ভারতের ইতিহাসে এক এবং অদ্বিতীয়‌ স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি দুইবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন বীর বিনায়ক দামোদর সাভারকার

জন্ম:- 28শে মে, 1883

স্থান:- ভাগুর, জেলা:- নাসিক; মহারাষ্ট্র।

পিতা :- দামোদররাও সাভারকার।
মাতা:- রাধা বাঈ (মাত্র ১০ বছর বয়সে মাতৃ বিয়োগ হয় মহামারী কলেরা তে)

ভাই:- বড় ভাই- গণেশ দামোদর সাভারকার ওরফে বাবারাও
ছোট ভাই – নারায়ণ দামোদর সাভারকার এবং বিনায়ক দামোদর সাভারকার ছিলেন মধ্যম ভ্রাতা।
বোন:- ময়না
পিতা দামোদর ছোটবেলায় রামায়ণ, মহাভারত , পেশোয়া বাজিরাও, রানা প্রতাপ এবং ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের বীরত্বের কাহিনী নিজের পুত্রকে শোনাতেন। দামোদর নিজে একজন পন্ডিত ছিলেন এবং অনেক কবিতা লিখেছিলেন। বালক বিনায়ক মারাঠি কবিতা খুব সুন্দর আবৃত্তি করতে পারতেন।
ছয় বছর বয়সে লোকাল গভর্নমেন্ট স্কুলে প্রথম ভর্তি হয় বালক বিনায়ক।
1893-1895 সাল :- এই সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সারাদেশ বিধস্ত হয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল মহারাষ্ট্রের নাসিকেও। 14 বছরের বালক বন্ধুদের একত্রিত করে লাটি খেলার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বালক বিনায়ক মুসলিম আক্রমণকারীদের ঢিল ও পাথর ছুড়ে বিতাড়িত করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।
1897 সাল:-
সাভারকার পরিবারে প্লেগ মহামারী:-
১.পিতা দামোদর পন্থের বিয়োগ ঘটে।
২.নারায়ণ সরকারের অবস্থা মরণাপন্ন হয়ে ওঠে ।
৩. বড় ভাই গণেশ প্লেগে আক্রান্ত হন পরিবারের পুরো দায়িত্ব বিনায়কের উপর।
প্লেগ মহামারী সময় রানী ভিক্টোরিয়ার হীরকজয়ন্তী ব্রিটিশ সরকার পালন করার সর্বপ্রকারের ব্যবস্থার আয়োজন করেছিল। প্লেগ নিবারণের নামে ইংরেজ সৈনিকের বর্বর অত্যাচার ও উৎপীড়িনে নবজাগ্রত উদীয়মান তরুণ সম্প্রদায় এই উৎসব বন্ধ করার জন্য সচেষ্ট হন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আবেদন-নিবেদন করিয়া যখন বিফল হল তখন প্লেগ কমিশনার Mr
Randকে গুপ্ত ভাবে হত্যা করা হয় 22 শে জুন 1897। এই ঘটনায় অভিযুক্ত চাপেকর ভাতৃদ্বয় ও গোবিন্দ রানাডে কে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং সন্দেহ ক্রমে লোকমান্য তিলক কে কারাগারে বন্দী করা হয়। চাপেকর ভাতৃদ্বয়ের আত্ম বলিদান গভীরভাবে বালক বিনায়কের মনে বিপ্লবের স্ফূলিঙ্গে ঘিয়ের কাজ করেছিল। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা আরাধ্য দেবতা অষ্টভূজা মা ভবানীর
সামনে কাতর কন্ঠে প্রার্থনা করতেন—- “মা আশীর্বাদ করো জাতির মুক্তির চেষ্টায় প্রয়োজন হলে জীবন বিসর্জন দিতে যেন কুন্ঠিত না হই।”

শিক্ষাজীবন :- গ্রামের বিদ্যালয় প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে পুণার ফার্গুসন কলেজে বি.এ পড়ার জন্য ভর্তি হন। এখানে বি.এ ডিগ্রি পাওয়ার পর শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মার থেকে কলারশিপ পেয়ে তিনি লন্ডনে যান আইন করার জন্য সেখানে “Gray’s Inn Law College” এ ভর্তি হন।
১৯০০, ১লা‌ জানুয়ারী:- মাত্র 17 বছর বয়সে ‘মিত্র মেলা’ স্থাপন করেছিলেন।
১৯০১ :- মার্চ মাসে যমুনা বাঈ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই বছর ডিসেম্বর মাসে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯০৪, ১৯শে ডিসেম্বর:- এলএলবি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
১৯০৫:- বয়কট আন্দোলনে অংশগ্রহণ —
বিদ্যালয়ের গরমের ছুটিতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে বিদেশি দ্রব্য বর্জনের করার জন্য এবং স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। পুণায় একটি সভায় বিদেশি বস্ত্র একসাথে জোগাড় করে আগুন লাগিয়ে তার প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রফেসর পরান্জপে বিদ্যালয় কমিটির চাপে বিনয়কে স্কুল থেকে বিতাড়িত করতে বাধ্য হয়। পরে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় বিএ পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়।
এই সময়ে বিনিয়োগের প্রথম পুত্র প্রভাকর এর জন্ম হয়।

