আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট জেহাদের প্রবল উন্মাদনা শীঘ্রই দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। 1922 এ পাঞ্জাবে ও বাংলার কিছু স্থানে শুরু হওয়া সেই দাবানল 1926 এর মধ্যেই তা অন্যান্য প্রান্তকে গ্রাস করে।লাহোর, পানিপথ, মোরাদাবাদ,মীরাট, সাহারানপুর, ভাগলপুর, হায়দ্রাবাদ এবং দিল্লি সহ আরো বহু এলাকা।
সারা দেশজুড়ে খিলাফত আন্দোলন ও মোপলা বিদ্রোহ ও অন্যান্য দাঙ্গার রূপে বিস্ফোরণ বহু হিন্দু নেতার চোখ খুলে দিয়েছিল।চিত্তরঞ্জন দাশ, যিনি 1922 এর অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন, প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে হিন্দু- মুসলিম ঐক্য একান্তই অসম্ভব।তাই খিলাফতের শতবর্ষ ধূসর স্মৃতিতে পরিপূর্ণ এক বেদনাময় ইতিহাস।
ডঃ সুমন পানিগ্রাহী (Dr. Sumon Panigrahi)
তথ্যঋণঃ
(1) দি ট্রাজিক স্টোরি অফ পার্টিশন ,হোজ্ঞসুন্দরা বেঙকটরামাইয়া শেষাদ্রি (ভাষান্তর-সুব্রত ভৌমিক)
(2)The future of Indian politics, Annie Besant
(3)Indian Muslims,Ramgopal
(4)হিন্দুর শত্রু হিন্দু, প্রিয়রঞ্জন কুন্ডু
(5) স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ- এক রাজনৈতিক জীবনী, রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়
(6)আমি নাথুরাম গডসে বলছি, শান্তি দত্ত।।
2020-07-09