১৯০৬:- ইউরোপ যাত্রা
স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবাসী ভারতীয়দের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন এবং ইউরোপে “অভিনব ভারত” এর শাখা সংগঠন স্থাপন করেন।
১৯০৭-১৮ই আগষ্ট:- জার্মানির স্টার্ট শহরে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতীয় বিপ্লবী দল ভারতের জাতীয় পতাকা রূপে তাদের পতাকা উড্ডীন করেন।
১৯০৮- ২রা মে :- লন্ডনে বীর সাভারকার প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের জন্মজয়ন্তী পালন করেন।
১০ই মে :- ইন্ডিয়া হাউস এ সিপাহী বিদ্রোহের 50 বছর স্মরণে এক অনুষ্ঠানে মেয়েরা ‘বন্দেমাতারম’ গাইলেন। সাভারকার স্বরচিত কবিতা ‘ওহ মারটয়ার্স’ পাঠ করলেন। সেই বছরই সাভারকার মারাঠি সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস লিখে ফেললেন। পরে বইটি দ্য হিস্ট্রি অফ দা ওয়ার অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।

১৯০৯-৯ইজুন :- এইসময় পুণেতে তার দাদা গণেশ দামোদর সাভারকার ওরফে বাবু রাও — রানা প্রতাপ শিবাজী তাতিয়া টোপি এবং রানি লক্ষীবাই কে নিয়ে বিপ্লবী কবিতা লেখার দায়ে যাবজ্জীবন কারাবাস হলো। এই অযৌক্তিক শাস্তির প্রতিবাদে ১লা জুলাই 1909 লন্ডনে ইম্পিরিয়াল ইনস্টিটিউট হলে মদন লাল ধিংড়া ব্রিটিশ প্রশাসক মার্লির স্যার উইলিয়াম কার্জন উইলি কে হত্যা করে 17 ই আগস্ট লন্ডনে বিপ্লবী ধিংড়ার ফাঁসি হয়।
আমেদাবাদ শহরে এই সময় লর্ড মিন্টো রুপোর দুটি বোমা ছোড়া হয় অবশ্য একটা বোমা ফাটে নি।

১৯০৯-২১শে ডিসেম্বর:- নাসিকে অনন্ত কানহারে নাসিক জেলার কালেক্টর ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে একটা থিয়েটারে গুলি করে হত্যা করা হয়। জ্যাকসন সেই ব্যক্তি যে গণেশ সাভারকার কে যাবজ্জীবন পাঠিয়েছিল। যে পিস্তল দিয়ে জ্যাকসনকে হত্যা করা হয় সেই পিস্তল লন্ডন থেকে সাভারকারের পাঠানো পিস্তল এর মধ্যে একটি।
এই সময় অনেকের পরামর্শে বিনায়ক সভারকার প্যারিসে মাদাম কামার কাছে আশ্রয় নেন। এর কিছুদিন পরে কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ 1910 সালে তিনি লন্ডনে ফিরে আসে।

১৯১০-১৩ই মার্চ :- লন্ডনে স্টেশনে নামা মাত্র বিনায়ক সাভারকরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯১০-১লা জুলাই:- বোম্বে গামী এস এস মোরিয়া জাহাজে একটি চারবার্থের কেবিনে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় সাভারকার কে তোলা হলো। সঙ্গী হলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এডওয়ার্ড পার্কার এবং বোম্বে পুলিশের ডিএসপি সিআইডি ও দুজন কনস্টেবল। ৭ইজুলাই সকাল দশটায় ফ্রান্সের বন্দরে জাহাজ নোঙ্গর ফেলে। ৮ইজুলাই সকাল সাড়ে ছটায় পায়খানার ছোট্ট পোর্ট হোলের মধ্যে দিয়ে সমুদ্রে পার হয়ে 12 ফুট সাঁতরে সাভারকার জেটিতে ওঠে ও কিছুদূর দৌড়ে সাভারকার ভারতীয় পুলিশ ও একজন ফ্রেন্ঞ্চ ন্যাভাল সিকিউরিটি গার্ডের হাতে ধরা পড়েন। ফ্রান্সে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে দি হেগ- এ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা পাঠানো হয়।

সেলুলার জেল:-
১৯১০- ২৩ শে ডিসেম্বর:- বোম্বের আদালতে তিনজন বিচারকের ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়। প্রথম মামলা —- রাষ্ট্রদ্রোহিতার (বিভিন্ন বক্তৃতা এবং লেখার ভিত্তিতে) রায় বেরোলো– যাবজ্জীবন কারাবাস এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিল। দ্বিতীয় জ্যাকসন হত্যা মামলার রায় বেরোলো 30 শে জানুয়ারি 1911; একই রায়ে আজীবন কারাবাস অর্থাৎ 25 বছর সশ্রম জেল কিন্তু দুটো শাস্তি একসঙ্গে চলবে না হবে একের পর এক। ফলে মোট কারাবাস 50 বছর। ওদিকে তখন সাভারকার 28 বছরের যুবক কিন্তু দি হেগ আন্তর্জাতিক আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত সাজা মুলতবি থাকলো।

ওপরের রায় বেরোনোর এক পক্ষকাল পরে হেগে পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আর্বিট্রেশন সাভারকার প্রত্যার্পণ মামলার শুনানি শুরু হলো এবং মাত্র 10 দিনের মধ্যে 24শে ফেব্রুয়ারি 1911 – এ রায়ে বলা হয় সাভারকারের উপর ব্রিটিশ সরকারের অধিকার স্বীকৃত হবে।
এরপর আন্দামানের উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং কালাপানি পার করে সেলুলার জেলে রাখা হয় বিনায়ককে।
১৯১১ -৪ঠা এপ্রিল:- সাভারকার সরকারের কাছে তার বিচার সংক্রান্ত ছাড়ের জন্য আবেদন জানান যদিও সেটি নাকচ হয়ে যায়।
১৯১১-৩০শে আগষ্ট:- ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রথম আবেদন পত্র লেখেন যা ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯১১ সালে বাতিল হয়ে ফিরে আসে।
১৯১৭ :- এই সময় আরেকটি আবেদন জানায় আবেদনটি ছিল — সকল রাজনৈতিক বন্দীদের সাধারণ ক্ষমার জন্য।
১৯২০:- তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা যথা মহাত্মা গান্ধী, বিঠলভাই প্যাটেল , বাল গঙ্গাধর তিলক এর মতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সাভারকারের শর্তবিহীন মুক্তির দাবি করেন। ১৯২৩ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে সাভারকার কে মুক্তি করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

১৯২৪,৬ই জুন:- জেল থেকে মুক্তি পান সাভারকার।
সাভারকার 10 বছর সেলুলার জেলে 4 বছর রত্নাগিরি জেলে এবং 13 বছর গৃহবন্দি অবস্থায় দিন যাপন করেছেন।

রত্নাগিরি জেলে থাকাকালীন তার বিখ্যাত বই “Hindutva: Who Is Hindu?” রচনা করেন।
জেল থেকে মুক্তির পর বিনায়ক সভারকার প্রত্যক্ষভাবে কোন রাজনৈতিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু তার লেখা বই এবং ব্রিটিশের চোখের আড়ালে বিপ্লবী কর্মকান্ড ভারতবর্ষের তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল।

১৯৩৭ :-
হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা
এই সময় হিন্দু মহাসভা নামে তিনি আলাদা রাজনৈতিক পার্টি তৈরি করেন এবং যার মনোনীত সভাপতি হন। ১৯৩৭-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হিন্দু মহাসভার সভাপতিত্ব করেন। পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীর হত্যারপর সাভারকার সভাপতি পদ থেকে সরে যান।

১৯৬৬,১লা ফেব্রুয়ারি:- “আত্মার্পণ” বীর বিনায়ক দামোদর সাভারকারের মহাপ্রয়াণ হয়। অনশন ছিল তার মৃত্যুর কারণ। সাভারকার ওষুধ, জল ও খাদ্য পরিত্যাগ করেছিলেন। তার মতে এটি আত্মহত্যা নয় আত্মার্পণ।
মৃত্যুর আগে তিনি একটি প্রতিবেদন লেখ যার শিরোনাম ছিল “আত্মহত্যা নেহি আত্মার্পণ” যেখানে তিনি জানান — “যে যখন জীবনের লক্ষ্য শেষ হয়ে যায় এবং সমাজের সেবা করার ক্ষমতা আর থাকেনা তখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করে ইচ্ছেমতো জীবন শেষ করা ভালো।”
সাহিত্যিক প্রতিভা:-
১) মাত্র 10 বছর বয়সে প্রথম কবিতা মারাঠি ভাষায় “স্বদেশী কি ফটিকার” রচনা করেন, দৈনিক পত্রিকা ‘জগত হিতূষে’ প্রকাশিত হয়।
২) ইংরেজি ও মারাঠি ভাষায় মোট ৩৮ টি বই লেখেন। তার প্রথম জীবনের বিপ্লব, গ্রেপ্তার ,বিচার ও কারাগারের বিবরণ দিয়ে তথ্য বিবরণী মূলক দুটি বই লিখেছিলেন “মারাঠা এম্পায়ার” এবং “মাজি জন্মাথেপ” (My Lifeterm)।


বৌদ্ধিক বিভাগ
মধ্যভাগ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.